লাশটা পড়ে আছে পান্থপথের মোড়ে। সম্ভবত পনেরো মিনিট আগে কোন একটা বাস এসে মেয়েটার মাথাটাকে একেবারে মিশিয়ে দিয়ে গেছে রাস্তার সাথে। আশ্চর্যজনক কোনো কারণে পুরো শরীরটা একেবারে অক্ষত আছে। অল্প কিছু ধুলো গায়ের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার মত কাপড়ে লেগে আছে। পাশে থাকা ভিক্ষুক নানা দৌড়ে আসলো। চারপাশ থেকে মানুষগুলো দৌড়ে আসছে বাতাসের মতো।
মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে সম্মোহিতের মতো। সারি সারি মানুষ। কেউ ভয়ে খুব বেশি কাছে যাচ্ছে না। এরই মধ্যে কোথা থেকে যেনো কাকেরা খবর পেয়ে গেছে। পান্থপথের এই ব্যস্ত রাস্তাটাতে গাছেরা হারিয়ে গেছে সেই কোন কালে। তাই কাকও খুব একটা পাওয়া যায় না। কে জানে হয়তো কারেন্টের তারে হঠাৎ এসে বসা কোন কাক বাকিদের খবর দিয়েছে। এরা গোল গোল করে উড়ছে। সারিবদ্ধভাবে।
সারি সারি মানুষের মাঝের একজন বলে উঠল "ভাইয়েরা কাছে যাইয়েন না। পুলিশ আইতে দেন। সইরা দাঁড়ান। সইরা দাঁড়ান ভাইসাবেরা।
ঠিক পনেরো মিনিট এর মাথায় পুলিশের একটা গাড়ি এসে থামলো। মানুষের ভিড় কিছুটা পিছিয়ে দাঁড়ালো। পুলিশ মেয়েটির ব্যাগ খুঁজে বের করবার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে কেউ একজন মনে হয় সরিয়ে ফেলেছে কোনো ফাঁকে। মেয়েটির পরিচয় খুঁজে পাওয়া সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। মাথাটা এমনভাবে থেঁতলে গেছে যে নিজের মা চিনবে কিনা সন্দেহ। মেয়েটা স্বল্পবসনা। যতখানি না ঢাকলেই না শুধু ততটুকুই ঢাকা।
ভিড়ের মাঝে এক তরুণ কে কিঞ্চিৎ অস্থির মনে হলো। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়। পায়চারি করতে থাকা সবথেকে শুকনা বোকাবোকা চেহারার পুলিশের দিকে এগিয়ে গেলো তরুণ।
- স্যার।
শুকনা পুলিশ ঘুরে তাকালো। কপাল বিরক্তিতে কুঁচকে আছে।
- স্যার মেয়েটাকে আমি চিনি মনে হয়।
- পুলিশের সাথে ফাইজলামি করেন নাকি। ফাজিল কোথাকার! হাজতে ঢুকায় দিলে টের পাবেন।
তরুণকে কিছুটা কাচুমাচু মনে হলো। তবু সে একবার লাশের দিকে তাকালো। আবার উনাকে বলল—
- মেয়েটা আমার ফেইসবুক ফ্রেন্ড। এই যে মানচিত্রর মত কালো জন্মদাগ এইটা বহুবার দেখেছি এর ছবিতে। দিনে আপলোড করা পঞ্চাশ খানা ছবির মধ্যে কোনো কোনোটাতে এই জন্মদাগটা তো প্রায়ই তো চোখে পড়তো।
তরুণ মেয়েটির জন্মদাগের দিকে আঙুল তুলে দেখালো।
- তুই তো দেখি বিরাট বদ। জন্মদাগ দেখে মেয়েমানুষ চিনে ফেলছিস।
শুকনা পুলিশ থু করে একদলা থুথু ফেলল। ছেলেটি লাফ দিয়ে একটু পিছিয়ে দাঁড়াল। অল্পের জন্য পা টা বেঁচে গেছে। মোটাসোটা পুলিশ আর লম্বু পুলিশ এগিয়ে এলো।
