একটা মেয়েকে ‘মেয়ে’ মনে হয় কত বয়স থেকে? আমাদের দেশের হিসেবে ১২-১৩ বছর থেকে। তারপর তার বয়সটা যখন ত্রিশ পার হয়, তখন আর বাচ্চারা তাকে ‘আপু’ বলে ডাকে না। ‘আন্টি’ বলে ডাকা শুরু করে। এমনকি ছোট ছোট বাচ্চারাও বুঝে যায় উনি আর ‘আপু’ ডাকার বয়সে নেই। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, একটা মেয়ে তার রূপ দিয়ে খুব বেশি হলে ১৫ বছর পৃথিবীর ওপর ছড়ি ঘুরাতে পারে।
তারপর আস্তে আস্তে সে চেহারায় লাবণ্য হারাতে শুরু করে। শরীরে মেদ জমতে শুরু করে। ১৮ বছরের ফটোজেনিক লুকের সাথে তার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের ক্লান্ত চেহারাকে কিছুতেই মেলানো যায় না। মাত্র ১৫ বছর রূপের দেমাগ দেখানোর জন্য সে আল্লাহর বিধানকে কাঁচকলা দেখিয়েছে। চুল ছেড়ে দিয়ে, কড়া পারফিউম লাগিয়ে, নিজেকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করে বহু ছেলের অশ্লীল চিন্তার খোরাক হয়েছে।
আমার এক রিলেটিভকে পর্দার দাওয়াত দেয়ার পর সে আমাকে বলেছিল, “আল্লাহ যদি আমাকে কবরে আযাব দিতে দিতে মেরেও ফেলে, তবুও আমি বোরখা পরব না।” এমন না বোরখা পরলে তার হাসফাস লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। বরং, টাইট ফিট জিন্সের সাথে ফতুয়া পরার পর সবার দৃষ্টি সে উপভোগ করে। ভাবে, “কতো ছেলে আমার জন্য পাগল!”
এ জন্য দেখা যায়, রূপে-পাগল হয়ে যেসব কাছে আসার গল্পের শুরু হয়, সেগুলো সচরাচর মেয়েরা মাঝ বয়সী হয়ে যাবার আগেই শেষ হয়ে যায়। এ জন্যই হয়তো ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলিট ক্লাস মহিলাদের ডিভোর্স হয় মাঝ বয়সে। যখন স্বামী তার দেহে আর আকর্ষণ খুঁজে পায় না। মেয়েরা স্বাবলম্বী না হলে সন্তানদের মুখ চেয়ে অবহেলা মেনে নেয়। আর একটু ইনকাম করলে নিজেই ডিভোর্স দিয়ে দেয়। এ কারণে শিক্ষিত স্বাবলম্বী মেয়েরাই রয়েছে ডিভোর্সের শীর্ষে। [বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৯ জানুয়ারি ২০১৮: শিক্ষিত স্বাবলম্বী নারীরাই ডিভোর্সের শীর্ষে]
এখানে মোটেও এটা বলা হচ্ছে না, ছেলেরা যত ইচ্ছা অত্যাচার করবে, আর মেয়েরা লক্ষ্মী বউয়ের মত সব অত্যাচার সহ্য করবে। আর আমাদের দেশের যেসব নারীরা স্বামীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে শেষ রাস্তা হিসেবে ডিভোর্সকে বেছে নেয়, তারাও এখানে আলোচনার বাইরে।
আজকাল সামান্য কারণেই ডিভোর্স দেয়াটা প্রমাণ করে, নারীরা কতটা কঠিনভাবে ওয়েস্টার্ন কালচারকে আঁকড়ে ধরেছে। এমন ফ্যামিলি কোথায় আছে যেখানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বড় রকমের ঝগড়া হয়নি? আমাদের রাসূল (সা)-ই তো স্ত্রীদের সাথে এক মাস দেখা করেননি, কথা বলেননি রাগ করে। যেহেতু, নারী-পুরুষের সাইকোলজিকাল ব্যাপারগুলো আলাদা, মতপার্থক্য থেকে এমন ঝগড়া সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে আধুনিক লাইফস্টাইলে বড় হওয়া নারীরা তখন সন্তানের দিকে চেয়ে কম্প্রোমাইজ করার চেয়ে ফ্রীডম অফ লাইফের দিকে বেশি ঝুঁকে। ফলাফল? ডিভোর্স, তিক্ততা, ছোট ছোট সন্তানগুলোর যথাযথ গাইডলাইন ছাড়া অপরাধপ্রবণ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা।
