[১]

কুফফারদের বিভিন্ন ধর্মীয় উপলক্ষে অভিনন্দন জানানো ইজমা‘র ভিত্তিতে হারাম। ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিঃ) তাঁর আহকামুল যিম্মাহ গ্রন্থে বলেন, “কুফফারদের যেসব আচার শুধুই তাদের, সেগুলোতে অভিনন্দন জানানো ইজমা’র ভিত্তিতে হারাম। যেমন ‘শুভ উদযাপন’ বা ‘তুমি যেন এটি উপভোগ কর’ ইত্যাদি বলা। এমনটা বললে কুফর যদি না-ও হয় তবু তা হারাম। এটি যেন তাকে প্রতিমাকে সাজদা করার জন্য অভিনন্দিত করা, বা তার চেয়েও খারাপ। এটি কাউকে মদপান, হত্যা বা ব্যভিচারে অভিনন্দন জানানোর সমতুল্য।… যে কোনো ব্যক্তিকে অবাধ্যতা, বিদ‘আত বা কুফরের জন্য অভিনন্দন জানায়, সে নিজেকে আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত করে।”

কুফফারদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা জানানো এ জন্য হারাম যে, কেউ শুভেচ্ছা জানালে সে এসব কুফরি আচার অনুষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেয় যদিও নিজে পালন না করে। কিন্তু মুসলিমরা এসব কুফরি আচারকে স্বীকৃতি দেবে না কারণ আল্লাহ এসবকে স্বীকৃতি দেন না।

“যদি তোমরা কুফরি কর, তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষি নন।তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফরি পছন্দ করেন না। [৩৯:৭]

অতএব তাদের শুভেচ্ছা জানানো হারাম, যদিও তারা সহকর্মী হয়।

তারা যদি তাদের উৎসবের উপলক্ষসমূহে আমাদের শুভেচ্ছা জানায়, আমাদের উত্তর দেয়া উচিত হবে না। কারণ এগুলো আমাদের উৎসব নয় এবং আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।…

“যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অন্বেষণ করে, তা তার থেকে কখনোই গ্রহণ করা হবে না, এবং আখিরাতে সে হবে ব্যর্থদের অন্তর্গত। [৩:৮৫]

মুসলিমদের জন্য এসব উৎসবে দাওয়াত গ্রহণ হারাম। কারণ এর অর্থ ঐ উৎসবে অংশ নেয়া যা শুভেচ্ছা জানানোর চেয়েও নিকৃষ্ট।

অনুরূপভাবে, কুফফারদের অনুকরণে এইসব দিনে পার্টি করা, উপহার বিনিময়, খাদ্যবিতরণ, কাজ থেকে ছুটি নেয়া মুসলিমদের জন্য হারাম।

রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে কোনো জাতির অনুকরণ করে, সে তাদেরই একজন।”

শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ তাঁর গ্রন্থ ইক্বতিদা‘ আল সিরাত্বাল মুস্তাক্বীম মুখালিফাত আসহাবুল জাহীম–এ বলেন, “তাদের উৎসবে তাদের অনুকরণের অর্থ হলো তাদের কুফরি বিশ্বাস ও আচারের ব্যাপারে সন্তুষ্ট থাকা।…”

এ ধরণের কাজ যে করে সে গুণাহগার, তা সে ভদ্রতাবশতই করুক বা মানা করতে লজ্জা পাওয়ার জন্যই করুক। কারণ এটি…কুফফারদের তাদের ধর্মের ব্যাপারে গর্বিত করে।

আমরা এক আল্লাহর কাছে দু’আ করি যেন তিনি মুসলিমদেরকে তাদের দ্বীনের ব্যাপারে গর্বিত করেন, ইসলামকে দৃঢ়ভাবে মেনে চলতে সাহায্য করেন এবং শত্রুদের উপর বিজয়ী করেন। কারণ তিনিই সর্বশক্তিমান।

{মাজমু’ ফাতাওয়া ওয়া রাসা’য়িল আল শায়খ ইবন ‘উসাইমীন, ৩/৩৬৯}

মূলঃ islamqa.info/en/947

[২]

আগের পর্বটি ছিল শুধু মুসলিমদের জন্য ক্বুর’আন-সুন্নাহ থেকে ‘উলামায়ে কিরামের ফাতওয়া। এখানে আমরা অমুসলিম ভাইবোনদের সাথে আমাদের কমন গ্রাউন্ডে থেকেই উক্ত বিষয়ে কিছু মতবিনিময় করবো ইনশাআল্লাহ।

