আজকালকার বাচ্চার মায়েদের একটা বড় কনসার্ন থাকে, এবং খুবই ভ্যালিড একটা কনসার্ন—কীভাবে বাচ্চাদের স্ক্রিন টাইম কমাব? আমি অন্যদের কথা জানিনা, তবে নিজের তিন বাচ্চা এবং বোনের দুই বাচ্চাকে দেখাশোনা করার অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা বলতে পারি—বাচ্চাকে ভালো সঙ্গ দিতে হবে। সঙ্গ দিলে বাচ্চারা স্ক্রিন টাইমের কথা ভুলে যাবে। বিশ্বাস করুন, ওরা কার্টুন দেখার কথা মুখেও আনবে না।
আমি বাচ্চাদের ছোটবেলাতেও, যখন বয়স হয়ত দুই-আড়াই বছর, কার্টুনের বদলে বই এবং গল্প শুনিয়ে ট্রাই করেছি৷ এবং সেই চেষ্টা কাজেও দিয়েছে, ওদেরকে বাবা-মা সঙ্গ দিলে সত্যি ওদের কার্টুন দেখার নেশা থাকে না। কিন্তু বাস্তবিক ভাবে একজন বড় মানুষ, একটা বাচ্চাকে সারাদিন সঙ্গ দেবে, এন্টারটেইন করবে, এবং একটার পর একটা গল্প শোনাবে, বাচ্চাদের মতো পুতুল বা গাড়িঘোড়া দিয়ে খেলবে—এটা আল্লাহ তা'আলা আমাদের নেচার এবং সামর্থ্যের মধ্যে দেন নি। আমি একজন ফুলটাইম মা। তবুও আমার পক্ষে সম্ভব না বাচ্চাকে নিয়ে সারাদিন খেলাধুলো করব আর বই পড়ে শোনাব। কেননা চব্বিশ ঘণ্টাই কমবেশি বাচ্চার আরো অনেক প্রয়োজন আমাকে দেখতে হয়, বাচ্চার জন্য একটা ফাংশনিং সেইফ হোম নিশ্চিত করার জন্য মা হিসেবে আমার উপর আরো অনেক দায়িত্ব থাকে।
বাচ্চার খাবার তৈরি করা, কাপড় ধোয়া, মেলা, গুছিয়ে জায়গায় রাখা, ঘর পরিষ্কার রাখা, খেলনা সর্টিং, বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় শপিং ইত্যাদি। এগুলো তো পর্দার পেছনের কাজ। এর পাশাপাশি বাচ্চার সাথে অ্যাক্টিভ টাইম কাটানোর ব্যাপারটা তো আছেই। বাচ্চাকে কোলে রাখা, বডি মাসাজ দেয়া, হাকু-হিসু-ন্যাপি চেইঞ্জ, কাপড় পরানো৷ বাচ্চার সাথে খেলা, গল্প শোনানো, খাইয়ে দেয়া, ঘুম পাড়ানো ইত্যাদি। এবং এরপরেও একজন মায়ের নিতান্ত নিজস্ব বেসিক কিছু কাজ রয়েই যায়, যেমন - নামাজ-ঘুম-খাওয়া ইত্যাদি৷ আর তার উপর ঘর-সংসারের কাজ, রান্নাবান্না ও অন্যান্য দায়িত্ব তো থাকেই। চিন্তা করে দেখুন, এতগুলো কাজের পরে ঠিক কত পার্সেন্ট টাইম বাচ্চাকে "পিওরলি এন্টারটেইন" করা সম্ভব? এমনভাবে এন্টারটেইন করতে হবে, যেন বাচ্চা "ঘ্যানঘ্যান" না করে, যেন বাচ্চা আনন্দে থাকে, খুশি থাকে, উৎফুল্ল থাকে? কতক্ষণ সম্ভব?
