জবুথুবু হয়ে শুয়ে ছিলাম, ছোট্ট একটা ছেলের কথার খইয়ে ঘুম ভাঙল। নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমট্র্যাকের ৩০ ক্যাপিটল লিমিটেডের ট্রেনে। সকালে ফজরের সলাত শেষে দেখেছিলাম পিটসবার্গ পার হচ্ছি। এখন নাম না জানা কোন এক জঙ্গলে বসে আছি, সামনে রেললাইনের কি যেন সমস্যা হয়েছে, আধ ঘন্টা বসে থাকতে হবে। আমেরিকাতে সাধারণত কেউ রেলে চাপেনা। আমি ভাবলাম জাহাজ, প্লেন সবই যখন চড়া হল তাহলে আর দ্বোতলা এসি ট্রেন বাদ থাকবে কেন। এতে অবশ্য আমার ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষেরা আপত্তি করবে, তাদের মতে আমি টাকা বাঁচানোর জন্য এ কাজ করেছি। আমি টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করি কথাটা নেহায়েত মিথ্যা না, কিন্তু আজ সকালে যে অসাধারণ কিছু দৃশ্য দেখেছি, উড়ে আসলে কি সেগুলো দেখতে পেতাম? আমার ঘনিষ্ঠ মানুষেরা এ ব্যাপারগুলো বোঝেনা, তারা খামোকাই আমাকে কিপটা বলে খোঁচাখুঁচি করে। এ তালিকায় শেষ যুক্ত হয়েছে সুদীপ্ত। সুদীপ্ত শরীফ।


আসার সময় যখন ব্যাগ গুছাচ্ছি, তখন ছেলেটা পাগলের মত যা পাচ্ছে সেটাই ব্যাগে ভরে দিচ্ছে। আমার সুপারভাইজর মুস্তাফা স্যার ওকে শনপাপড়ি খেতে দিয়েছিলেন – সেটাও সে আমার সুটক্যাসে ভরে দিল। বললাম, ভাইয়া আমি শনপাপড়ি খাইনা। উত্তর দিল, আপনি খান না তো ভাল – ভাবী খাবে। স্যার বললেন, মানুষ বাংলাদেশ থেকে শনপাপড়ি কিনে আমেরিকাতে আনে। সুদীপ্ত নির্লিপ্তমুখে বলল, শরীফ ভাই জীবনে কিনবে? এ ধরণের কথা বলতে হলে মানুষের কাছে আসতে হয়। সব মানুষ কাছে আসেনা। মানুষের কাছে আসার গুণটা সবার থাকেনা। আসার আগে যখন ছেলেটা হঠাৎ করে বলে ফেলল, “শরীফ ভাই, আপনি মনে করিয়েননা যে আপনি চলে যাচ্ছেন বলে আমি কাঁদব,” তখন ধাক্কা খেলাম। আমি খুব কাট্টাখোট্টা, হিসেবী মানুষ – আবেগ থেকে যথাসাধ্য দূরে থাকি। এ ধরণের কথার কোন আসর আমার উপরে পড়ার কথা না, কিন্তু এবার কেন যেন পড়ল।


কোন একদিন রাত এগারোটায় সুদীপ্তের বাসায় ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম ইশার নামায পড়েছ? বলল – ওয়াক্ত তো মাত্র হল। আমি বললাম – আমার জন্য অপেক্ষা কর, একসাথে পড়ব। এগারোজ জেল রান শেষে ইউভি রশ্মিতে ছবি তুলে আবিষ্কার করলাম – কিচ্ছু নেই। তার মানে এবারও আরটি পিসিআর (Reverse transcriptase polymerase chain reaction, কোন নির্দিষ্ট একটি আরএনএ অণুর উপস্থিতি বোঝার জন্য ব্যবহৃত হয়) কাজ করেনি। হতাশ মনে সাইকেল চালিয়ে গেলাম ওর বাসায় গিয়ে পৌছাতে পৌছাতে রাত একটা। সলাত শেষে ছেলেটা ভাত বেড়ে দিল, তরকারী গরম করে দিল। দু’জন একসাথে খেয়ে নিলাম। এ ধরণের ঘটনা বহুবার ঘটেছে। রিসার্চের শেষদিকে যখন দিন-রাত এক করে ফেলেছি তখন আল্লাহর রহমতে সুদীপ্তের কল্যাণে ঘরে রান্না নেই বলে চিন্তা করতে হয়নি। আমার একা একা খেতে খুব খারাপ লাগে। সুদীপ্ত প্রথম প্রথম বাংলাদেশ থেকে আসার পরে ওকে রান্না শেখানোর উসিলায় প্রায়ই আমি ডাইনিং টেবলের সঙ্গী জুটিয়ে নিতাম। খাওয়ার পরে চলত আলোচনা – ট্রানজিশন ধাতুগুলো কেন একেকসময় একেক রঙ দেখায়, উপমহাদেশ আর আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য কী, বার্মাতে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা… আর কথা চলত ইসলাম নিয়ে। আমি শিক্ষক মানুষ, ছাত্র পেলে খুশী হই। যখন দেখি আমার কথা শুনে কারো ইসলামের প্রতি আগ্রহ এসেছে, সে ইসলাম কি সেটা জানতে, বুঝতে চেষ্টা করছে, মানার চেষ্টা করছে – তখন আমার আনন্দ ধরেনা।


কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসা একে অপরের পড়শী। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাই তাঁর প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়। যেসব মানুষের মধ্যে ন্যূনতম সৌজন্যতাবোধ অবশিষ্ট রয়ে গেছে তারা উপকৃত হলে প্রত্যুত্তরে অন্য কিছু না দিতে পারলেও মনে মনে উপকারীকে ভালবাসে। কিন্তু আমাদের মুসলিমদের জন্য ভালবাসার সংজ্ঞাটা একটু অন্যরকম। আমরা যারা আল্লাহকে ভালবাসি, তারা শুধু আল্লাহকে ভালবাসার কারণে একে অপরকেও ভালবাসে। এই ভালবাসা এমন একটা ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে দেয় যেটা অনেক সময় রক্তের ভ্রাতৃত্ববোধের থেকেও বড় হয়ে যায়। ইসলামের প্রাথমিকযুগের মুহাজিররা ঘর-বাড়ী-সহায়-সম্পদ ছেড়ে যখন মদিনাতে হিজরত করেছিলেন তখন আনসার সাহাবারা নিজেদের দু’টো ঘরের একটা ঘর কিংবা খেজুর বাগানের অর্ধেক দিয়ে তাদের সাহায্য করেছিলেন। আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসার সুবিধেই হল এটা যে এর প্রতিদান আমরা আল্লাহর কাছে চাই বিধায় এই ভালবাসাটা কখনও ব্যর্থ হয়না। একজন মুসলিমকে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসা মানে আল্লাহর আনুগত্যে একে অপরকে সাহায্য করা, আল্লাহর নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে একে অপরকে সচেতন রাখা।


বাংলাদেশ থেকে আসার পর সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারটা কষ্ট দিত তা হল মসজিদে জামাতে সলাত না আদায় করতে পারা। এক বছরের জন্য জামাতে ২৭গুণ সাওয়াবের বদলে বিদেশে উচ্চশিক্ষাটাকে যে আমি বেছে নিয়েছি সেটা মনে একটা ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল। প্রায়ই মনে হত দ্বীন আর দুনিয়া – এ দুটোর মধ্যে আমি দুনিয়াকে বেছে নিয়েছি। তাই এখানে কারো সাথে জামাতে সলাত আদায় করতে পারলে সেই ক্ষতের কিছুটা উপশম হত।

আমি সুদীপ্তের কাছে কৃতজ্ঞ – আমার একাকিত্বে সঙ্গ দেবার জন্য, তার রিযক আমার সাথে ভাগ করার জন্য, বাসা ছেড়ে দেয়ার পর আমাকে থাকতে দেবার জন্য, মানুষের মধ্যে যে সারল্য হারিয়ে যায়নি সেটা প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু কৃতজ্ঞতার লম্বা তালিকার কাজগুলো কোন কিছুই যদি সে না করত, তাও আমি তাকে ভালবাসতাম। সে ভালোবাসার পিছনে একটা কারণই যথেষ্ট। সে আমাকে আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে সাহায্য করেছে, সে আমার সাথে জামাতে সলাত পড়েছে। আল মিক্বদাম বিন মা’দি আল কারিব থেকে বর্ণিত যে রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যদি কেউ তার ভাইকে ভালবাসে সে যেন তাকে জানিয়ে দেয়।” (সুনানে তিরমিযি, হাদিসটি হাসান সহীহ)

আমার এই লেখাটা সুদীপ্তকে জানানোর জন্য যে – আনা উহিব্বুক ফিল্লাহ। আমি তোমাকে আল্লাহর জন্য ভালবাসি। আল্লাহ যেন তোমার বুকটা তার দ্বীন বোঝার মত প্রশস্ত করে দেন। তিনি যেন তোমাকে ইহকাল এবং পরকালে সাফল্য দান করেন।

আর আমার মত অধমকে যদি কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবেসে থাকে তার জন্য দু’আ – আহাব্বাকাল্লাযি আহবাবতানি লাহু, যার উদ্দেশ্যে তুমি আমাকে ভালবাস, তিনি যেন তোমাকে ভালবাসেন। (আবু দাউদ ৪/৩৩৩)

এই পৃথিবীতে আল্লাহর ভালবাসার চাইতে বড় পাওয়া আর কি আছে।

২২শে রমাদান, ১৪৩৩ হিজরি
মেরীল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র।