‘মড়ার ওপর খাড়ার ঘা’ নামে একটা প্রবাদ আছে। সেই প্রবাদের বাস্তবায়ন হচ্ছে আমাদের ওপর। গতকাল রাতে বাবা এসে বললেন, বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। বাড়িওয়ালা জানিয়েছে, ‘ভাইসাব! সবই তো বুঝেন! দেশের যেই পরিস্থিতি। আমার এই একটা মাত্র বাড়ি। অন্য ভাড়াটিয়ারা চাপ দিচ্ছে। আপনার দু’মাসের ভাড়া এডভ্যান্স আছে। আপনার আগামী দু’মাস আর ভাড়া দিতে হবেনা।’ কালো মুখের বদলে বাবার মুখ হাস্যোজ্জ্বল দেখা গেল। কারণ হলো ভাইয়ার ছাড়া বিষয়ে কথা হচ্ছে। ‘দরদাম’ চলছে। বাবার একাউন্টে আছে সব মিলিয়ে ৯০ হাজার এর মতো। এর চেয়ে বেশি চাইলে কীভাবে দিবেন এই নিয়ে বাবা চিন্তিত। তবে ফারুক সাহেবের ওপর ভরসা করা যায়। উনি প্রগতিশীল মানুষ। বাবা যতোবার থানায় গিয়েছেন ততোবারই বাবাকে লাল চা আর বিস্কুট খাইয়েছেন। দেশ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। জঙ্গিরা টার্গেট করছে ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদের। বাবা ও ওসি ফারুক এই বিষয়ে ঐক্যমতে পৌছেছে। ভাইয়া ছাড়া পাবেন এইটা মোটামুটি নিশ্চিত, তবে একটা বই সমস্যা করছে। এই বইয়ের জন্য ঝামেলা একটু বেশি হচ্ছে। ভাইয়ার পকেটে দোয়ার একটা বই থাকে, নাম হিসনুল মুসলিম। ভাইয়া এই বইয়ের দোয়াগুলো মুখস্ত করছেন বলে আমি জানি। কিন্তু বইটা খুলে কখনো দেখা হয়নি। ভাইয়ার রুম খুজে হিসনুল মুসলিম এর মোট দশ কপি পাওয়া গেল। আমি আর বাবা বইটা নিয়ে পড়লাম, শতাব্দীর কন্ঠ পত্রিকা কেন এই বইকে জঙ্গিবাদী লিস্ট এ আনলো কে জানে!
অজু করে বাবা জায়নামাজে দাঁড়িয়েছেন। গত কয়েকদিন ধরেই বাবা বাসায় এসেই অজু করে জায়নামাজে দাঁড়ান। কঠিন বিপদে পড়লে জবরদস্ত নাস্তিকও উপরের দিকে তাকায়, আমার বাবা পুরোপুরি নাস্তিক নয় বলেই হাত তুলে উপরের দিকে তাকাচ্ছেন। আমাদের পরিবারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা উচিত।
ভাইয়া
ভাইয়া এখন ডিবির কার্যালয়ে। তার সাথে আমার আর বাবার একবার দেখা হয়েছে, ওসি ফারুক ব্যবস্থা করিয়েছেন। এর বদৌলতে কিনা জানিনা, বাবা ফারুক সাহেবের জন্য ঐদিন স্টার কাবাব থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে থানায় গিয়েছেন।
বাবা
সন্তানের জন্য বাবা মা’র সবসময় ভালোবাসা থাকে, আস্তিক মা-বাবার যেরকম থাকে, নাস্তিক মা-বাবারও থাকে। ভাইয়ার জন্য আমার মা বাবার অবস্থা দেখে আপাতত আমার এই উপলব্ধি। ইব্রাহীম নবী আল্লাহর নির্দেশে তার ছেলেকে জবাই করতে গেলেন। আল্লাহর প্রতি নবী ইব্রাহীম (আলাইহি ওয়াস সালাম) এর ভালোবাসা তাহলে কিরকম ছিল? আমার পক্ষে এটা কল্পনা করা সম্ভব নয়। আল্লাহ’র প্রতি আমার ভালোবাসা দৈনিক তিন ওয়াক্ত নামাজ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
