কট্টর ছাত্রলীগার একজনকে চিনতাম। আমরা যখন হলে উঠি তখন থেকেই একনামে তাকে সবাই চিনত। সবাই তার ভয়ে তটস্থ থাকতাম। ঢাবির হলে সিট বরাদ্ধ পেয়ে আরাম করে সেই সিটে উঠে পড়ার সিস্টেম নেই, ফার্স্ট ইয়ারে তো কল্পনাই করা যায় না। পরিচিত কারো মাধ্যমে ছাত্রলীগের 'ভাইয়া' ধরে কোনমতে গণরুমে থাকার একটু ব্যবস্থা হয়। হলে ছাত্রলীগের গ্রুপ থাকে, হলে উঠতে হলে কোন না কোন গ্রুপের আন্ডারে উঠতে হয়। সেরকম একটা গ্রুপের 'বড় ভাই' ছিলেন ভদ্রলোক, সামনের কমিটির পদ প্রত্যাশী। আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত ছিলো, হলে একটা ছেলেও পাওয়া যাবে না, যার মনে ঐ পাতি নেতার জন্য ক্ষোভ নেই। সমস্ত ছেলের অন্তরের বদ-দু'আ তার সাথে আছে, এবিষয়ে আমরা সবাই একমত ছিলাম। পলিটিক্স করতে গিয়ে ইয়ার ড্রপ দিতে দিতে নিজের ছাত্রত্ব বাতিল হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আমাদের বেশ সিনিয়র হলেও একসময় আমাদের জুনিয়রে পরিণত হলেন। রাজনীতির পেছনেই লেগে থাকতেন। সেই রাজনীতির জন্য, একটা পদের জন্য সবার সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করতেন, ঐ যে বললাম—সবার অন্তরের বদ-দু'আ তার সাথে আছে।
অবশেষে কমিটি হলো। পুরো ছাত্রজীবন ধরে রাজনীতি করে যাওয়া সেই ভদ্রলোক কোন পদ পেলো না। হল কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটি কোথাও না। মুহূর্তেই পুরো দৃশ্যপট চেঞ্জ হয়ে গেলো। একসময় যার ভয়ে সবাই তটস্থ থাকতো, অনেক দূর দিয়ে গেলেও ছুটে গিয়ে হাত মিলাতে সবাই দৌড়াদৌড়ি করতো, এখন সামনে পড়লেও তার দিকে কেউ তাকিয়েও দেখে না। হলের ক্যান্টিন থেকে এখন আর তার জন্য খাবার যায় না, প্রায়ই দেখতাম চুপি চুপি এসে ক্যান্টিনের এক কোণায় বসে খাবার খাচ্ছে, হাতে চাকরীর পরীক্ষার বই নিয়ে ঘুরছে। একদিন তার সময় ছিলো, সেই সময়ে সে মানুষের সাথে যেমন আচরণ করেছে, যখন সময় চলে গেলো, তাকে দেখেই এখন সবাই করুণার চোখে তাকায়।
বন্ধুদের অনেকেই রাস্তায় বাস ভাংচুর করে, ক্যাম্পাসে মারামারি করে, হলে শিবির পিটিয়ে এসব পাতি নেতাদের ডান হাত, বাম হাত হয়েছিলো। পড়াশোনা শেষে এখন রোজ নিয়ম করে লাইব্রেরীতে চাকরীর পড়াশোনা করছে। আগের সেই চলন বলন আর নেই, দেখা হলেই গলার স্বর নিচু।
কোটা আন্দোলনের রাশেদ আমার ভার্সিটির ছোটভাই। নিতান্তই সহজ সরল ছেলে। কারো সাতে পাঁচে নেই। হঠাৎ একদিন দেখি পত্রিকা, টিভি সব জায়গায় তাকে দেখাচ্ছে। কৌটা আন্দোলনের মূল নেতৃত্ব দিচ্ছে। যারা এই ছেলেগুলোকে নির্লজ্জের মত পেঠাচ্ছে তাদের কারো কারো চেহারাও চেনা, খুব পরিচিত। এরা সেইসব পাতি নেতা। সামনে কমিটি হবে, পদপ্রার্থী। পত্রিকায়, ফেসবুকে, টিভি ক্যামেরার সামনে কিল, ঘুসি, লাথি মারার চমকপ্রদ পোজগুলো এদের পদ পাওয়ার যোগ্যতা। এগুলো দেখিয়েই তারা কমিটিতে পদ পাওয়ার যোগ্য এটা প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু সময় বড় অদ্ভুত জিনিস। একদিন তোমাদেরও সময়টা পাল্টে যাবে, সবারই যায়। কুত্তার দামও একদিন কেউ তোমাদের দিবে না। সেই সময়টা আসবে, আলবৎ আসবে।
মানুষের অভিশাপ, বদ'দু'আ, নিঃশব্দে দু'ফোটা চোখের পানি, আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ভারি দীর্ঘশ্বাস—খুবই ভয়াবহ জিনিস। আল্লাহ্ রাব্বুল ইযযাতের দরবারে যদি একটা বদ'দু'আ কবুল হয়ে যায়, যদি এক ফোঁটা চোখের পানি আরশ মহলে পৌঁছায়, সেটাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। 'হাসবুনাল্লা-হু ওয়া নি'মাল ওয়াকীল