বেশ্যা বা পতিতার পেশা হারাম, তা আমরা সবাই জানি। তবু অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এদের প্রতি আমাদের মনে আলাদা করুণা কাজ করে। সুদের ব্যাপারীদের ক্ষমতার কারণে যেরকম সমীহ করা হয়, সেরকম সমীহ না; করুণা।

স্বভাব বা কাজকর্মের কারণে কাউকে বেশ্যা বলে গালি দেওয়া হয় ঠিকই। কিন্তু বাস্তবে পেশাগতভাবেই যারা বেশ্যা, তাদের প্রতি আমাদের মনোভাব মোটাদাগে ভিন্নরকম। কারণ আমরা সবাই জানি যে, একটা মেয়েও স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসেনি। সবাই কোনো না কোনো পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে এই অন্ধকার জগতে আটকে গেছে।

এদের পেশার একটা পলিটিক্যালি কারেক্ট নামও দেওয়া হয়েছে। যৌনকর্মী বা সেক্সওয়ার্কার।

তারপরও এরকম নর্মালাইজ করার একটা নেতিবাচক দিক আছে। পাপীকে ভালোবাসার অজুহাতে মানুষ একসময় পাপকে ভালোবাসতে শুরু করে। এই দুটোর মাঝে সীমানাটা খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশেষত "পাপীকে ভালোবাসা"র বিজ্ঞাপনদাতা যদি হয় কুফফার ও তাদের এনজিওরা।

পেছনের গল্প খুঁজতে গেলে তো সবারই কোনো না কোনো জাস্টিফিকেশান আছে। চোখে পানি আনা গল্প আছে। চোর বা ডাকাতরাও কি স্বেচ্ছায় চোর-ডাকাত হয়েছে? হয়তো সলিম মিয়াঁ তার অনাহারী মায়ের নীরব কান্না সহ্য করতে না পেরে চুরি করা শুরু করেছে। হয়তো নিমাই চন্দ তার এলাকার প্রভাবশালীদের অত্যাচারে গৃহহীন হয়ে পরে ডাকাতদলে যোগ দিয়েছে। এখন কি তাদের পেশাকে গণহারে ভালোবাসতে হবে? চৌর্যকর্মী বা লুণ্ঠনকর্মী এরকম পলিটিক্যালি কারেক্ট নামে ডাকতে হবে?

এটার উত্তরে ওই সেকেলে যুক্তিই শোনানো হবে। চোর-ডাকাত তো 'আমার' ক্ষতি করছে। যৌনকর্মী তো 'আমার' ক্ষতি করছে না। ওদের খদ্দেররা নিজে থেকেই ওদের কাছে যায়।

আচ্ছা ড্রাগ ডিলারদের খদ্দেররাও তো নিজে থেকে ওদের কাছে যায়। তো ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ক্রসফায়ারে মেরে ফেলে কেন? সে যাকগে। মূল কথা সেটা না। মূল কথা হলো এই "আমি"-কেন্দ্রিক নৈতিকতার শেষ কোথায়? সরাসরি "আমার" ক্ষতি হচ্ছে না বলেই কি একটা অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দিতে হবে?

পাপের এই গ্রহণযোগ্যতা এক জায়গায় থেমে থাকে না। পতিতাদের তো বলা হচ্ছে 'কর্মী'। পর্নোগ্রাফির সাথে জড়িতদের বলা হয় 'শিল্পী' বা 'তারকা'। পর্নশিল্পী, পর্নস্টার। মুভি নামক সবচেয়ে দামী পর্নগুলোর কথা তো বলাই বাহুল্য।

পাপের এই গ্রহণযোগ্যতাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্য মুসলিম সমাজ কিছু মূলনীতি মেনে চলে। মামলা-মোকদ্দমায় ফাসিক বা প্রকাশ্য পাপাচারী মুসলিমদের সাক্ষ্য নেওয়া হয় না। তাদের জানাযায় নেতৃস্থানীয় ও গণ্যমান্য আলেম-ইমামরা অংশ নেন না। তবে সাধারণ মুসলিমরা তার জানাযা পড়ে নেয়। পাপকে সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিতও করা হলো, আবার মুসলিম হিসেবে একটি অধিকারও (মৃত্যুর পর জানাযা পাওয়া) আদায় করে দেওয়া হলো। {ভিন্নমতও আছে, যেমন আদৌ জানাযা না পড়ানো। সেটা শাস্ত্রীয় আলাপ, আমাদের জ্ঞানের আওতার বাইরে}

[মুসলিমদের নেতা একটি অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত আছেন, কিন্তু সাধারণ মুসলিম জনতা সেটা পালন করেছে—এরকম প্রচুর উদাহরণ সীরাতে আছে। সেগুলো আলোচনা করতে গেলে প্রসঙ্গ সরে যাবে।]

দেখুন, প্রকাশ্য পাপাচারী হওয়ার অর্থ এই না যে, সে কাফির। পাপাচারীকে কাফির মনে করাটা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী খারেজিদের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সঠিক মত হলো ঈমান ঠিক রাখলে, হালালকে হালাল আর হারামকে হারাম বলে 'বিশ্বাস' করলে পাপাচারী ব্যক্তিও মুসলিম থাকে।

বেশ্যা যদি বিশ্বাস করে বেশ্যাগিরি হারাম, সে মুসলিমা। নেকাবি যদি বিশ্বাস করে এইসব পর্দা-টর্দা পুরুষদের চাপানো বোঝা, সে তার সমস্ত বোরকা-নেকাব সত্ত্বেও কাফিরা। মুসলিমা বেশ্যা কখনও আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করালেও তা তার সব গুনাহর চেয়ে মীযানে ভারি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু নেকাবি মুরতাদ কখনও পূর্ণ তওবা করা ছাড়া মাফ পাবে না।

সেইসব অদেখা বিষয়ের বিচার অদেখা আল্লাহর হাতে। দৃশ্যমান জগতে ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমরা দৃশ্যমান জিনিসের ভিত্তিতেই বিচার করি।

তো এত বকবক না করে হুজুররা কি যৌনকর্মীদের পুনর্বাসন করে দিতে পারে না? ব্যক্তিগতভাবে পারে না। কারণ হুজুররা একটা গাড়িতে চড়লেও অনেকের চুলকাতে চুলকাতে ধুতি ছিঁড়ে যায়।

তবে সামষ্টিকভাবে পারত। কওমি মাদ্রাসা এ দেশের সবচেয়ে বড় এনজিও। লাখ লাখ অনাথ ছেলেমেয়ের আশ্রয়স্থল। আগাছা ভেবে সমাজ যেসব চারা ফেলে দেয়, তাঁরা সেগুলো তুলে এনে রোপণ করেন। লজ্জার মাথা খেয়ে আপনাদের কাছে হাত পেতে যাকাত-ফেতরা চান। তাই দিয়ে চারাগুলোকে বড় করেন। আরো কয়েক হাজার কামিনী গাছকে আশ্রয় দিলেও তাঁদের রিযিকে টান পড়বে না ইনশাআল্লাহ।

কিন্তু সমস্যা তো সেখানে না। উচ্ছেদ আর পুনর্বাসন (বিয়ে করার মাধ্যমে) এর কথা হুজুররাই তোলে। তখন কোনো এক অজানা কারণে ঘাউ ঘাউ করে তেড়ে আসে ওই সেকুলাঙ্গার রুই-কাতলাগুলোই। এরপরে হুজুরদের আর কীইবা করার থাকে?


16/02/2020, 20:51