মা
মায়ের অবস্থা প্রথম দিন থেকে ভালো। অধিক শোকে পাথর বলে একটা কথা আছে। আমার মা এখন পাথর। কান্নাকাটি করেন না। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকেন, জানালার ফাঁক দিয়ে অপলক আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন। সম্ভবত আকাশ থেকে সাহায্য আসার আকুল আবেদন।
আমি
বাবার সাথে মাঝে মধ্যে থানা-পুলিশ দৌড়াদৌড়ি করি। আপাতত কলেজে যাওয়া হচ্ছেনা। ভাইয়ার সকল কাজ আমাকেই করতে হচ্ছে। নিয়মিত বাজার করা, ইলেক্ট্রিসিটি বিল দিয়ে আসা, মায়ের জন্য ঔষুধ আনা এসব।
ইরিনা
ইরিনার সাথে কথা বলার মোড আপাতত নেই। গতকাল ইরিনাই কল দিয়েছিল। বললাম, ভালো নেই, ঝামেলার মধ্যে আছি। কিসের ঝামেলা তা বলার আগেই, ইরিনা বলল, ‘আমি তোমাদের খবর শুনেছি। তোমার ভাইকে প্রথম দিনেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল। সাবধানে থেকো। ‘ইরিনার ওপর এই প্রথমবারের মতো আমার রাগ হলো, ও আমার ভাই সম্পর্কে কি জানে! ওর কিসের এতো সন্দেহ! বড়লোকের সুন্দরী মেয়েরা প্রাইভেট কারের বাইরের জগত সম্পর্কে যে একবারেই অজ্ঞ এই বিষয়ে আমি আবারও নিশ্চিত হলাম।
ভাইয়া বাসায় ফিরেছেন। বাবা ফিরেছেন ব্যাংকে। তেমন টাকা লেগেছে বলে মনে হলনা। ফারুক সাহেব ভাইয়াকে বাসায় দিয়ে গিয়েছেন। বাবা অনেক সাদাসাদি করলেন রাতের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য। ফারুক সাহেব বললেন, আরেকদিন হবে ভাই। ফারুক সাহেবের ‘আরেকদিনে’ বাবা খুশি হয়েছেন বলা যাবেনা। পুলিশের সাথে আরেকদিন-এর ব্যাপার কেউ রাখতে চায়না।
ভাইয়া আসার পর মা আর ছোট খালা সারাক্ষণ ভাইয়ার সেবা শুশ্রুষার জন্য তার রুমে বসে থাকেন। মায়ের একটাই জিজ্ঞাসা, ‘তোকে কি খুব মেরেছে?’ ভাইয়া তেমন কিছু বলেন না। মারামারি বিষয়ে ভাইয়ার সাথে আমার তেমন কোন কথা হয়নি। বাবার সাথে ভাইয়ার কথা হয়েছে। বাবা এবং ভাইয়া উভয়ই আমাদের জানালেন, ‘হিসনুল মুসলিম’ নামক বই এর বিতরণ ঘটনার মূল উৎস। ভাইয়া গতবছর ১০০ কপি হিসনুল মুসলিম বই কিনেছিলেন। এতক্ষণে আমার মনে পড়ল, বইটা আমাকে নিয়েই কিনেছিলেন, কিন্তু এটা যে সেই বই তা জানা ছিলনা। আমি নিজ হাতে ছোট খালাকেও এই বইটি দিয়েছিলাম। ভাইয়ার বন্ধু হতে শুরু করে চা বিক্রেতা সুফিয়ান, সবাইকেই এক কপি করে দেয়া হয়েছে। ৯০ কপি বিতরণ হয়েছে। ভাইয়ার অপরাধ হচ্ছে ‘হিসনুল মুসলিম নামক জঙ্গি বইয়ের বিতরণ।’ যাদেরকে বইটি দেয়া হয়েছে সবাই পরিচিত। বই বিতরণ সংক্রান্ত তথ্য পুলিশ পেল কোত্থেকে?