আমরা হয়তো যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারব না কেন ছোট ছোট কারণে সংসার ভেঙ্গে ফেলা খারাপ, কেন যার তার সাথে অবাধ যৌনতায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়া খারাপ; কিন্তু আমরা এ কাজগুলোর ফলাফল আপনাদের চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দিতে পারব। আপনাদের কাছে হয়তো “পারস্পরিক-সম্মতি” শরীয়াত হিসেবে চূড়ান্ত। এটা থাকলে আপনাদের ধর্মে অবাধ যৌনতা, সমকামিতা, অজাচার—সব বৈধ হয়ে যায়। কিন্তু এগুলো আমাদের সমাজকে কী উপহার দিচ্ছে তা কি একবার ভেবে দেখার ফুরসত মিলবে? জানি আমি বললে বিশ্বাস হবে না। তাই দলীল দিচ্ছি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বই থেকে—
"একটি আমেরিকান পরিবারের জীবনচর্চা চিন্তা করলে কষ্ট হয়। ওরা কি হারাচ্ছে তা বুঝতে পারে না। আমরা যারা বাইরে থেকে আসি—বুঝতে পারি কিংবা বোঝার চেষ্টা করি।"
একটা শিশুর জন্ম থেকে শুরু করা যাক।
সর্বাধুনিক একটি হাসপাতালে শিশুটার জন্ম হল। বিশ্বের সেরা ডাক্তাররা জন্মলগ্নে শিশুটির পাশে থাকলেন। সে বাসায় ফিরল কিন্তু মায়ের কোলে ফিরল না। তার আলাদা ঘর। আলাদা খাট। কেঁদে বুক ভাসালেও মা তাকে আলাদা খাবার দেবেন না। ঘড়ি ধরে খাবার দেবেন। সে বড় হতে থাকবে নিজের আলাদা ঘরে। এতে নাকি তার ব্যক্তিসত্তার বিকাশ হবে।
শিশু একটু বড় হল। বাবা-মায়ের কাছে নয়, বেশির ভাগ সময় থাকতে হচ্ছে বেবী কেয়ার কিংবা বেবী সিস্টারদের কাছে।
তার চার-পাঁচ বছর বয়স হবামাত্র শতকরা ৮০% সম্ভাবনা, সে দেখবে, তার বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছেন। এ ঘটনায় তারা যেন বড় রকমের শক না পায়, তার জন্যেও ব্যবস্থা করা আছে। স্কুলের পাঠ্যতালিকায় বাবা-মা আলাদা হয়ে যাবার সমস্যা উল্লেখ করা আছে।
শিশুটির বয়স বার পার হওয়ামাত্র স্কুল থেকে তাকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের সাজসরঞ্জাম সরবরাহ করা হবে। এটি নতুন হয়েছে। যাতে যৌন রোগে আক্রান্ত না হয় সেই ব্যবস্থা। বয়োসন্ধি সময়ে যখন তারা মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনে হকচকিত, সেই সময়টা তাদের কাটাতে হবে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর খোঁজে—যাদের পরবর্তী সময়ে বিয়ে করবে। কি ভয়াবহ সেই অনুসন্ধান। একটি মেয়েকে অসংখ্য ছেলের মধ্যে ঘুরতে হবে যাতে সে পছন্দমত কাউকে খুঁজে পায়। সময় চলে যাবার আগেই তা করতে হবে। প্রতিযোগিতা-ভয়াবহ প্রতিযোগিতা।
