মুসলিমদের একটি সাধারণ গুণ হলো কোনো একটি বিষয় নিয়ে সাধারণের ঊর্ধ্বে গিয়ে ক্রিটিকাল চিন্তা করার শক্তি। একটি চিন্তা যার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সেখানে কোনোভাবেই গড়মিল করা যাবে না।
আর এই গড়মিলগুলোকে যে জ্ঞান ফিল্টার করে দেয় তার একটির নাম হলো যুক্তিবিদ্যা। এই বিদ্যা আমাদেরকে নানান রকম লজিক্যাল ফ্যালাসিমুক্ত চিন্তা উপহার দিতে সক্ষম। ফ্যালাসি অনেক রকম হতে পারে। তার ভিতর আজ আমরা সংক্ষেপে ধারণামূলক অপযুক্তি বা Fallacy of Assumption সম্পর্কে জানব।
এই ফ্যালাসিযুক্ত বাক্যে সাধারণত এমন কিছুর উল্লেখ থাকে যা কিনা বক্তার ধারণার উপর গড়ে ওঠা।
ধরা যাক, রিক্সায় উঠে আমি বৃদ্ধ চালককে বললাম, “চাচা আপনার নাতি-পুতি কয়জন?”
শুনে স্বাভাবিক মনে হলেও প্রশ্নটি আমার ধারণাপ্রসূত। এই প্রশ্ন করার অর্থ হলো—
[১] চাচা বিবাহিত। (দেশি কনটেক্সটে)
[২] চাচার সন্তান হয়েছে।
[৩] সেই সন্তানের বিয়ে হয়েছে। (দেশি কনটেক্সট)
[৪] সন্তানের সন্তান হয়েছে।
[৫] তাই প্রশ্ন হলো সেই সন্তান কয়জন।
তাহলে দেখুন এখানে মূল প্রশ্নের আগে ৪টি প্রস্তাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন শুনে কতই না স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। অথচ সবগুলোই আমার ধারণা। পুরো বাক্য একটি ভবনের মতো যার শুরু ১ আর শেষ হলো ৫। যে কোনো এক তলা ভুল প্রমাণিত হলে সেটি সমেত এর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সবগুলো ভেঙে পড়বে। যেমন: যদি চাচা বিয়েই না করে থাকে তাহলে বাকি প্রস্তাবনাগুলোর আর কোনো অস্তিত্বই থাকে না। তাই সেগুলো খণ্ডনেরও প্রয়োজন নেই। এই হলো সহজ উদাহরণ। আশা করি পরিষ্কার হয়েছেন। তাহলে একটি পরীক্ষা হয়ে যাক? দেখি কেমন যুক্তিবিদ্যা শিখে গেলেন আজ।
যেহেতু আমরা মাত্র শিক্ষা করছি, তাই একটি ছড়া দিয়ে শুরু করা যাক—
“যদি বেঁচে যাও এবারের মতো, যদি কেটে যায় মৃত্যুর ভয়,
জেনো বিজ্ঞান লড়েছিল একা, মন্দির-মসজিদ নয়।”
দেখুন, “বিজ্ঞান লড়েছিল একা, মন্দির মসজিদ নয়।” সুন্দরমত এখানে ধারণামূলক অপযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে। কীভাবে? চলুন ঢেলে সাজানো যাক। এখানে ব্যবহৃত ধারণাগুলো হচ্ছে—
[১] বিজ্ঞান অনেক কিছুর সাথে লড়ে। (যেমন: করোনার সাথে লড়ছে)
[২] মন্দির-মসজিদকেও লড়াইয়ের জন্য তৈরি করা হয়েছে। (তাই করোনার সাথে লড়াই করার কথা।)
[২.১] (আক্ষরিক অর্থ বাদ দিলে) মানুষকে বাঁচানোর জন্য বিজ্ঞানের মতো ঔষধ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের স্থান হলো ধর্মীয় প্রধান উপাসনালয়।
[৩] কিন্তু মন্দির-মসজিদ সেই লড়াই করছে না।
[৪] তাই বিজ্ঞান একাই লড়ছে।
আসল প্রশ্নের আগে ৩টি প্রস্তাবনা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। দেখি সেগুলোর যথার্থতা কতখানি।
এখন,
১ম তলা ঠিক আছে।
২য় তলা সঠিক নয়। মসজিদের এ ধরনের ব্যবহার বর্তমানে প্রচলিত নয়। তাই ২য় তলাকে আমরা বুল ডোজার দিয়ে ভেঙে দিলাম।