আমি ভাইয়ার রুমে বসে Qadar নামক বই পড়ছি। ভাইয়া তার কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার দিকে ফিরে বললেন, চীনের মহাপ্রাচীর জুলকারনাইন নির্মাণ করেছেন এবং আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটই হলেন সেই জুলকারনাইন এই রকম একটা ধারণা আমাদের দেশের শিক্ষিত মহলে পোষণ করা হয় তা কি তুই জানিস?
আমি না সূচক মাথা নাড়ালাম।
আমাদের চেয়ারম্যান স্যার ও এই ধারণা পোষণ করেন। তার জ্ঞান এর উৎস হুমায়ুন আহমেদের বই। অথচ তথ্যটি সঠিক নয়।
আমিতো জুলকারনাইন এর নামই এই প্রথম শুনলাম। তোমাদের চেয়ারম্যান স্যার ও হুমায়ুন আহমেদ তো আমার চেয়ে একধাপ এগিয়ে আছে।
ভাইয়া হুমায়ুন আহমেদ এর সাহিত্য বিষয়ে প্রায় ১০ পৃষ্ঠার একটা পর্যালোচনা লিখেছেন। পর্যালোচনার নাম ‘হুমায়ুন আহমেদ এর ইসলাম বিষয়ক তথ্য বিভ্রাট।’ শিরোনাম সার্থক হয়নি। আমি পর্যালোচনাটি পড়েছি। বিভ্রান্ত তথ্যের পাশাপাশি সঠিক তথ্যও আলোচনায় উঠে এসেছে। শিরোনাম দেয়া উচিত ছিল ‘কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের লিখায় ইসলাম।’ ভাইয়ার পর্যালোচনা’র কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হল—
“বাংলা কথা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ হুমায়ুন আহমেদ তার গল্প উপন্যাসে ইসলাম বিষয়ক অনেক তথ্য দিয়েছেন। তবে সব তথ্য যে সঠিক দিয়েছেন তা নয়। আমি মনে করিনা উনি ইচ্ছা করে ভুল তথ্য দিবেন। উনি ইসলাম বিষয়ক পন্ডিত নয়। উনি পোস্ট ডক করেছেন ইউএসএ’র নর্থ ডাকোটা থেকে। বাংলাদেশের (সেক্যুলার) শিক্ষিত মহলের প্রতিচ্ছবি উনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহল ইসলাম বিষয়ক যেই জ্ঞান রাখে হুমায়ুন আহমেদ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।… ’তোমার হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে এবং তুমি জানো যে আগামীকাল কিয়ামত, তুমি চারাটি রোপণ করে দাও’, এই তথ্যটি সঠিক, আল্লাহ’র রাসূল (সাঃ) এর সাথে সম্পর্কিত এই কথাটি সত্য। চীনে জ্ঞান অর্জন নামক যেই কথাটি হাদীস হিসেবে বহুল প্রচলিত তা সত্য নয়। হুমায়ুন আহমেদ এটিকে হাদীস হিসেবে তার বইতে উল্লেখ করেছেন, এবং কেন রাসূল (সাঃ) চীন দেশে গিয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য বলেছেন তার ব্যাখ্যাও করেছেন। হিল্লা বিয়ে নিয়ে তার দেয়া তথ্যটি সঠিক। হিল্লা বিয়ে একটা প্রতারণা, হারামকে হালাল করার কৌশল। ইসলামে এই ধরনের প্রতারণার স্থান নেই…।”
