তন্ময় বিশাল একটা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। নামছে তো নামছেই। কোন থামাথামি নাই। কোথায় যাচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছে না। সিঁড়ি পথটার কোন শেষ দেখা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র ছোট একটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে।
ও দরদর করে ঘামছে। অসম্ভব রকমের আতঙ্ক লাগছে ওর। মনে হচ্ছে আর জীবনেও তার গতকাল মাত্র ডিস্টেম্পার করা সাদা ধবধবে দেয়ালের ঘরে স্ত্রী তনুর টানটান করে বিছানো সাদা চাদরে ধপ করে শুয়ে পরতে পারবে না, সন্ধ্যা নামলে পাশের ঘর থেকে ওর মা সায়রা আক্তারের ইচ্ছামত পেয়াজ, কাঁচামরিচ আর আঁদাকুচি দিয়ে ডলে মুড়ি মাখার পর “ও তন্ময়, আয় মুড়ি মাখাইছি” এই ডাক শুনতে পাবে না, তিনমাস আগে ডিভোর্স হওয়া তার বড় বোন তাহিতির রুমের পাশে যাবার সময় চাপা কান্না শুনতে পাবে না। আর এর চেয়েও বড় কথা তার একমাত্র মেয়ে তিতিরের পাপা ডাক আর শুনতে পাবে না। যদিও এই সমস্ত ব্যাপার তন্ময় খুব একটা পাত্তা দেয় তা না। তবে এই মুহূর্তে ওর কোন একটা বিচিত্র কারণে এগুলাই মাথায় আসছে।
তন্ময় প্রাণপনে চেষ্টা করছে পেছন ফিরে উপরে উঠে আসার, কিন্তু পারছে না। কোন কিছু একটা ওকে টেনে হিড়হিড় করে নামাচ্ছে। ও নিজেকে ছেড়ে দিলো। থাক যা খুশি হোক। কোথায় যাচ্ছে দেখা যাক। প্রচন্ড আতঙ্কের সময় গা ছাড়া দিতে হয়। তাহলে আতঙ্ক কিছুটা কাটে।
নামতে নামতে হঠাত ও থেমে গেলো একটা সিঁড়িতে। ঠিক নিজে থেকে থেমেছে এটা বলা যায় না। ওকে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। ও আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেললো। হঠাৎ করে ওর রুমের খাটের পাশে রাখা সাইড টেবলে বসা তনু চোখের সামনে ভেসে আসলো। ওর নিজের শরীরটা হঠাৎ হাল্কা তুলার মত মনে হল ওর। ও তনুর মাথায়/চিন্তায় ঢুকে যাচ্ছে। কোন কিছুতে ওর কোন হাত নেই ও জানে। ও স্পষ্টভাবে ওর স্ত্রীর মাথার চিন্তাগুলো পড়তে পারছে। আর কি আশ্চর্য বিছানাতে তন্ময় নিজেকে দেখলো ঘুমিয়ে থাকতে। চোখের সামনে নিজেকে শুয়ে থাকতে দেখে আতঙ্ক তীব্রতর হলো।
ঘরটা এলোমেলো হয়ে আছে গুছাতে হবে। তিতিরকে স্কুলে দিয়ে এসে কয়েক ঘন্টার মধ্যে এতগুলো কাজ করতে হয়। প্রচন্ড আলস্য চেপে ধরেছে তনুকে। ঠিক তনুকে না তনুর ভেতরে ঢুকে যাওয়া তন্ময়কে।
- এই তন্ময় উঠো। অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে।
বিছানায় শুয়ে থাকা তন্ময় বাথরুম গেলো। বাথরুম থেকে চিৎকার করে বলছে—“আই তনু আমার টাওয়াল দিয়ে যাও।”
তনু বিছানার ঝাড়ু দিয়ে বিছানা পরিষ্কার করে মাত্র রান্নাঘরে গেছে। বুয়াকে দিয়ে দুপুরের রান্নার কোটাবাছা করাচ্ছে, নিজে সকালের নাস্তা বানাচ্ছিলো। শাশুড়ি মা নাস্তা খাবে। তন্ময় অফিস যাবার আগে নাস্তা টেবিলে দিতে হবে। বুয়াকে দিয়ে কাপড় ধোয়াতে হবে এরপর। দাঁড়িয়ে না থাকলে কাপড় ঠিকমত ধোবে না। এক কাপড়ের রঙ আরেকটাতে লাগিয়ে একাকার করবে। তার মধ্যে আবার তন্ময়ের সাদা শার্ট আছে আজ। ঘর ঠিকমত মুছবে না দাঁড়িয়ে না থাকলে। পরে ওর শাশুড়ি কথা শোনাবে। কথা শুনতে তনুর ভালো লাগে না।