প্রথমেই যেই কথাটার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ দরকার সেটা হচ্ছে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।' এই ডিসকোর্স তৈরি করার পেছনের কারণ হলো বর্তমান পৃথিবীতে ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে 'দেশ'। একটা দেশে বিভিন্ন মতবাদের লোক থাকে। এই দেশের ‘ক’ মতবাদের লোক ওই দেশের ‘ক’ মতবাদের লোকের প্রতি টান অনুভব করবে। সেই তুলনায় নিজ দেশের ‘খ’ মতবাদের লোকটাকে হয়তো সে ততটা আপন ভাববে না। এভাবে চললে কি দেশে শৃঙ্খলা থাকবে? যেসব ফ্যাক্টরের ভিত্তিতে কিছু লোক একত্রিত হয়ে ‘দেশ’ গঠন করে, সেসব ফ্যাক্টর কিন্তু ‘প্রাকৃতিক’ নয় বরং সামাজিকভাবে নির্মিত।

সবসময় একটা মানুষ সেসব ফ্যাক্টরের ভিত্তিতে টান অনুভব করবে তা অসম্ভব। তাই এটা সম্ভব না যে পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন পাহাড়ি বৌদ্ধ মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কিশোরী আর রাজশাহীর একজন সমতলবাসী মুসলিম পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মধ্যবয়স্ক কৃষক সব ব্যাপারে সবসময় পরস্পরকে আপন ভাববে। বিশেষ করে ধর্মের মত সেন্সিটিভ একটা ব্যাপার যদি সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই একই দেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে আপাত শান্তি রক্ষার্থে একটা কথা তৈরি করা হয়েছে ‘ধর্ম যার যার,উৎসব সবার।' অতএব, এটা কোনো ঐশী বাণী না যে সত্য হতেই হবে। একে প্রশ্ন করার সুযোগ আছে। এমন না যে প্রশ্নবিদ্ধ করে একে ভুল প্রমাণ করাই যাবে, তবে প্রশ্নের সুযোগ আছে।

‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ কথাটা দিয়ে যেই ম্যাসেজটা দেয়া হয় (অথবা দেয়ার দাবি করা হয়), সেটা হলো মানুষে মানুষে ঐক্য। শান্তি, ঐক্য, শৃঙ্খলা চাওয়াটা দোষের না। দোষ হয় যখন নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সুন্দর (কিন্তু মিথ্যা) কথা দিয়ে ছেলে-ভোলানো হয়। এখানে বলা হচ্ছে পৃথিবীর সব মানুষের ঐক্যের কথা। আসলে চাওয়া হচ্ছে নিজের দেশ-জাতির ঐক্য। অন্যান্য দেশ ও জাতি চুলায় যাক।

এখন আমরা কথাটা নিয়ে একটু খেলা করি। ‘ধর্ম’ এর জায়গায় ‘দেশ’ বসাই। তাহলে আমরা পেলাম ‘দেশ যার যার, উৎসব সবার।’ আসলেই কি? আমরা কি পারবো ১৪ই আগস্টে চাঁদ তারা খচিত পতাকা টাঙিয়ে ‘পাক সার জমিন শাদ বাদ' গাইতে? একটা পাকিস্তানি কি পারবে ১৫ই আগস্টে গায়ে তিরাঙ্গা জড়িয়ে ‘জন গণ মন' গাইতে? ভারতবর্ষের কেউ কি পারবে চুন মেখে শ্বেতাঙ্গ সেজে ‘গাড সেইভ দ্য কুইন’ গাইতে? কেন পারবে না? মুক্তিযোদ্ধারা যেই বাংলা বলেন, রাজাকাররাও তো সেই বাংলাই বলে। কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার আগে তো হিন্দুস্তানে পাকিস্তানে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সাদা ইংরেজ আর বাদামী ভারতীয়ের তো একই লাল রক্ত। সবার উপরে না মানুষ সত্য (এটাও প্রশ্নযোগ্য, তর্কের খাতিরে সত্য ধরলাম)?

দেখা যাচ্ছে ধর্মের প্রশ্নে মানবতার আবেগ থরথর রেটোরিকগুলো যতটা আবেদন নিয়ে এসেছিলো, ‘দেশ’ বা ‘জাতি’র প্রশ্নে সেগুলো সেভাবে আসছে না।

অথচ সংস্কৃতি পরস্পর মিশ্রণীয়। In fact, বিশুদ্ধ সংস্কৃতি বলে কিছু নেই। সবই হাজার বছর ধরে হাজার রকম মানুষের অভ্যাস-বদভ্যাসের সমষ্টি। উদাহরণস্বরূপ আজকের ‘বাংলাদেশ’-কে কল্পনা করে ‘আমার সোনার বাংলা’ লেখা হয় নি। সেলাই করা কাপড় (যেমন ব্লাউজ, পান্জাবি) বাঙালিদের পোশাক না।

অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে যোগ বিয়োগের স্কোপ আছে। অথচ জাতীয়, সাংস্কৃতিক উৎসব গুলোতেই কিন্তু আমরা কোনো আপোষ করছি না। বাইরের কিছু ঢুকলেই ‘অপসংস্কৃতি! অপসংস্কৃতি! জাত গেলো! দেশটা অমুকস্থান হয়ে গেলো!’ বলে সেসব তাড়িয়ে দিচ্ছি। অথবা অন্তত তাড়িয়ে দেয়া যে উচিত তা বুঝতে পারছি।

