[১]
ফেব্রুয়ারি যখন চলেই এসেছে, ভালোবাসা দিবস নিয়ে যথারীতি হুজুর আর সেকুলাঙ্গারদের মাঝে ক্যাঁচাল তো হবেই। এরই মাঝে হয়তো হুজুর পক্ষের কিছু জেনারেল স্টেটমেন্ট শুনে আঁতকে উঠবে সাধারণ তরুণ সমাজ। যেমন, "তোমরা যেটাকে ক্রাশ খাওয়া বলো, ইসলাম সেটাকে বলে চোখের যিনা।"
আসলে ক্রাশ খাওয়া বলতে যা বোঝায়, তা এমনিতে স্বাভাবিক মানবীয় বৈশিষ্ট্য। বিপরীত লিঙ্গের কোনো সদস্যের প্রতি যে ক্রাশ খায় না, তার অবশ্যই চিকিৎসা দরকার (জন্মগতভাবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যারা, তাঁদের কথা স্বতন্ত্র)। একটা সমাজে সবকটা নারী নেকাব পরলে আর সবকটা পুরুষ ফিলিস্তিনি রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে চললেও ক্রাশের ঘটনা ঘটবে। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজে পাত্র-পাত্রী দেখা বা বাসররাতে পরস্পরকে দেখার সময় হলেও মানুষ ক্রাশ খাবে। এখন কথা হলো, তাহলে হুজুররা এই স্বাভাবিক জৈবিক বিষয় নিয়ে এত ক্ষ্যাপা কেন?
কারণ হলো ক্রাশ খাওয়ার সূত্র ধরে হওয়া পরবর্তী কাজগুলো। আর সেসব কাজকে ঘিরে শয়তান আর সেকুলাঙ্গারদের (দুইটা প্রায় একই জিনিস যদিও) উসকানি ও ব্যবসা।
ক্রাশ খাওয়ার পরে কী কী করতে হবে বা করা যাবে না, তা নিয়ে বই লিখে ফেলা সম্ভব। নাম হতে পারে "ক্রাশ খাওয়ার বিধান"। যেমন—বিবাহের সামর্থ্য থাকলে যথাস্থানে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া, অভিভাবকদের জানানো, খোঁজখবর নেওয়া, আল্লাহর সাহায্য কামনা ইত্যাদি। সামর্থ্য না থাকলে নিজেকে সংবরণ করা, সওম পালন, (এক্ষেত্রেও) আল্লাহর সাহায্য কামনা ইত্যাদি।
সব মিলিয়ে ক্রাশ খাওয়ার পরে বিশাল দায়িত্ব কাঁধে আসে। সেকুলাঙ্গাররা এই পরের অংশটা পুরোপুরি পালটে দেয়। দায়িত্বটুকু বাদ দিয়ে শুধু মজাটুকু নেওয়াকে উৎসাহিত করে। লটরপটর করা, পরস্পরকে চেটেপুটে দেখা, একজন মানুষের টানে প্রয়োজনে পরিবার-সমাজের সাথে শত্রুতা করা ইত্যাদি। সমাজে এগুলোর বিশাল এবং চক্রাকার কুপ্রভাব আছে।
তাই আপনারা ক্রাশ খান, ঠিক আছে। খাওয়ার পরের কাজগুলো হতে হবে ইসলামের সীমার মাঝে। এটাই হুজুরদের বক্তব্যের ভাবসম্প্রসারণ।
[২]
অবৈধ মিলনের ফলে জন্ম নেয়া বাচ্চা বা ভ্রূণের করুণ পরিণতি নিয়ে কোনো নিউজ আসলে আমরা কাছে আসার গল্পকে তুলাধুনা করতে শুরু করি। ঠিক আছে, সমস্যা নেই। তবে সেকুলাঙ্গারদের একটি আর্গুমেন্ট কিন্তু আমরা দেখেও না দেখার ভান করছি। এটা প্রতিপক্ষের প্রতি সুবিচার হলো না।
সেকুলাঙ্গারদের মতে, 'বৈধ-অবৈধে'র এই আরোপিত ধারণাগুলো তুলে দেওয়া উচিত। দুজন মানুষ ভালোবেসে মিলিত হতেই পারে। সমাজ ছিঃ ছিঃ না করলে, ১০০ দোররা না মারলে সেই ভালোবাসার ফসলও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারতো। তাই তাদের মতে 'কাছে আসার গল্প' দায়ী নয়, দায়ী হচ্ছে সামাজিকভাবে নির্মিত 'বৈধ সম্পর্ক-অবৈধ সম্পর্কে'র ধারণাটা।
