মর্যাদার অধিকারী হতে চাইলে কিছু মূল্য দিতে হয়, কিছু খেসারত দিতে হয়।
কিন্তু দুর্বল চিত্তের কিছু মানুষ আছে, যাদের কাছে এই খেসারত হচ্ছে একটা বোঝার মতো, এমন এক বোঝা যা বহন করার সাধ্য তার নেই। এ বোঝা থেকে পালিয়ে বেড়াতে, তারা বেছে নেয় বশ্যতা স্বীকারের পথ। ফলে তার জীবন হয়ে যায় সস্তা, অর্থহীন, যে জীবন নড়বড়ে আর শঙ্কা দিয়ে ঘেরা। এ এমন এক জীবন, যে জীবনে তারা নিজেদের ছায়া দেখলেও ভয় পায়, নিজেদের কণ্ঠস্বর শুনেই কেঁপে ওঠে।
এরা এমন এক অন্যায্য মূল্য দিয়ে বশ্যতাকে কিনে নেয় যা মুক্তির মূল্যের চাইতে বহুগুণে বেশি। বশ্যতা স্বীকারের মূল্য এরা কড়ায়-গণ্ডায় পরিশোধ করে। নিজেদের আত্মাকে বিকিয়ে দিয়ে, আত্মমর্যাদাকে ধূলিসাৎ করে, সুনামকে ক্ষুন্ন করে, মনের শান্তিকে বলি দিয়ে, কখনো বা নিজেদের অজ্ঞাতসারে নিজেদের জান-মাল দিয়ে হলেও এরা বশ্যতার খেসারত দেয়। তারা নিজেদের এই ভেবে বোকা বানায় যে, যদি তারা নিজেদের মানমর্যাদা কিছুটা ক্ষুন্ন করে বশ্যতা স্বীকার করে নেয়, বিনিময়ে ক্ষমতাসীন শাসকবর্গ তাদের স্বীকৃতি দেবে! কিন্তু আসলে কী তা হয়? আমরা তো এমন কতবারই দেখেছি, এই মানুষগুলোকে তাদের প্রভুরা ছুঁড়ে ফেলতে এতটুকু বিলম্ব করেনি, অথচ নিজেদের গা বাঁচাতে আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা এই মনুষ্যপ্রভুদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল!
এরকম কতো মানুষ তাদের পৌরুষকে জলাঞ্জলি দিয়ে এই প্রভুদের সামনে মাথানত করেছে, তাদের পায়ের ধূলোয় মুখ মুছেছে, শেষ পর্যন্ত নিজের মনুষ্যত্বটাই খুইয়ে এসেছে। দিন শেষে এরা কী পেয়েছে? এরা লাভ করেছে এক অর্থহীন, তুচ্ছ জীবন। যে প্রভুদের অনুগ্রহ লাভের আশায় সে তার জিভ ঝুলিয়ে রেখেছিল, লেজ নাড়িয়েছিল, কাদামাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছিল, সেই প্রভুরা তাদের দিনশেষে তাদেরকে কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।
এমন কতো মানুষ আছে, যারা সম্মানিত হতে পারত, মহৎ হতে পারত, আল্লাহর দেওয়া আমানতের সংরক্ষণ করতে পারত। কিন্তু না—তারা সেই আমানতের খেয়ানত করেছে, দায়িত্ব পালনে শিথিলতার পরিচয় দিয়েছে। কেউ কেউ নিজেকে বিকিয়ে দেওয়ার জন্য এতই মরিয়া হয়ে যায় যে, খোদ জালিমও অবহেলা আর অবজ্ঞায় তাকে কিনে নেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যারা একসময় তাকে মিথ্যে আশা আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারাই একসময় তাকে দুর্গন্ধময় লাশের মত পরিত্যাগ করে, লাথি মেরে দূরে তাড়িয়ে দেয়। অনেকের অবস্থা এমন হয়েছে যে, তারা পাহাড়ের চূড়া হতে একেবারে মাটিতে আছড়ে পড়েছে। কেউ তাদের প্রতি দয়া করে নি, দয়া দেখায় নি, তাদের জানাযায়ও অংশ নেয়নি—যে প্রভুদের সান্নিধ্য পেতে তারা এতটা নীচে নেমেছে, এমনকি তারাও না।
এত এত স্মরণিকা আর অভিজ্ঞতা থাকার পরেও আমরা দেখি, নিজেকে বিকিয়ে দেওয়ার এই তালিকায় প্রতিনিয়ত কেউ-না-কেউ যুক্ত হচ্ছে, জালিমের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে পূর্ণ খেসারত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, আল্লাহর সাথে, আপন মানুষদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে, আমানতের খেয়ানত করছে, নিজেদের মানমর্যাদাকে বিসর্জন দিচ্ছে, মনুষ্যপ্রভুর নৈকট্যপ্রাপ্তি আর আরাম-আয়েশের লোভে নিজেদের জিভ বের করে দিয়েছে। বস্তুত, এরা মরুভূমির মরীচিকাকে তাড়া করছে, অবশ্যম্ভাবী এক পতনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। মানুষ উল্লসিত চোখে তার পতন উপভোগ করে আর তার পুরাতন প্রভুরা তাচ্ছিল্যের সাথে তার দিকে চেয়ে থাকে।
আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে, আমি দেখেছি এবং দেখেই চলেছি—বড় মাপের সব মানুষ, যারা মাথা নিচু করে, ঘাড় কাত করে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষকে প্রভু মেনেছে। বশ্যতার বোঝা কাঁধে নিয়ে প্রভুর আজ্ঞাবহ হয়েছে। যখনই প্রভুর কার্যোদ্ধার হয়েছে, পা দিয়ে ঠেলে কুকুরের মতো তাদের সরিয়ে দিয়েছে আর তারা কাতারবদ্ধ হয়েছে দাসদের এক লম্বা সারিতে—তাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।