ফলে ৩য় ও ৪র্থ তলা আপনা-আপনি ধ্বসে পড়ল।
যে জিনিসকে যার জন্য তৈরিই করা হয়নি তার সাথে তুলনা কীভাবে সম্ভব? কালকে যুদ্ধ বেঁধে গেলে কেউ যদি আমাদেরকে বলে, “যদি বেঁচে যাও এবারের মতো, যদি কেটে যায় মৃত্যুর ভয়, জেনো আর্মড ফোর্স লড়েছিল একা, স্মৃতিসৌধ নয়।” বলুন, স্মৃতিসৌধের কাজ কি যুদ্ধ করা? সামরিক বাহিনী আর সৌধ নির্মাণের উদ্দেশ্য কি এক? এটাকে বলে ক্যাটাগরিকাল মিসটেইক।
ইসলামের ক্ষেত্রেও এই ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে শরীয়তের জ্ঞান না থাকায়। একে দ্বীন মনে না করে ধর্ম মনে করায়। এজন্য এটুকু পর্যন্ত করা আলোচনা সকল ধর্ম তাদের স্বপক্ষে পেশ করতে পারবে। কিন্তু বাকি অংশে কেবল ইসলামই প্রবেশ করতে পারবে।
শরীয়তে মোরাল, সেরেমোনিয়াল, জুডিশাল কোডসহ বিভিন্ন বিধান আছে। কিন্তু ছড়ার মাঝে বিজ্ঞানের বিপরীতে শরীয়াতের সব কোড বাদ দিয়ে শুধু সেরেমোনিয়ালকে বেছে নেওয়া হয়েছে যেখানে ইসলাম বলতে শুধু তাওবা, সালাত-সাদকা, সকাল-সন্ধ্যার দুআ, রোগ ও অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার দুআ, আল্লাহর জিম্মায় থাকার আমল, নির্ধারিত যিকির-আযকার ইত্যাদি বোঝানো হয়।
এদিকে জুডিশাল কোডের মাঝে ব্যবহারিক আইন থাকে। তাই এর মাঝে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও বিদ্যমান। কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, হাত ধোয়া, ইমিউনিটি বাড়ানোর সুন্নাতি খাদ্য গ্রহণ, প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা ইত্যাদি।
প্রশ্ন হতে পারে যুক্তিবিদ্যার সেশনে লেখক আবার বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে ধর্মের নামে চালিয়ে দিচ্ছে না তো? মোটেই নয়। যেখানে টেকনিকাল কোয়ারেন্টিনের সূচনা হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে আর রাষ্ট্রীয়ভাবে নীতি কার্যকর হয় ১৯২১ সালে এসে সেখানে সমাধান হিসাবে ইসলাম এগুলো মধ্যযুগেই কার্যকর করেছিল।
[i] Lock Down: কোনো ভূখণ্ডে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার খবর শুনতে পেলে সেখানে প্রবেশ করা যাবে না। পক্ষান্তরে তা যদি নিজের অবস্থানস্থল পর্যন্ত পৌঁছে যায় তাহলে ওই জায়গা ত্যাগ করা যাবে না। [বুখারী ৫৭২৮ দ্র]
[ii] Isolation: অসুস্থ দ্বারা সুস্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। [আবু-দাঊদ ৩৯১১ দ্র]
[iii] Quarantine: বাঘ থেকে মানুষ যেরকম দূরে থাকে, সংক্রামক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি থেকে সেরকম দূরে থাকা। [বুখারী ৫৭০৭ দ্র]
তাহলে প্রতিরোধ সেক্টর হলো এই জুডিশাল কোডের অন্তর্ভুক্ত। কাজেই বিজ্ঞানের সাথে তুলনা করতে হলে এই কোডের সাথে করতে হবে। মসজিদকে টেনে এনে সেরেমোনিয়াল কোডে ঢুকে কুযুক্তি উৎপন্ন করলে তা গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