আচ্ছা, আর্গুমেন্টটা আমরা কয়েক দিক থেকে ভেঙে ভেঙে দেখার চেষ্টা করি। বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য যেসব rituals প্রচলিত, তার বেশিরভাগই কিন্তু ইসলামিক শর্ত না। কাবিননামা থেকে শুরু করে হালদি নাইট, ম্যাহেন্দি নাইট, বৌভাত, জামাইপোলাও ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতাগুলো হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপানো নিয়ম, নয়তো সমাজের। এই অনুষঙ্গগুলো ফেলে দিলে বা শিথিল করে আনলে একটা অবৈধ সম্পর্ককে ইসলামিক্যালি বৈধ বানানো এমন কোনো ঝামেলা না।
আরেকটা ব্যাপার হলো তরুণ-তরুণী নিজে থেকে যদি কাউকে পছন্দ করে, মুরুব্বিদের উচিত না "দেশটা গেল রে গেল রে" বলে আঁতকে ওঠা। একটা মানুষ কত বছর যৌনক্ষুধা চেপে রাখবে? তবে বয়স্কদের গাইডলাইন ছাড়া বাচ্চারা হয়তো অপদার্থ কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারে। সেটা রোধ করার জন্য শিশুকাল থেকেই ওইভাবে শিক্ষা দেওয়া উচিত। সেটা না দিলে পরে হায় হায় করার কোনো অধিকার নেই।
আচ্ছা। অধিকারের কথা গেল। এবার দায়িত্ব। চিপায়চাপায় প্রেম না করে দুটো মানুষ যখন মহা ধুমধামের সাথে (রূপক অর্থে অবশ্যই), সমাজকে জানিয়ে, সাক্ষী রেখে বিয়ে করে, তখন অনেক দায়িত্ব চলে আসে। এই দায়িত্বগুলো সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। চিপায়চুপায় দায়িত্ব নেই, শুধু মজাটা আছে। এই দায়িত্বগুলো নেবার মতো সাহস যারা রাখে না, শুধু মজা নিতে চায়, 'বৈধ-অবৈধে'র ধারণা তুলে দিলেও তারা বাচ্চাকে ডাস্টবিনে বা ট্রাংকেই ফেলে রাখবে। এগুলো রোধ করতে তাই ছিঃ ছিঃ করা, দোররা মারা, পাথর মারার নিয়মগুলোর দরকার আছে।
এই বাচ্চাকাচ্চা পেলেপুষে জমিনে মানবজাতির খিলাফত জারি রাখাটা আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব। দায়িত্ব মানে তাতে কষ্ট থাকবেই। সালাত পড়তে কষ্ট আছে, সিয়াম পালন করতে কষ্ট আছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় আমরা কষ্টগুলো করব, যাতে জান্নাতে গিয়ে আরাম করতে পারি। যারা আল্লাহর প্রতি সচেতন না, আল্লাহর ব্যাপারে জ্ঞান রাখে না, তারা শুধু শুধুই এ কষ্টগুলো করবে না। কিছু দেশে এমন হচ্ছেও যে মানুষ সন্তান না নিয়ে কুত্তা-বিলাই পুষছে। কারণ ঝামেলাও কম, কিছু একটা লালনপালনের স্বাদও পাওয়া গেল।
তাই 'বৈধ-অবৈধে'র ইসলামিক ধারণাটা থাকার দরকার আছে।
[৩]
ইনবক্সে অনেকেই একটি বিশেষ ধরনের সমস্যার সমাধান জানতে চান। বিপরীত লিঙ্গের মানুষ ঘটিত সমস্যা।
আলহামদুলিল্লাহ এমন জাহিল কমই আছে যারা "পবিত্র প্রেম" ভেবে হারাম সম্পর্কে লিপ্ত হয়। বেশিরভাগ হারামখোরই আসলে পবিত্র-অপবিত্রের ধার ধারে না। কিন্তু যারা আল্লাহর দেওয়া সীমারেখা একটু একটু মেনে চলতে চায়, তাদের মনেও কি কিছু চেহারা মাঝেমাঝে দোলা দিয়ে যায় না? এই টান, এই আকর্ষণ, এই অস্থিরতা কি আল্লাহরই দেওয়া নয়? সমাজটাও এমন যে, সময়মতো বিয়েও করতে দেয় না। তাহলে উপায়!