আমি দেখেছি তাদের! তারা হতে পারত মুক্ত-স্বাধীন, কিন্তু তারা বেছে নিয়েছে দাসত্বের পথ। তারা হতে পারত দৃঢ়চেতা, কিন্তু তারা হয়েছে দুর্বল। তারা হতে পারত শ্রদ্ধার পাত্র, কিন্তু তারা হয়েছে কাপুরুষ। কিছু মূল্য দিতে হবে বলে সম্মান আর মর্যাদার পথকে পরিত্যাগ করেছে, অথচ বশ্যতার চড়া মূল্য তারা দিয়ে চলেছে বারেবার। ক্ষমতাসীনদের মনজয় করতে তারা ভয়ানক সব অপরাধ আর পাপে জড়িয়েছে, শুধু যেন তাদের ছায়ায় একটুখানি আশ্রয় নিতে পারে, অথচ ক্ষমতাসীনদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করার ক্ষমতা তাদেরই ছিল, হাতের মুঠোয় ছিল! আমি দেখেছি পুরো একটা জাতি, মাত্র একবার মুক্তির মূল্য পরিশোধ না করে ভয় পেয়ে পিছু হটেছিল বিধায় পরাজয় আর নিপীড়ণের মূল্য পরিশোধ করে গেছে বারবার, অথচ পরাজয়ের মূল্যের তুলনায় মুক্তির মূল্য তো তেমন কিছুই ছিল না। অতীতে, ইহুদিরা তাদের নবীকে বলেছিল,
“...হে মূসা, সেখানে একটি প্রবল পরাক্রান্ত জাতি রয়েছে। আমরা কখনও সেখানে যাব না, যে পর্যন্ত না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। তারা যদি সেখান থেকে বের হয়ে যায় তবে নিশ্চিতই আমরা প্রবেশ করব...” [৫:২২]
এ কাজের শাস্তিস্বরুপ তারা মরুভূমিতে উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়িয়েছিল চল্লিশ বছর ধরে, মরুভূমির বালি তাদের কুড়ে কুড়ে খেয়েছে, নির্বাসনের অবমাননা তাদের ভোগ করতে হয়েছে, ভয় তাদেরকে তাড়া করে বেড়িয়েছে।
এই সব কিছুই কেবল একটি কারণে—মুক্তি আর মর্যাদা লাভের জন্য মূল্য দিতে তারা রাজি হয়নি, অথচ মাপতে গেলে এর পরিমাণ তাদের পরিণামের একভাগও হতো না।
কাজেই, মূল্য সবাইকে পরিশোধ করতেই হবে—প্রত্যেক ব্যক্তি, দল ও জাতিকে। সে মূল্য হতে পারে গৌরব, মর্যাদা আর মুক্তি অর্জনের মূল্য, অথবা শোষণ এবং দাসত্বের শেকলে আবদ্ধ হবার মূল্য। প্রতিটি অভিজ্ঞতা এ বাস্তবতার সত্যায়ন করে যে—এর থেকে কোনো মুক্তি নেই।
মুক্তির মূল্য দিতে যারা ভয় পায়, মর্যাদার পথে হাঁটতে যারা ক্ষতির আশংকা করে, অন্যের পায়ের ধূলোয় যারা মুখ মোছে, নিজেদের ওপর অর্পিত আমানতের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেদের আত্মসমান আর মানবতাবোধের সাথে, মুক্তির জন্য উম্মাহর ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাসের সাথে যারা প্রতারণা করে, তাদের সকলকে আমি বলছি—ইতিহাস থেকে শিক্ষা নাও, শিক্ষা নাও বাস্তবতা থেকেও। তোমাদের সামনে তাজা উদাহরণ রয়েছে যারা সাক্ষ্য দেয়—বশ্যতার খেসারত, মর্যাদার দামের চাইতে বহুগুণে বেশি। আর মুক্তির জন্য তোমাকে কমই মূল্য দিতে হবে, যতটা না আজ তুমি দাসত্বের জালে আটকা পড়ে দিচ্ছ। যারা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত তারা প্রকৃত জীবনের স্বাদ পায়, আর যারা দারিদ্রতার পরোয়া করে না, দুনিয়া তাদের পায়ে এসে নত হয়। যারা ক্ষমতাসীনদের ভয় করে না, তাদের ভয়ে ক্ষমতাসীনরা তটস্থ থাকে! এমন শত শত উদাহরণ আছে সেইসব আজ্ঞাবাহী লোকের, যারা তাদের বিবেককে বিকিয়ে দিয়েছিল, তাদের ওপর অর্পিত বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিল, সত্যকে পরিত্যাগ করেছিল, কাদার মাঝে গড়াগড়ি খেয়েছিল এবং একসময় তারা বিলীন হয়ে গেছে, কেউ তাদের মনে রাখে নি—তাদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন আল্লাহ—তাদের অভিশাপ দিয়ে গেছে মানুষ।
অপরদিকে, আমাদের হাতে এমন দৃষ্টান্ত আছে, যারা বশ্যতা স্বীকার করতে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বিশ্বাসঘাতকতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, এবং নিজের পুরুষত্বকে তারা বিসর্জন দেয় নি। তাদের যারা বেঁচে আছে তারা মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে, আর যারা মরে গেছে তারা মরে গেছে মাথা উঁচু রেখেই, যদিও সংখ্যায় তারা অপ্রতুল...”
সাইয়্যিদ কুতুব (রাহিমাহুল্লাহ)
নভেম্বর, ১৯৫২
ইংরেজি অনুবাদ: তারিক মেহান্না
বাংলা অনুবাদ: জিম তানভীর
বই: কখনও ঝরে যেও না