ছেলেটার কাছ থেকে আরও একবার শুনে তিনজন পুলিশকে এবার কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে।
- এই মেয়ের একাউন্টে ঢোক দেখি।
পুলিশের কন্ঠ কিছুটা নরম মনে হলো।
প্রোফাইলের নাম অনামিকা। ভিড়ের মাঝে গুঞ্জন উঠেছে অনামিকা অনামিকা। বায়োতে লেখা, "কনফিডেন্স ইস ওপেনিং আপ।"
তার এলবাম এ ঢোকা হয়েছে। এলবামের নাম, "শো ইওর বিউটি, বি কনফিডেন্ট।" শত শত ছবি। লাস্ট ছবি আপলোড করেছিলো ৪৫ মিনিট আগে। ক্যাপশন লেখা, "ট্রিটিং মাইসেল্ফ এট বসুন্ধরা সিটি, বওট সাম গার্লি থিংসজ, হিহি।"
মোটা পুলিশ লম্বু পুলিশকে বলে উঠলো, "দেখ দেখ এই মাইয়াই তো মনে হয়। জামা কাপড় তো এইটাই মনে হয়।"
তিন পুলিশ মোবাইল স্ক্রিনে ঝুঁকে আছে। স্ক্রল করে আরো নিচে নামতে থাকে তারা।
- আরেহ তাই তো জন্মদাগ তো একইরকম।
- স্যার আরও দেখেন। ক্লু পাইতে পারেন আরও।
ছবির পর ছবি। ঘাড়ের কাছে সাপের উল্কি দেখা যাচ্ছে। একেবারে ছোট।
মোটা পুলিশ বলে উঠলো লাশটা উলটা দেখি। সাপের ছবি পাই নাকি। একটা ছেনির মত লম্বা লাঠি দিয়ে লাশটাকে উলটে দেয়া হলো।
- আই রহমত, একটা চাদর দিয়া মাইয়াটার পা দুইটা ঢাকো দেখি। মানুষগুলার বলিহারি! এক মুণ্ডু ছাড়া লাশের পায়ের দিকে কেমনে তাকায় আছে।
- স্যার দেখেন দেখেন। সাপের ছবি। ছবির মতো।
।।
অনামিকার প্রোফাইল ইনফোতে সিবলিং লিস্ট দেয়া আছে। এত এত ব্রাদার সিস্টারদের মধ্যে কেউই তার সহোদর না। বেশ খানিকটা সময় ক্ষেপণ করে এক ভাইয়ের মতো সিবলিং মারফত বাসায় খবর দেয়া হয়েছে।
ফোনের ওইপাশে তীক্ষ্ণ কান্নার শব্দ পাওয়া গেল। মোটা পুলিশ ফোন কেটে দিলো। তার তীক্ষ্ণ কান্নার আওয়াজ সহ্য হয় না। মাথা ব্যথা করে। কোনো একটা বিচিত্র কারণে মাথার একপাশ ব্যাথা করে।
বোকাবোকা দেখতে পুলিশ সাহেবকে বেশ প্রসন্ন মনে হচ্ছে। হাসি হাসি মুখ করে তাকে বলতে শোনা গেলো, "ভাগ্যিস পোলাটা আসিলো। আর মাইয়াটা ভঙ্গী কইরা ছবি দিতো। নইলে স্যার ওই কেইসটার মত হইতো। ওইযে ১৫ দিন পরিবারের সন্ধান পাইতেসিলাম না। কি যন্ত্রণাই হইছিলো।"
।।
অনামিক নামের মেয়েটির লাশটাকে পর্দা খাটিয়ে ধোয়া হচ্ছে। মুন্ডুছাড়া লাশ। কেউ ধোয়াতে চায় না। শেষ পর্যন্ত একজন কে পাওয়া গেছে। একে আবার সাত হাজার টাকা দেয়া লাগবে। ধবধবে সাদা কাপড়ে মেয়েটাকে যত্ন করে পেঁচিয়ে দেয়া হচ্ছে। শরীরের কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। একেবারে কিছুই না।
সাধারণত লাশের মুখের পাশের কাপড়টাতে লাস্ট গিট দেয়ার আগে সবাইকে দেখতে দেয়া হয়। একে নিয়ে এই ভেজাল নাই।
মসজিদ থেকে মাওলানা ডাকা হয়েছে। মাওলানা সুর করে কুরআন পড়া শেষে অনামিকার হয়ে মাফ চাইবার চেষ্টা করছে।