এই দেশের শিক্ষিত সমাজের প্রতি ভাইয়া বিরক্ত তা আমার জানা। ধর্ম বিষয়টা বাদ দিলে ভাইয়াকেও শিক্ষিত সমাজের একজন বলতে হবে। কিন্তু দাড়ি জুব্বা-ওয়ালা কাউকে শিক্ষিত সমাজ ঠিক শিক্ষিত হিসেবে মেনে নিতে চায় না। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণীগোষ্ঠী। এখানে শিক্ষিত, মার্জিত এর আলাদা কিছু মিনিং আছে। কাউকে শিক্ষিত হতে হলে এথেইস্ট হতে হবে, অর এট লিস্ট এগনোস্টিক। ভাইয়ার কাছ থেকে জানলাম বাংলার এই এথেইস্ট সোশাইটি দো’টানায় আছে। এরা নিজেদের বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে জাহির করতে চায়। সেই অনুযায়ী এদের উচিত আমেরিকা ইউরোপের পূজা করা। কিন্তু এরা আবার আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী (এটলিস্ট মুখে মুখে), পাশ্চাত্যের ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেম এ এদের বিশ্বাস নাই, ওরা বুর্জোয়া লালন করে। কথাগুলো বলতে বলতেই ভাইয়া নিজের অজান্তেই বলে ফেলেন, ওদের উচিত কিউবা কিংবা নর্থ কোরিয়ায় বসবাস করা।
ভাইয়া যেরকম এথেইস্ট সোশাইটির ওপর বিরক্ত, আমি হয়েছি ইরিনার ওপর। সে আমাকে তার নষ্ট ল্যাপটপ সারানোর দায়িত্ব দিয়ে গেছে। সাথে সাথে আমাকে বলে গেল ME লিখা ফোল্ডারে না ঢুকতে। আমি তার মাথায় হাত রেখে কসম করেছি, আমার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়া কেউ বললেও ME লিখা ফোল্ডারে আমি ক্লিক করবো না। এলিফ্যান্ট রোডে ল্যাপটপ দিয়ে এসেছি ঠিক করার জন্য। ল্যাপটপ ঠিক হয়েছে, দোকান থেকে কল দিয়ে বলল বিল এসেছে ১৮০০, সার্ভিস চার্জ ৩০০ আর ল্যাপটপ এর ভিতরের একটা কুলিং ফ্যান নষ্ট হয়েছে সেটা রিপ্লেস করতে ১৫০০। আমার পকেটে আছে ২০০ টাকা। ভাইয়াকে বললে অবশ্য টাকা পাওয়া যাবে, কিন্তু ভাইয়ার সাথে মিথ্যা বলতে আমার ভালো লাগেনা। শেষমেষ ছোট খালা টাকা দিল, বললাম, বন্ধুরা সবাই মিলে হঠাৎ ট্যুরে যাচ্ছে, আমি না করে দিয়েছি, পকেটে এক টাকাও নেই। একটু আবেগঘন কন্ঠে বলায় কাজ হল, খালা জানতে চাইলেন কত লাগবে?
ওসি ফারুক একদিন বাসায় এলেন। বাবা বাসায় ছিলনা বলে চলে যাচ্ছিলেন, ভাইয়ার অনুরোধে চা খেতে বসলেন। আমাদের বসার রুমটা খুবই ছোট। দুটো লম্বা সোফা’র মাঝখানে একটা চায়ের টেবিল। একপাশে একটা টেলিভিশন। চায়ের টেবিলে যথারীতি চায়ের কাপ রাখা হয়েছে, সাথে আছে বিস্কুট। ওসি ফারুকের সাথে ভাইয়ার কথোপকথনের অপেক্ষায় আছি আমি। ক্ষমতাবানদের সাথে মানুষ সব সময় নম্ নম্ করে। ওসি ফারুকের সাথে ভাইয়া কি করে তার অপেক্ষা।
- তোমার মাস্টার্স এর রেজাল্ট দিয়েছে?