উনিশ-কুড়ি বছর বয়স হল—বেরিয়ে যেতে হবে বাড়ি থেকে। এখন বাঁচতে হবে স্বাধীনভাবে। নিজের ঘর চাই। নিজের বাড়ি চাই। কোন একটি চাকরি দ্রুত প্রয়োজন।
চাকরি পাওয়া গেল। তাতেও কোন মানসিক শান্তি নেই। চাকরি সবই অস্থায়ী। কাজ পছন্দ হল না তো বিদায়। সংসার প্রতিপালন করতে হচ্ছে এক ধরনের অনিশ্চয়তায়। অনিশ্চয়তায় বাস করতে করতে অনিশ্চয়তা চলে আসছে তাদের আচার-আচরণে। তাদের কোন কিছুই একনাগাড়ে বেশি দিন ভাল লাগে না। এক বাড়িতে বেশি দিন থাকতে পারে না, বাড়ি বিক্রি করে নতুন বাড়ি কেনে। এক স্টেটে বেশি দিন বাস করতে ভাল লাগে না। কাজেই ইস্ট থেকে ওয়েস্ট। ওয়েস্ট থেকে নর্থে। এক স্ত্রীকেও বেশি দিন ভাল লাগে না। গাড়ির মত স্ত্রী বদল হয়।
এই করতে করতে সময় ফুরিয়ে যায়। আশ্রয় হয় ওল্ড হোম। জীবনের পরিণতি। এক সময় মৃত্যুবরণ করতে হয়। মৃত্যুর পর দেখা যায় তারা তাদের ধনসম্পদ উইল করে দিয়েছে প্রিয় বিড়ালের নামে, কিংবা প্রিয় কুকুরের নামে।
আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় যা বুঝেছি তা হল—এদের প্রায় সবার চিন্তা-ভাবনা সীমাবদ্ধ। বস্তুকেন্দ্রিক। একটি মেয়ের জীবনের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা হল চিয়ার লীডার হবে। ফুটবল খেলার মাঠে স্কার্ট উঁচিয়ে নাচবে। স্কার্টের নিচে তার সুগঠিত পদযুগল দেখে দর্শকরা বিমোহিত হবে। এই তার সবচে’ বড় চাওয়া। একটা ছেলে চাইবে মিলিওনীয়ার হতে।
এই অতিসভ্য (?) দেশে আমি দেখি মেয়েদের কোন সম্মান নেই। একজন মহিলাকে তারা দেখবে একজন উইম্যান হিসেবেই। একটি মেয়ের যে মাতৃরূপ আছে, যা আমরা সব সময় দেখি, ওরা তা দেখে না। একটি মেয়ে যতদিন পর্যন্ত শারীরিকভাবে আকর্ষণীয় ততদিন পর্যন্তই তার কদর………।
জাতির শরীর যেমন আছে আত্মাও আছে। এই দেশের শরীরের গঠন চমৎকার কিন্তু আত্মা? এর আত্মা কোথায়?
[আপনাকে আমি খুঁজিয়া বেড়াইঃ ১০২-১০৩]
এ দেশের নারীবাদীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় স্লোগান দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম, “আমার দেহ আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব”—এটা দিয়েই শেষ করি। এ স্লোগানটা মোটেও আমাদের দেশের নারীবাদীদের নিজস্ব আবিষ্কার না। পুরোটাই ওয়েস্টার্ন ফেমিনিস্টদের থেকে ধার করা। আমাদের সময়ে এমন একজন পপুলার ফেমিনিস্ট হচ্ছেন Jessica Valenti. তিনি তার বই ‘The Purity Myth’- এ দাবী করেছেন মেয়েরা আসলে পুরুষদের মতই। তাদের উচিত পুরুষদের মতই অবাধ যৌনতার জীবন-যাপন করা। দেহটা তোমার, জীবনটাও তোমার। কেন আরেকজনের কথা শুনবে? আকাশ থেকে ঈশ্বর কাকে কী বলেছেন তা নিয়ে তোমার মাথা-ব্যাথা থাকবে কেন?
খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারেন বলে উনার মতো অনেক ফেমিনিস্টের বক্তব্যকেই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তরুণরা লুফে নিয়েছে। পাড়ি দিয়েছে যৌনতার সমুদ্রে। কিন্তু এর ফলাফল কী হয়েছিল? শুধু যে এটা তাদের সমাজ কাঠামোকে ভেঙ্গে ফেলেছে তা নয়, এটা তাদের মানসিকতাকেও ভেঙ্গে ফেলেছে। সেটা নিয়ে মজার একটা গল্প বলে শেষ করি।
মেয়েটার নাম অলিভা। সে ফেমিনিস্টদের আকিদায় বিশ্বাসী। বিশ্বাসী দেহ-স্বাধীনতায়। মেডিকেলে পড়া অবস্থায় এক ছেলের সাথে পরিচয়। ঘনিষ্ঠ হতেও সময় লাগল না। বয়ফ্রেন্ডের সাথে রাত কাটানোর পর দেখল আর বনিবনা হচ্ছে না। সাথে সাথে ব্রেক-আপ। সমস্যা হচ্ছে, মন থেকে কিছুতেই বয়ফ্রেন্ডের স্মৃতিকে সে মুছে ফেলতে পারছে না। ইচ্ছামত মদ খাচ্ছে, বমি করছে। কোনো ফায়দা নেই। অবস্থা বেগতিক দেখে অলিভা স্মরণাপনন্ন হয় Dr. Grossman এর কাছে। যিনি পরবর্তীতে তার বই ‘Unprotected’- এ অলিভার এ ঘটনা বর্ণনা করেন।
অলিভা ডাক্তারের কাছে এসে জানায় নিজের জীবনের গল্প। সে স্বাধীনচেতা মেয়ে। এক ছেলের কাছেই সারাজীবন পড়ে থাকতে হবে এরকম খেত চিন্তায় সে বিশ্বাস করে না। কিন্তু কেন যেন মন থেকে তার বয়ফ্রেন্ডের স্মৃতি সে মুছতে পারছে না। ওদিকে, ছেলেটা দিব্যি ঠিকমত ক্লাস করছে, ল্যাব করছে। কিন্তু ওকে ক্লাসে দেখলেই অলিভার মরণ! কিছুতেই আর অন্যদিকে মন দিতে পারে না সে।
একটা মেয়ের কাছে সম্পর্ক মানে কেবল দেহ-সর্বস্বতা নয়। ছোটখাট কিছু ব্যাপার, যেমনঃ সেন্স অফ হিউমার, মমতা, একটু আলাদা কেয়ার করা; এসবকিছু অধিকাংশ মেয়ের কাছে দেহের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বেশি ভালো লাগার বিষয়। অন্যদিকে অধিকাংশ ছেলেদের কাছে নারী-পুরুষ রিলেশন মানেই যৌনতা। উদ্যম যৌনতার চেয়ে তার সঙ্গিনী যে উষ্ণ আলিঙ্গন বেশি পছন্দ করে এটা তার মাথায় ধরে না। আল্লাহ তা‘আলা নারী-পুরুষকে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। এখানে লজ্জার কিছু নেই। বরং, পার্থক্যটা মেনে নেয়ার মাঝেই আছে কল্যাণ।
সমস্যা হচ্ছে, ফেমিনিস্টরা এ পার্থক্যকে মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে চায় না। যার কারণে নিজেদের সত্তার কাছেই একসময় আটকে পড়ে। কেউ স্বীকার করে, আর কেউ করে না। পার্থক্য শুধু এতোটুকুই। Dr. Grossman অলিভাকে কী চিকিৎসা দিয়েছিলেন জানা যায়নি। তবে যা বলেছিলেন তাতে যেন গল্পের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের আক্ষেপই ভেসে উঠেছে—‘এর আত্মা কোথায়?’ Dr. Grossman অলিভাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—
“Do they tell you how to protect your body from herpes and pregnancy, but they don’t tell you what it does to your heart?” [Unprotected, Page: 3]