আসলে কাজটা প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে তাদের জন্যে যাদের সাপোর্ট সিস্টেম বেশ লো। বাসায় কাজের লোক নেই কিংবা একা থাকতে হয়। ইভেন আমি দেখেছি, যৌথ পরিবারে থাকলেও অনেক মেয়েই সন্তানদের জন্য তেমন একটা সাপোর্ট সিস্টেম পায় না। কেননা শাশুড়ি হয়ত বয়সজনিত কারণে অসুস্থ থাকেন কিংবা তাদের উপরেও সংসারের অন্যান্য দায়দায়িত্ব থাকে। আবার, বাবাদের কাছেও আশা করা যায় না তারা খুব বেশি বাচ্চা দেখবেন। এমনকি একজন সাপোর্টিভ স্বামীও কত পার্সেন্ট টাইম বাসায় থাকেন? কতক্ষণ বাচ্চা দেখতে পারেন? তাকেও নিশ্চয়ই অফিস বা ব্যবসা সামলাতে হয়।
প্যারেন্টিং কোর্সগুলোতে দেখবেন বলা হচ্ছে, বাচ্চাকে সময় দাও। সঙ্গ দাও। অ্যাটেনশন দাও। কথা বলো। বই পড়ে শোনাও৷ অথচ এতগুলো লম্বা লিস্ট অফ রেস্পন্সিবিলিটির চাপে পড়ে মায়েদের নাস্তানাবুদ দশা। বিকজ তারা নিজেরাই টায়ার্ড, নিজেরাই বিধ্বস্ত, নিজেদেরই একটু অবসর ও বিশ্রামের দরকার। ছোট বাচ্চার মায়েদের ফোন করলে, অথবা বাচ্চা আছে এমন কোনো আপা/ভাবির সাথে গল্প করতে গেলে দেখবেন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাচ্চাদের ঘ্যানঘ্যান বা কান্নাকাটি। তারা ক্রমাগত মায়েদের অ্যাটেনশন চাচ্ছে। আর মায়েরা বলছে, যাও তো একটু খেলো। যাও তো ছবি আঁকো।
একজন বড় মানুষের পক্ষে একটা বাচ্চাকে পিওরলি এন্টারটেইন করে যাওয়া অত্যন্ত টায়ারিং। একজন ফুলটাইম মায়ের জন্যেও যেখানে বাচ্চাকে রাতদিন নিরবিচ্ছিন্ন অ্যাটেনশন দেয়া প্র্যাকটিকালি ইম্পসিবল, সেখানে কর্মজীবী মায়ের জন্য কতটা সম্ভব ধারণা করা কঠিন কিছু নয়। তারা যতই "কোয়ালিটি টাইম" দেয়ার কথা বলুক না কেন, বাস্তবে দেখা যায় খানিক বাদেই নিজেরা ফোন চাপছে আর বাচ্চাকে বলছে, যাও বাবু, তোমার স্টিকার বুকটা নিয়ে খেলো, একটু কার্টুন দেখো। অনেকে বাচ্চাসহ নিজের এন্টারটেনমেন্ট নিশ্চিত করতে সারাদিন টিভি ছেড়ে রেখে দেয়। এসব দৃশ্য আমরা একটু খেয়াল করলেই আমাদের চারপাশে দেখতে পারি।
তাই বাচ্চাকে সঙ্গ দেয়া বলতে আমি এমন সঙ্গ দেয়ার কথা বলছি না, যেটা আনরিয়েলিস্টিক এবং হিউম্যানলি ইম্পসিবল। সঙ্গ বলতে আমি বলছি ভাইবোনের কথা। একটা বাচ্চার জীবনে এরচেয়ে বেস্ট গিফট হতেই পারে না।
আমাদের বাচ্চারা এবং তাদের কাজিনরা চারজন যখন থেকে একসাথে থাকা শুরু করল, (ওদের বয়স যথাক্রমে চার, পাঁচ, সাত এবং আট) আমরা খেয়াল করলাম, ওদের খেলনাগুলো স্টোররুমে মোস্টলি আনইউজড পড়ে আছে। ওদের যখন দরকার কোনো খেলা বানিয়ে নিচ্ছে, এমন খেলা যেটায় হিউম্যান ইন্টারেকশনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন - ছোঁয়াছুঁয়ি (কে কাকে দৌড়ে ধরতে পারবে), লুকোচুরি, বেচাকেনা, কুইজ গেইম, কম্পিটিশন—আরো নানা কিসিমের খেলা যেগুলোর নামও আমি বলতে পারছি না। একসাথে খেলাধুলো করা একা একা খেলার চাইতে অনেক বেশি এন্টারটেইনিং। একসাথে পড়াশোনা, কালারিং বা অ্যাক্টিভিটি করা অনেক বেশি মজার। একসাথে খাওয়া-দাওয়া করাটাও একটা উৎসবের মত বিষয়। খেতে বসানোর জন্য আগে যেখানে কসরত করতে হতো, এখন একসাথে কয়েকটা ভাইবোন হওয়ার কারণে পাল্লা দিয়ে ওরা নিজেরাই খেয়ে নেয়। মুখে তুলে খাইয়ে দেয়ার পর্বটাও ফুরিয়ে গেছে।
জলজ্যান্ত বন্ধুর কাছে যান্ত্রিক মেশিন কখনোই পাত্তা পায় না। ওই যে বললাম, কার্টুনের কথা ওরা এখন মুখেও আনে না আলহামদুলিল্লাহ। দিজ ইজ দ্যা পাওয়ার অফ কম্প্যানিওনশিপ। আপনার বাচ্চাকে আপনি অনেক দামি খেলনা কিনে দিতে পারেন, হাই টেক গ্যাজেট দিতে পারেন, কিন্তু পিঠাপিঠি ভাইবোনের চাইতে আনন্দদায়ক ও ফুলফিলিং আর কিছুই দিতে পারবেন না, এটা লিখে দিলাম।
A sibling is the best gift for a kid.