এ পৃথিবীটা এত অদ্ভুত ভাবে আল্লাহ তায়ালা তৈরি করেছেন ভাবা শুরু করা মাত্রই আমি খেই হারানো শুরু করি। প্রবল অস্থিরতায় এদিক ওদিক তাকাই—জানালা দিয়ে ঝিরঝির বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আমার চোখের হাজার মেগাপিক্সেল দিয়ে ধারণ করতে থাকি, ভালো লাগা বাড়াতে চাই। বাড়ে না, বাড়ে বিষণ্ণতা।

এ পৃথিবীর কোনো এক কোণে; আফগান কিংবা সিরিয়ায় ঠিক এমুহূর্তে হয়তো পথের ধারে পাথর পাথর খেলাটা খেলবার সময় বোমার আঘাতে কিশোর একটা ছেলে তার ছোট্ট শরীরটা টুকরো টুকরো করে ফেললো, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো সে মুহূর্তে। কেন মরলো—তা কোনোদিন জানলো না মূর্খ বালক। ঠিক একই সময়ে আমি আর আমরা চেক ইন দিলাম—"এট অমুক স্টেইক হাউজ।" পশ্চিমে আরেক কিশোর ওদিকে কোমড় দুলিয়ে ক্লাবিং করছে, বিয়ার আর গার্লফ্রেণ্ডে মত্ত এক স্বপ্নময় রাত!

হেবরন কিংবা কাশ্মীরে ঠিক যে মুহূর্তটাতে বেয়োনেটের খোঁচায় প্রাণ দিল একটা ছেলে ঠিক সেই একই মুহূর্তে আমার বাসার নিচের হাসনাহেনা গাছটায় একটা ফুল ফুটে উঠলো। সুবিশাল আকাশের কোথাও একটা উল্কা খসে পড়লো তার আলোকচ্ছটার তীব্র সৌন্দর্য নিয়ে। একদল ডলফিন দ্রুত গতিতে লাফিয়ে পড়লো সমুদ্রের বুকে। ছপাৎ! একটা সফেদ বক লম্বা ঠোঁটে নদীর বুক হতে একটা মাছ তুলে নিয়ে উড়ে চলে গেল; দূরে কোথাও! অনেক...

কত সৌন্দর্য, কত সৃষ্টি, কত ভালোবাসা, কত ফুল চারপাশে। তবুও মানুষগুলো হত্যা করে। হিংসার অনলে জ্বলে-পুড়ে ছাড়খার করে দেয় প্রতিদিন—নিজেকে, অন্যকে।

অতি তীব্র অনুভূতি নিয়ে আমি এই পৃথিবীটাকে দেখতে থাকি। হাহাকার জন্মে প্রতিনিয়ত। আমার আট মাসের কন্যাটা তার ক্ষুদ্র হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুচ্ছে। কী নিশ্চিন্তে, কী নির্ভাবনায়। আহ! এত তীব্র মায়া, এত তীব্র ভালোবাসা কেনো এই জগতময়? আচ্ছা, আমি কী কখনও পারবো আমার এই কন্যার মতো দেখতে একই বয়সী অন্য আরেকটা শিশুকে হত্যা করতে? কে জানে? পারবো হয়তো। মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি। ভালোবাসা আর ঘৃণাকে মুদ্রার এপিঠে-ওপিঠে নিয়েই চলতে হয় আমাদের। কী অদ্ভুত মানব জনম!

মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আমার তীব্র কষ্টগুলোকে শব্দ দিয়ে এঁকে ফেলি। এ পৃথিবীর বৈচিত্র্যগুলো, এর অনুভূতিগুলো, এর সৌন্দর্যগুলোর প্রতিটা পরত প্রতিটা আঁচড় আমার শব্দে শব্দে ধারণ করি। আচ্ছা, তীব্রতম কষ্টের মুহূর্তগুলো কী আসলেই কোনো সাহিত্যিক কখনও লিখতে পেরেছেন, বোঝাতে পেরেছেন পুরোপুরি? আদ্যপ্রান্ত? প্রতিটা মানুষ নিজের ভেতর এক সুবিশাল আকাশ ধারণ করে বসে আছে; আমি বাজি ধরে বলতে পারি কেউ সে আকাশের বিশ ভাগও প্রকাশ করে যেতে পারেননি কোনোদিন।

এ পৃথিবীতে অনেক কিছু সৃষ্টি হয়েছে, নতুন আরও অনেক কিছুর সৃষ্টি হবে, কেবল মানুষের সুতীব্র অনুভূতিগুলো মাপার যন্ত্র কোনোদিন সৃষ্টি হবে না। নিজ মনকে নিজের মতো করে সাজাতে শিখতে পারবে না মানুষ, কোনোদিন না। কক্ষনো না!

কেবল যিনি সব বানিয়েছেন তিনিই সব নিয়ন্ত্রণ করবেন। তাঁর দু আঙুলের ভাঁজে আমাদের অন্তরকে তিনি রেখে দিয়েছেন। পরিবর্তন, পরিবর্ধন কেবল তাঁরই হাতে। অনুভূতি আর অন্তরটা তাই উড়িয়ে অথবা ভাসিয়ে দিলাম তাঁরই ভরসায়। চুপ থাকি, দাঁতে দাঁত চেপে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে থাকি। আমার নৈঃশব্দগুলোই উত্তম আমার অপরিপক্ক শব্দদের চাইতে....


Thursday, 20 July 2017 at 22:30