রান্না শেষ করে ফেলতে হবে তিতিরকে আনতে যাবার আগে। ওর সাড়ে বারোটায় ছুটি। এসব চিন্তা করতে করতে তনুর মাথার ভেতরে বসেই তন্ময়ের দম আটকে আসছে।
- এই আমি যাচ্ছি। আসতে দেরি হবে।
অফিসে বেড়িয়ে গেলো তন্ময়। অবাক হয়ে নিজেই নিজের যাওয়া দেখলো তনুর মাথার ভেতর থেকে। ঝড়ের বেগে তনু সব কাজ করে যাচ্ছে। তন্ময়ের মা আগে খায়। উনার খাবার টেবিলে দিয়ে তিতিরকে আনতে যাবার জন্য তনু বের হবে। টেবিল থেকে সায়রা আক্তার বলে উঠলেন, “কি সব রান্না যে করো। মুখে দেয়া যায় না।”
তনুর চোখে পানি চলে আসলো। ও ভাবছে বাবার বাসায় থাকতে কখনো মা কিছু করতে দেয় নি। ও তো সব করার চেষ্টা করে। তবু কেন যে কাউকে খুশি করতে পারে না। এই যে সে তন্ময়কে বলেছিলো আজ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে সেটা তন্ময়ের মনে নাই। বলে গেলো আসতে দেরি হবে। তনুর অসম্ভব মন খারাপ লাগছে। ওর সাথে সাথে মন খারাপ লাগছে তন্ময়েরও। আহারে বেচারি। আহারে। তনুর স্বামীরূপী তন্ময়ের উপর ওর রাগ লাগছে।
তনু তিতিরকে স্কুল থেকে এনে ওকে খাইয়ে, গোসল করিয়ে, ঘুম পাড়িয়ে নিজে যখন খেতে গেলো তখন বেলা সাড়ে তিনটা। এরপর আধ ঘন্টার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিলো—সন্ধ্যার নাস্তা বানানোর চিন্তা নিয়ে, ছাদ থেকে কাপড় এনে ভাঁজ করবার চিন্তা নিয়ে, তিতিরকে হোমওয়ার্ক করিয়ে রাতে খাইয়ে ঘুম পাড়াবার চিন্তা নিয়ে, রাতে খাবার গরম করে টেবিলে দেবার চিন্তা নিয়ে, খাবার সময় আবার শাশুড়ি মার কাছে কি না কি শুনতে হয় সেই আতঙ্ক নিয়ে, সময় করে উঠতে না পেরে আধপড়া বইটার জন্য হাহাকার নিয়ে, রাতে স্বামী ফিরে আসলে তার গম্ভীর মুখ দেখবার দুঃখ নিয়ে—যে গম্ভীর মুখের পরতে পরতে আছে এই ভাবনা সে সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত আর তনু বাসায় বেশ আরামেই ছিলো।
তনুর মাথার ভেতর তন্ময়ের দম আটকে আসছে। অন্যরকম একটা দুঃখবোধ ছেয়ে ধরেছে ওকে।
ঠিক এই অবস্থায় ও নিজেকে সেই সিঁড়িটাতে দেখতে পেলো। তনুর মাথা থেকে বের হতেই ও খুব বড় করে একটা নিশ্বাস নিলো। বুকে কিরকম জ্বালা বোধ হচ্ছে।
ও আবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। এবার ও ঠিক ওর মায়ের রুমে। ওর মা মাত্র সালাম ফিরিয়েছে নামাজ শেষে। ঠিক একই ভাবে ও অসম্ভব আতঙ্ক নিয়ে ওর মায়ের মাথায় ঢুকে গেলো। মা’র মাথার চিন্তাগুলো পড়তে পারছে স্পষ্টভাবে।