এখন একজন ধর্মবিশ্বাসীর সাইকোলজিটা দেখুন। ধর্মকে সে কোনো এক ত্রুটিমুক্ত Supreme Being এর কাছ থেকে আসা বিধান বলে মানে। এখন ধর্মে যদি একটা ত্রুটিপাওয়া যায়, তাহলে দুটি জিনিস হতে পারে– (১) হয় সেই ধর্ম পুরোটাই মিথ্যা (২) অথবা সেটা আসলে কোনো ত্রুটিই না, কিন্তু আমাদের মানবীয় সীমাবদ্ধতার কারণে এর যথার্থতা এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না

অর্থাৎ ধর্মের মধ্যে মিশ্রণ অসম্ভব। মিশ্রিত হলে ‘ধর্ম‘ আর ‘জাতীয় সংস্কৃতি‘র মাঝে কোনো পার্থক্য থাকবে না। গরুকে দেবী বলে মানে আর গরু জবাইকরে উৎসব করে– এমন দুটি মানুষকে আপনি কীভাবে ঐক্যবদ্ধ করবেন? ‘উৎসব সবার’ টাইপের অসার কথা বলে? তাহলে বলতে হয় ‘ধর্মে’র কনসেপ্টটাই ক্লিয়ার হয় নি।

তাহলে কি ঐক্য হবে না? মারামারি-কাটাকাটিই সমাধান?

এখানে আমরা ‘মিশ্রণ’ আর ‘ঐক্য’কে গুলিয়ে ফেলছি। অন্য ধর্মের উৎসবে গিয়ে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আসতে হবে, এমন কথা ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে যতটুকুই জেনেছি কোথাও পাই নি।

আপনাদের উৎসবে শুভেচ্ছা না জানানো ও অংশগ্রহণ না করা– এগুলো আমার নিজের ধর্ম পালনের অংশ। অন্যের ক্ষতি না করে নিজ নিজ ধর্মপালন করলেই তো হলো, নাকি?

আপনার ধর্মে যদি নিষেধ না থাকে, আমাকে ‘ঈদ মোবারক‘ জানাবেন, আমার বাসায় এসে গোশত খাবেন। যদি নিষেধ থাকে, তাহলে আসবেন না। আমার আপত্তি নেই।

কিন্তু আমার আল্লাহকে আপনি ‘দূর্গা‘, ‘জিশু‘, ‘বুদ্ধ‘ নামে ডাকবেন, নারী–পুরুষ–হিজড়ার আকৃতিতে তাঁর মূর্তি বানাবেন, তারপর আমাকে এসে শারদীয়, বড়দিনীয়, পূর্ণিমিয় শুভেচ্ছা জানাবেন, আমি জবাব দিবো না।আমাকে দাওয়াত দিবেন, যাবো না। প্রসাদ মুখে তুলে দিবেন, মুখ খুলবো না।

আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন যে আমাকে আপন ভেবেছেন। আমিও দু’আ করি আপনারা যেন মৃত্যুর আগের ও পরের জীবনে কামিয়াব হোন। যে পথে কামিয়াবি, সে পথেই হাঁটেন।

শান্তি বর্ষিত হোক তাঁদের উপর যাঁরা হিদায়াতের অনুসরণ করেন

[৩]

Related Quotes:

আল্লাহ্‌ বলেন, “নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম।” [৩ঃ১৯]

"হে লোক সকল! একটি উপমা বর্ণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না, প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন।" [২২ঃ৭৩]

"নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে। এছাড়া যাকে ইচ্ছা, ক্ষমা করেন।" [৪ঃ১১৬]

উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেছেন, "তোমরা মুশরিকদের উপাসনালয়ে তাদের উৎসবের দিনগুলোতে প্রবেশ করো না। কারণ সেই সময় তাদের উপর আল্লাহর গযব নাযিল হতে থাকে।" [ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিঃ) তাঁর 'আহকামুল জিম্মাহ ১/৭২৩-৭২৪ এ সহিহ সনদে বায়হাক্বী থেকে এই রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন]

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, "...অচিরেই আমার উম্মাতের কিছু লোক মূর্তিপূজা করবে এবং আমার উম্মাতের কিছু লোক মূর্তিপূজারীদের সাথে মিশে যাবে।..." [সুনানে ইবনে মাজাহঃ অধ্যায় ৩৬ (কিতাবুল ফিতান), হাদীস ৩৯৫২। তাহকীক – সহীহ]

মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহীম (আঃ) মূর্তিপূজকদের উদ্দেশ্যে বলেন, "তোমাদের ও আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা থাকবে।" [৬০ঃ৪] এই শত্রুতা মানুষ হিসেবে নয়, এই শত্রুতা আল্লাহ্‌ সুবহানু তায়ালার সাথে শির্ক করার কারণে।