হ্যা, হ্যা, তোকে নিয়েই লেখা। খুব বেশি সময় নেবোনা। জানি, আজকাল বেশি বড় লেখা পড়ার ধৈর্য অনেকের হয়না। একটু মন দিয়ে পড় প্লিজ, মাত্র পাঁচটা মিনিট ধার চাইছি।

গেল বছর এপ্রিলে তোর মা মারা গেলেন যে, এইতো এর মধ্যেই আরেক এপ্রিল এলো বলে। ভাবতে অবাক লাগেনা, কীভাবে একটা বছর পার হয়ে গেলো? মানুষটাকে ছাড়াই তোর জীবন বেশ চলে যাচ্ছে! না না, তোকে কষ্ট দেয়া আমার উদ্দেশ্য না। আমি কেবল দুটো গল্প তোকে মনে করিয়ে দিতে চাই….

সেই যে ঘটনাটা মনে আছে দুবছর আগেকার? ক্লাস শেষে তোরা দুই বান্ধবী হেটে ফিরছিলি, ছোট্ট একটা এক্সিডেন্টে তুই মাথায় বেশ আঘাত পেলি, সেদিন সারা রাত আন্টি তোর পাশে বসেছিলেন, আর কাঁদছিলেন। মনে পড়ে? এই আমিইতো দেখেছি, তুই ক্লাসে আসতি, কোচিংয়ে যেতি, আন্টি সারাক্ষণ তোর সাথে সাথে ছুটে বেড়াতেন, এমনকি তোর ব্যাগটাও বেশিরভাগ সময় আন্টিই বয়ে নিয়ে যেতেন। সেই মমতাময়ী মা আর নেই। জানি, এই স্মৃতিগুলো তোকে আজও ক্ষণে ক্ষণে কাঁদায়….

এবার একটা কাল্পনিক ভ্রমণের গল্প বলি। মনে কর, আন্টি, তুই, আমি সেই আগের মত কলেজের পথ ধরে হাটছি। আন্টি পেছনে, আমরা গল্প করতে করতে সামনে এগিয়ে গেছি। হঠাৎ একটা তীব্র চিৎকার….. পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি আন্টিকে একটা মাইক্রোবাস চাপা দিয়ে চলে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের পৃথিবীটা ওলটপালট হয়ে গেলো, আমরা চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিনা, একি সত্যি দেখছি? ভাবনা চিন্তার সময় নেই, তোর হাত শক্ত করে ধরে আমি এগিয়ে গেলাম: আন্টি আধো চেতনে তোকে ডাকছেন, প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে, এক্ষণি হসপিটালে নিতে হবে। ডাক্তার জানালেন, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, বিপি একদম শকের কাছাকাছি, এক্ষণি ৪ ব্যাগ ব্লাড দিতে হবে। আন্টি কষ্ট পেয়ে গোঙাচ্ছেন, তুই পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছিস, কোথায় রক্ত পাবি। আমার হাত ধরে বললি: ‘দোস্ত, আমার মাকে বাঁচাতে হবে, মা কষ্ট পাচ্ছে, যত টাকা লাগে দেবো, জমি বিক্রি করে হলেও দেবো, প্লিজ রক্তের ব্যবস্থা কর, দোস্ত।’ তোর চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ে চলছে….