- জি না, আংকেল। কিছু দিনের মধ্যেই দেয়ার কথা।
- এরপর কি করবে কিছু ভেবেছ?
- আগে রেজাল্ট টা হোক, দেখা যাক।
- আমেরিকায় চলে যাও স্কলারশীপ নিয়ে। এটা হচ্ছে করাপ্টেড দেশ বুঝছ? টপ টু বটম সবাই করাপ্ট।
- আংকেল, আপনি কি হিসনুল মুসলিম বইটা পড়েছেন?
- না। তবে প্রথম কিছু পৃষ্টা উলটে দেখেছি।
ওসি ফারুক চলে গেলেন। যাওয়ার আগেই বাবার সাথে দেখা হয়ে গেল। বাবা দুপুরে খেয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। ওসি ফারুক দুপুরের খাবার খেয়ে গেলেন না, বাবাকে চুপে চুপে বলে গেলেন, আপনার বড় ছেলের দিকে নজর রাখিয়েন। ট্যালেন্ট ছেলেপুলের দিকেই কিন্তু জঙ্গিদের টার্গেট। ভাইয়া যখন নামাজ পড়তে বাইরে গেলেন, তখনই বাবা ভাইয়ার রুম থেকে হিসনুল মুসলিম নামক সকল বই জোগাড় করে স্টোর রুমে একটা বস্তায় রেখে এলেন।
ইরিনা মেসেজ দিল, Plz Don’t Open ME Folder. ইরিনার ল্যাপটপ আমার বিছানায়। নিজের সাথে এক ধরনের যুদ্ধ চলছে, শীতল যুদ্ধ। এই ফোল্ডারে কি আছে? ইরিনার প্রতি কি আমার বিশ্বাস নেই? সকাল গড়িয়ে দুপুর হল, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। ME ফোল্ডার খোলা হল। ফোল্ডারে দু’টো ইমেজ আর ৪ টা ওয়ার্ড ফাইল। ইমেজ দু’টো আমার আর ইরিনার যৌথ ছবি। এক এক করে সবগুলো ওয়ার্ড ফাইল ওপেন করলাম। খুশিতে আমি আটখানা। আটখানা হওয়ার কারণ হচ্ছে ওয়ার্ড ফাইলগুলো আমাকে নিয়েই লিখা। একটু হিন্টস দেই। ইরিনা লিখেছে “… ছেলেদের ধারণা বড়লোকের মেয়েরা একশ একটা প্রেম করে বেড়ায়। ইহা সত্য নহে। আমার প্রাইভেট কার আছে এই হিসেবে আমাকে বড়লোকের মেয়ে হিসেবে যদি সেম্পল নেয়া হয়, তাহলে আবারও বলতে হয় ইহা সত্য নহে। আমি অদ্যবধি একজনকেই চিনি যাকে নিজের সবটুকু দিয়ে দিতে পারি, সে হলো…।” চারটা ওয়ার্ড ফাইলে মোট মিলে ২১১৩ ওয়ার্ডস লিখা। আমি কি ইরিনার কাছে গিয়ে বলব, আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি তোমার কথা রাখতে পারিনি!