কাজেই, আলোচ্য ছড়াটি বিজ্ঞান এবং যুক্তির গণ্ডী ছেড়ে সাহিত্যের কল্পনা রাজ্যে চলে গিয়েছে। উলটো এধরনের কথা-বার্তা বিজ্ঞানের জন্য অসম্মানজনক। কারণ শুরুতেই লিখেছে, “যদি বেঁচে যাও এবারের মতো।” মানে এবার বিজ্ঞান আছে দেখে বেঁচে যাওয়া যেতে পারে। তাহলে প্রশ্ন হলো যখন আধুনিক বিজ্ঞান ছিল না তখন মানুষের জন্য কে লড়াই করেছে? যেমন ১৪০০ বছর আগে? প্রাকৃতিক বিজ্ঞানহীন যুগ আসলেও, নির্দেশনাহীন (ওহী) যুগ কোনোকালেই আসেনি।
ভুল যেহেতু শুধরানোই হচ্ছে তাহলে আরেকটি ভুল শুধরে ক্লাস শেষ করে দিই,
“কোনো ধর্মগ্রন্থে করোনা দমনের উপায় বলা থাকলে তা এখনই জানিয়ে দিন, ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের পর গল্প বলে লাভ নেই।” বলুন তো কথাটি আত্মসাংঘর্ষিক কি না? এই যে কৌশলগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো এগুলো তো মহামারী দমনেরই কৌশল। নাকি শুধু ভ্যাক্সিন ছাড়া আর কিছু দিয়ে তা দমন করা যায় না? এযুক্তিও তো বিজ্ঞানের সামনে টেকে না। যা এখনো আবিষ্কারই হয়নি তা নিয়ে কথা বলছি অথচ এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ কৌশলের পুরোটাই যে ইসলামপন্থী এটি কেন এড়িয়ে যাচ্ছি? এটি স্বীকার করে নিলে তো আর বিজ্ঞান মিথ্যা হয়ে যায় না। বিজ্ঞান তো কোনো সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র সম্পত্তি নয়। তাহলে করোনার দমনের উপায় তো বলা হলোই, সাথে কুযুক্তি ও অপবিজ্ঞান দমনের উপায়ও শেখা হলো।
এই সুযোগে আরেকটি হাদিস জানিয়ে দিই,
“তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো, কেননা মহান আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি।” [আবু দাঊদ]
তাহলে এই চিকিৎসা গ্রহণের দায়িত্ব কার? আর এই প্রতিষেধকটাই বা কে আবিষ্কার করবে? উপাদান আল্লাহ প্রকৃতিতে দিয়ে রেখেছেন। তাহলে হাদিসে বিশ্বাস করলে তো চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া সম্ভব যে করোনার প্রতিষেধক আছে এবং তা খুঁজে বের করা মানুষের দায়িত্ব ও পুরোপুরি ফরযে কিফায়া। অর্থাৎ কেউ এই জ্ঞান অর্জন না করলে সবার উপর তা ফরয হয়ে যাবে। এই যে ওহী থেকে গাইডেন্স নিয়ে সেইদিকে গাইডেড হবার যে মূলনীতি এটা বুঝলে কিন্তু অনেক উত্তর মিলে যাবে। কাজেই বিজ্ঞানের প্রতি গোটা জাতিকে অনুপ্রাণিত করছে কোন দ্বীন?
বুদ্ধিচর্চায় অগ্রগামী হওয়া আমাদের মুসলিম জাতির একটি বৈশিষ্ট্য। উপকারী ইল্ম অন্বেষণ করে মানবজাতির সেবা করা সম্ভব। সেবা মানেই আখিরাতে নিশ্চিত পুরস্কার। এই আখিরাত চিন্তাই মুসলিমদেরকে সদা দুনিয়াবি সমৃদ্ধির পথ খুলে দিয়েছে। অসংখ্য উপকারি বিদ্যা আবিষ্কার ও তার চর্চা করেছে। কিন্তু যখন থেকে এ জাতি আখিরাত ভুলে গেছে, তারা লক্ষ্যচ্যুত হয়ে দুনিয়াতেও আছড়ে পড়েছে। বিজ্ঞানের উত্তর বিজ্ঞান দিয়ে দিতে হবে, দর্শনের উত্তরে দর্শন। আর এ সবই ইসলামের অংশ। ইসলাম এক্সক্লুসিভলি কোনো ধর্ম নয়। ধর্ম এটার অংশ মাত্র।