এই মুহূর্তে সায়রা আক্তারের খুব মন খারাপ লাগছে। খাবার শেষে নামাজ পরেছে মাত্র। তন্ময়টা সকালে কেমন না বলে চলে যায় উনি ভাবছে। অথচ এই ছেলেটা মা ছাড়া কিছু বুঝতোই না। বাবার সাথে ছোটবেলায় যখন স্কুলে যেতো বারবার ফিরে ফিরে আসতো। এইতো বিয়ের আগ পর্যন্তও “আম্মা! আমি যাচ্ছি” বলে গলা ছেড়ে চিৎকার দিতো। তনু মেয়েটা বেশ ভালোই। তবু ছেলের এসব কথা মনে পরলেই না চাইতেও কেন জানি দুটা কটু কথা বের হয়ে যায় মুখ থেকে। কিন্তু তনুকে যে উনি বেশ ভালোবাসেন এটা ভালোই টের পান নিজে।
তিতির স্কুল থেকে ফিরেছে। দীদা বলেই বুকে এক ঝাপ দিলো। এই মুহূর্তে নিজেকে বেশ সুখি মনে হচ্ছে উনার। বাচ্চাটা এত মায়াবতী হয়েছে।
তিতির ঘুমানোর পরই তন্ময়ের বাবার কথা মনে হচ্ছে উনার। এতগুলো বছর একসাথে কাটালেন। অথচ আগে চলে গেলেন। একলা বেচে থাকা এত বুক ভার করা কষ্টের কে জানতো। উনার চোখের পানি টলটল করছে। ছেলেটাও যদি বুঝতো মায়ের কষ্টটা। সারাদিনে একটা বার ফোন দিয়ে খোঁজ নেয় না। অথচ আগে ওষুধ খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতো। এখন সব দায়িত্ব তনুকে বুঝিয়ে দিয়েছে। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর না ডাকলে রুমে খুব একটা আসে না। আগে মুড়ি মাখা খেতে কত ভালোবাসতো। এখন কিরকম জোর করে খায়। অথচ উনি অপেক্ষা করে বসে থাকেন কবে ছেলেটা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবে। উনি মুড়ি মেখে ছেলে কে ডাকবেন।
তন্ময়ের বুকটা ভেঙে আসছে। আহারে মা! কি কষ্ট! কি কষ্ট!
তন্ময়ের ইচ্ছা করছে চিৎকার করে বলে প্লিজ কেউ আমাকে মা’র মাথা থেকে বের করো। প্লিজ!
তন্ময় আবার সিঁড়িতে দাঁড়ানো। ও আবার বড় করে শ্বাস নিলো। আবার চলতে শুরু করছে ও।
তিতিরকে দেখতে পাচ্ছে। হোমওয়ার্ক করছে ও। ওর মা ওকে এই মাত্র বকা দিলো। খাতা দাগিয়ে ময়লা করেছে বলে। তিতিরের মাথায় তন্ময়েরও ওর মত ঠোট ফুলিয়ে কান্না আসছে। ওর আঁকতে ভালো লাগলে ও কি করবে।
তিতিরের খেতে ইচ্ছা করছে না। মা তবু জোর করে খাওয়াচ্ছে। ইশ এমন যদি হত সারাদিন শুধু চকলেট আর আইস্ক্রিম খেতে হয় এমন একটা দেশে বাস করে ও। আম্মু খাতা নোংরা করার জন্য বকতো না, জোর করে খাওয়াতো না। সেটা তো সম্ভব না। কি আর করা। ও খুব আল্লাহ্র কাছে দোয়া করছে পাপা যাতে তাড়াতাড়ি আসে। পাপার আজ চকলেট আনবার কথা। দীদা বলেছে মন থেকে আল্লাহ্কে কিছু বললে উনি সেটা শোনেন। বাবা দেরি করলেই মা ওকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে যাবে। ওর বাবার সাথে দেখাও হবে না, চকলেটও খাওয়া হবে না। সকালে তো বাবা উঠবার আগেই ও স্কুলে চলে যাবে।
তিতির মন খারাপ করে ঘুমাতে গেছে। ওর বাবা এখনো আসে নি।
তন্ময়ের কান্না পাচ্ছে। আহারে বাচ্চাটা আমার। আমার ছোট্ট পরী বাচ্চাটা। আহারে! কেউ ওকে তিতিরের মাথা থেকে বের করে না কেন!
- স্যার! স্যার! উঠুন। আপনাকে এম ডি স্যার খুঁজছেন।
তন্ময় ধড়ফড় করে টেবিল থেকে মাথা উঠালো। ওর চোখ টকটকে লাল।
ও বিড়বিড় করে বলছে, “তন্ময় স্যার হওয়া খুব সহজ। বাবা হওয়া, স্বামী হওয়া আর সন্তান হওয়া বড় কঠিন বুঝলে করিম!”
কি বলেন স্যার!
- নাহ কিছু না।