ভাইয়া একটা বই লিখা শুরু করেছে। অনেকটা আত্মজীবনী টাইপ। বইয়ের নামও ঠিক হয়েছে, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। লেখালেখি ভাইয়ার এই প্রথম না। এর আগে বিভিন্ন জার্নালে ৫ টা রিসার্চ পেপার এর পাশাপাশি দু’টো বইও ভাইয়া লিখেছেন। একটি অর্থনীতি বিষয়ক, অন্যটি ধর্মীয়, মহানবী তাঁর সাহাবীদের কাছে কি রকম ছিলেন তার খন্ডচিত্র তুলে ধরা হয়েছে বইয়ে, নাম ইনিই সেই রাসুল। বইটা শুরু এই ভাবে,
“জেরুজালেম বিজয় হয়েছে। আমিরুল মুমিনিন উমর সহ অনেক সাহাবীই উপস্থিত। আল্লাহ’র রাসূল (সাঃ) একবার জেরুজালেমে এসেছিলেন। আল্লাহ কুর’আনে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন, “পবিত্র তিনি, যিনি নিয়ে গেছেন এক রাতে নিজের বান্দাকে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা…” [সূরা আল ইসরা (১৭):১]। সালাতের সময় হয়েছে। বিলাল, যিনি ইসলামের তিন মসজিদেই আযান দেয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন, তিনি আযান দিচ্ছেন। ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বলার সাথে সাথে চার দিক কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আজ রাসুলুল্লাহ নেই। আল্লাহ’র রাসূল, মানব দানব জাতির মুক্তির দূত। আজও মিনার থেকে ভেসে আসে সেই সাক্ষ্য, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ আল্লাহ’র রাসূল।“
বাবার ভ্রু কুঁচকে আছে। এই অবস্থায় তিনি টেলিভিশনের দিকে চেয়ে আছেন। বাবার দেখা দেখি আমিও ভ্রু কুঁচকাতে চেষ্টা করছি, কিন্তু ভ্রু কুঁচকাচ্ছেনা। ক্রিকেট ম্যানিয়া নামক অনুষ্ঠান চলছে। বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ বিষয়ক আলোচনা হচ্ছে। শর্ট স্কার্ট পরা এক উপস্থাপিকা আর একজন ক্রিকেট স্পেশালিস্ট। স্পেশালিস্ট সাহেব এসেছেন গেস্ট হিসেবে। স্পেশালিস্ট সাহেব কে কথা বলার চান্স দেয়া হচ্ছেনা। অনুষ্ঠানের ২০ মিনিট চলে গেল, স্পেশালিস্ট সাহেব কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র দুবার—একবার একলাইন, অন্যবার ‘আশা করা যায়’ শব্দ ত্রয়ী। ‘এইসব মেয়ে, ক্রিকেটের বুঝেনা ‘ক’ এদেরকে যে কেন নিয়ে আসে!’ বেশিরভাগ সময় কথা হচ্ছে ইংরেজী বাক্যে। ইংরেজরা আমাদের দু’শ বছর শাসন করেছে। শাসন না বলে জুলুম বলা যায়। বাংলার বর্তমান বুদ্ধিজীবীদের এই নিয়ে কথা বলতে শোনা যায়না। কেন? এই ‘কেন’ টাইপ প্রশ্নটা আমার না, ভাইয়ার। ইংরেজরা কি শাসন করেছে তা আমার জানা নেই, আমি শুধু জানি সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়েছেন পলাশীর প্রান্তরে। ঢাকা বিশববিদ্যালয় আর বুয়েটের মাঝখানে পলাশীর একটা মোড় আছে, আমি ভাবতাম এটাই সেই পলাশী, ভাইয়ার সাথে আলোচনায় ভুলটা ভাঙল।
ভাইয়ার এক বন্ধু বাসায় এসেছেন। আজ রাতে থাকবেন। ভাইয়ার বন্ধুও ভাইয়ার মতো, লম্বা দাড়ি, বাড়তি হিসেবে লম্বা বাবরি চুল, ভাইয়ার চুল ছোট। ভাইয়ার বন্ধুদের বাবা খুব একটা পছন্দ করেননা, বিশেষ করে দাড়িওয়ালা বন্ধুদের। আমাকে ডেকে বললেন,
- ঐ ছেলেটা কি রাতে থাকবে?
- হুম।
- ছেলেটা কে?
- ভাইয়ার ক্লাসমেট। আরেকবার আমাদের বাসায় এসেছিল।
- রাতে থাকবে কেন?