কাউকে যেন বোঝানো যাচ্ছে না সমস্যাটা। বন্ধুদেরকে জানালেই তো তারা হৈহৈরৈরৈ করে উৎসাহ দেবে হারামে লিপ্ত হতে। আবার আশপাশের হুজুরগুলোকেও এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে কেমন ভয় ভয় লাগে। সবার কেমন ফেরেশতার মতো নূরানী চালচলন। কেমন গম্ভীর! এসব বালখিল্য জিনিস নিয়ে প্রশ্ন করলে যদি তারা ধমক দিয়ে বসে—"হপ! কীসব ফাহেশা চিন্তাভাবনা! যাও গিয়া তওবা কর। ৪০ রাকাত নফল নামাজ পড়!"
ভাইবোনেরা! প্রথমত, আপনি যে হারাম সম্পর্ক থেকে বাঁচার জন্য এতটা সচেষ্ট, এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় রহমত। অনেকেই এই রহমত থেকে বঞ্চিত। কাজেই সবার আগে শুকরিয়া আদায় করুন।
দ্বিতীয়ত, যেই মানুষটাকে দেখে আপনার মাথা ঘুরে গেছে, যাকে মনের কথা বলার জন্য মনটা এত ছটফট করছে, যার কারণে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে, তার ব্যাপারে আপনাকে কয়েকটা তথ্য দেই। তার পেটের ভেতর মলমূত্র থাকে। সে ঘুম থেকে ওঠার পর তার মুখে দুর্গন্ধ হয়। সে গোসল না করলে তার শরীর ময়লা হয়। বেঁচে থাকলে সে একদিন বুড়িয়ে যাবে। চামড়া কুঁচকে যাবে। দাঁত পড়ে যাবে।
যেই সমস্যায় আপনি আছেন, সেই সমস্যায় ওই মানুষটাও কখনো ছিলো, অথবা এখনো আছে, অথবা ভবিষ্যতে থাকবে। কোনো মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ না। মনের এই অস্থিরতা, এই দিওয়ানাপান সবারই জীবনে আসে। আপনি যাকে দূর থেকে দেখে ভাবছেন একে না পেলে আপনি বাঁচতেই পারবেন না, সে নিজেও আসলে নানা সমস্যা-অস্থিরতায় জর্জরিত। আপনাকে দয়া করে বাঁচিয়ে তোলার কোনো সামর্থ্য তার নেই।
তৃতীয়ত, আমাদের সবার মাথায় এই জাহেলি সমাজ কতগুলো মন্ত্র ঢুকিয়ে দিয়েছে "প্রেম জীবনে একবারই হয়, ড়িয়েল লাভ একবাড়ই জীবনে আসে" ইত্যাদি। এসব মন্ত্র সব তরুণ-যুবার মাথায় ঘোরে। এই বয়সে এসে যখন কারো দিকে মন আকর্ষিত হয়, তখন ভাবে "একে পেতেই হবে", "একে ছাড়া আমার চলবেই না।" নিজেকে আর ওই মানুষটাকে সিনেমার নায়ক-নায়িকার আসনে বসিয়ে কল্পনার ডালপালা মেলতে শুরু করে। এটাতে ব্যর্থ হলে পরে "পিথিবিতে প্রেম বুলে কিচু নেই" টাইপের গান লিখতে বসে যায়।
আসল কথা হলো—আল্লাহ যে আমাদের ভেতর বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি সহজাত আকর্ষণ দিয়ে দিয়েছেন, তা যে কারো প্রতিই আসতে পারে। তালাক কিংবা বিধবা/বিপত্নীক হওয়ার পর আরেকটি বিয়ে করার বিধান ইসলামে রয়েছে। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, জীবনে একজনেরই প্রেমে পড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। একটা "প্রেম"-এ যদি ব্যর্থ হন বা একটা বিয়ে যদি ভেঙে যায়, তাহলে জীবন ধ্বংস হয়ে যায় না।
শেষ কথা, "প্রেম" করা, মনের মানুষটাকে কাছে পাওয়া এগুলো জীবনের মূল উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর ইবাদাত। হ্যাঁ, বিয়ে করা, সুসন্তান গড়ে তোলা এগুলোও ইবাদাতের অংশ। কিন্তু মনে রাখবেন, যেই আল্লাহ আপনার মাঝে জৈবিক চাহিদা সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তাঁর হুকুম-আহকামের ব্যাপারে আপনি কমিটেড থাকলে সেই আল্লাহই আপনার জন্য সঠিক সময়ে একটি কল্যাণময় ব্যবস্থা করে দেবেন। এইটুকু বিশ্বাসই যদি অন্তরে গেঁথে নিতে না পারলাম, তাহলে ঈমান আনার সার্থকতাটাই বা থাকলো কোথায়?