গল্পটা শেষ। তোকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেললাম, তাইনা? বিশ্বাস কর দোস্ত, সম্ভবত তোর মা এই মুহূর্তে তারওচে বেশি কষ্টে আছেন, অন্ধকার কবরে একলা একা শুয়ে হয়তো তোর পথে চেয়ে আছেন, তুই তো এখনো বেঁচে আছিস, তুই যদি কোনভাবে আন্টিকে একটু হেল্প করিস সেই আশায়! আচ্ছা, মাটির উপরে থাকতে যে মানুষটার এতটুকু কান্না আমাদের সহ্য হয়না, সেই মানুষটা দিনরাত হয়তো ভয়ংকর আগুনে পুড়ে ঝলসে চামড়াহীন দেহে তোর কাছে এতটুকু সময় ভিক্ষা চাইছেন, চিৎকার করে করে তোকে ডাকছেন, আর তুই কিনা সেই কান্নার শব্দ না শোনার ভান করে চলছিস প্রতিনিয়ত? বন্ধু, মৃত্যু সত্য, মৃত্যুর পর কবরের আযাব সত্য, এ সত্যের কোন ব্যত্যয় নেই। তোর মা কিংবা বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের একমাত্র ‘যারিয়াহ’ এখন তুই কিংবা তোরাই। তোদের করা যেকোন ভালো কাজ, যেকোন সাদাক্বাহ, যেকোন ইবাদাত, যেকোন যিকর, যেকোন দু’আ আংকেল আন্টির উপর রহমতের ঝর্ণা হয়ে বর্ষিত হয়, তাদের কষ্ট কমিয়ে দেয়, তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। বিপরীতে তোদের করা প্রতিটি হারাম কাজ (মেয়ে সন্তানদের কৃত সবচে কমন কবীরা গুনাহ ও হারাম কাজ হচ্ছে বেপর্দা চলাফেরা করা), প্রতিটি গুনাহের কাজ উনাদের উপর আযাব হয়ে বর্ষিত হচ্ছে। চিন্তা করতে পারিস? আন্টিকে জীবিত অবস্থায় কেউ আগুনে পোড়াচ্ছে, আন্টি চিৎকার করে সাহায্য চাইছেন, তুই গিয়ে আরও এক বোতল পেট্রোল নিয়ে আন্টির গায়ে ঢেলে দিলি। তুই হয়তো বলবি, অসম্ভব। কিন্তু আমিতো দেখছি তুই এই অসম্ভবটাকে সম্ভব করে চলেছিস প্রতিদিন, প্রতিরাত….!

এইতো কদিন বাদেই আবার মাদারস’ ডে। তুই এরপরও সেদিন ফেবুতে পোস্ট দিয়ে বলতে পারবি?

“তোমায় বড্ড মিস করি, মা! ভালোবাসি।”

আরও একটা ছোট্ট সত্য স্মরণ করিয়ে দিই: এই যে তোর মা’কে ছাড়াই তুই চলতে পারছিস, পৃথিবীর কিচ্ছু থেমে নেই, আমি কিংবা তুই আজ মারা গেলেও ঠিক এমনটাই হবে, সবচে কাছের মানুষটাও একসময় ভুলে যাবে। আমাদের সাথে কবরে যে জিনিসটা যায়, তার নাম ‘আমল’। আন্টি চলে গেছেন, আমরাও যাবো, এই সত্যের কোন ব্যতিক্রম নেই, হয়তো কিছু সময়ের ব্যবধান, আমাদের ছেলেমেয়েরাও আবার তাদের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। দুনিয়ার এই অল্প কদিনের জীবনে আল্লাহর ভয় ও ভালবাসায় করা কাজটুকুই কেবল আমার ‘সঞ্চয়’ হিসেবে আমার সাথে যাবে, বাকি সবকিছু এপারেই অন্য কেউ ভোগ করবে। হ্যা, আমার সবচে কাছের জীবনসঙ্গীটিও হয়ে যাবে অন্য কারও। ভালো ছাত্র তো সে-ই, যে পরীক্ষার আগেই প্রস্তুতি নিয়ে হলে ঢুকেছে। বুদ্ধিমান তো সে-ই, যে মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, বৃদ্ধ বয়সে হজ্জ্ব করে এসে মৃত্যুর প্রস্তুতি নিবে বলে ভাবে অনেকেই, কিন্তু সেই সময়টা হাতে পায় ক’জন? পেলেই বা কাজে লাগাতে পারে ক’জন? বান্ধবী, নীড়ে ফেরার আজই সময়। বিশ্বাস কর, আমি একটুও মিথ্যে বলছি না, আমি যা বলছি তারচে সত্য আর নেই……


September 22, 2019