- আজ চন্দ্রগ্রহণ। রাজিব ভাই টেলিস্কোপ নিয়ে এসেছেন। আমরা টেলিস্কোপে আকাশ দেখবো।
- অহ! তোর ভাইকে বলিস এসব বন্ধু পন্ধু এখন না আনতে, খাল কেটে কুমির আনার দরকার নেই।
কিছুক্ষণ পরই আকাশ ছেয়ে গেল কালো মেঘে। আমরা বৃষ্টিতে ভিজলাম। আমি, ভাইয়া আর তার বন্ধু, আরেকজনও যোগ দিয়েছেন মতিন আংকেল, বাড়ির মালিক। আমার কাছে হঠাৎ করে মনে হলো পৃথিবীটা কত সুন্দর, আল্লাহ কত সুন্দর করে সব সাজিয়েছেন আমাদের জন্য। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে সবার ওপর, ভালো মন্দ সবার ওপর। পবিত্র পানি গায়ে মেখে মনে হয় পবিত্র হচ্ছি। কুৎসিত এই শহর পবিত্র হচ্ছে।
বৃষ্টি থেমে গেল গ্রহণ শুরুর কিছুক্ষণ আগেই। আকাশ পরিষ্কার, ধপধপে পরিষ্কার। ভাইয়া আর তার বন্ধু টেলিস্কোপ নিয়ে আছেন, আমি ফ্লাস্কে করে নিচ থেকে চা নিয়ে এলাম, সাথে ওয়ানটাইম গ্লাস। পৃথিবীর ছায়া একসময় চাঁদের ওপর পড়তে শুরু করল। আমরা তিনজন গ্রহণের নামাজ পড়লাম। চন্দ্র-সূর্য গ্রহণের নামাজ সম্পর্কে আমি এই প্রথম জানলাম। জীবনের এই প্রথম অন্তর দিয়ে কোন নামাজ পড়লাম। বিশ্ব জাহানের মালিকের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। ভাইয়া কুর’আনের একটা আয়াত বলল, যতদূর মনে পড়ে আয়াতটি এই রকম, ‘বলো, আমি চন্দ্র সূর্যকে সিজদাহ করিনা, আমি সিজদাহ করি তাকে যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন।‘
টেলিস্কোপে একের পর এক গ্রহ নক্ষত্র দেখছি। পৃথিবীর আকাশে যে খালি চোখে সৌরজগতের অনেকগুলো গ্রহ দেখা যায় তা জানা হলো। টেলিস্কোপ এ শনির রিং পর্যন্ত দেখা যায়। টেলিস্কোপে দেখার পর্ব শেষ হলো। আমরা তিনজন, ছাদে মাথা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছি। অনন্ত নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে।
- স্যাটার্ন কত দূরে জানিস?
- না।
- পৃথিবী থেকে সূর্যের যেই দূরত্ব, সূর্য থেকে স্যাটার্ন এর দূরত্ব এর ১০ গুণ বেশি। ১৪০ কোটি কিলোমিটার এর বেশি। আল্লাহ’র সৃষ্টি অনেক বড়! কত বড় এটা কল্পনার বাইরে। পৃথিবীর আকাশে যে এন্ড্রোমিডা দেখা যায় জানিস?
- না।
- তবে ঢাকার আকাশে দেখা যাবেনা। এখানে লাইট পলিউশান অনেক, এখানে তো আমি কখনো মিল্কি ওয়েই দেখতে পাইনি ঠিকভাবে। পৃথিবীর আকাশে সবচেয়ে বড় যে তারাটি দেখা যায়, তার নাম কি জানিস?
- শুকতারা।
- শুকতারা তো মূলত তারা নয়, গ্রহ। লুব্ধক। নাম শুনেছিস?
- হুম।
- ইংলিশ নাম সিরিয়াস। প্রাচীন মিশরের দিকে এর পূজা করা হতো। অনেকে মনে করতো মানুষ এর পূর্বপুরুষ এই সিরিয়াস থেকে এসেছে। কুর’আনে সিরিয়াস নিয়ে বলা আছে জানিস?
- না।
- সূরা নজমে আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ তিনিই যিনি সিরিয়াস এর রব।’