আমার সবসময়েই পাহাড়ের প্রতি অদ্ভুত টান। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে যখন আমাদের প্রিয় ম্যাডাম স্যারদের সঙ্গে সিলেট বেড়াতে গেছি, মাধবকুন্ড ঝর্ণার সামনে আমার একটা ছবি আছে, সবাই ঝর্ণার সামনে হাসিমুখে বসে আছে, আমি উল্টোদিকে ফিরে হা করে পাহাড় দেখছি। অনার্স শেষ বর্ষে স্টাডি ট্যুরে ইন্ডিয়া না নেপাল যাব – এই তর্কে আমার আর ব্লগার মনপবনের প্রবল আপত্তিতে ইন্ডিয়ার প্রস্তাব ধোপেই টেকেনি। দশদিন ধরে পাহাড় দেখতে পারব – এই আনন্দেই আমি অধীর হয়ে ছিলাম।
পাহাড় নিয়ে আমার অতি আগ্রহের কথা আমার স্বামী খুব ভালভাবেই জানে। জানে, কেবলমাত্র হাইকিং এর সুযোগ থাকলেই আমাকে বেড়াতে নিয়ে খুশি করা যাবে। তাই সেমিস্টারটা শেষ হতেই চলে এসেছি আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে, উদ্দেশ্য পর্বত দর্শন ও আরোহণ, তার পাশাপাশি আরো যা কিছু বোনাস হিসেবে পাওয়া যায়..
এখনও ট্রিপ শেষ হয়নি। গত সাত দিনের প্রতিটি দিন পাহাড়ে চড়েছি। অ্যাজমার জন্য শরীরে কুলোয়নি, তবু থেমে থেমে যে করেই হোক, পাড়ি দিয়েছি – যতটুকু পথ নিয়ে যায়। এর মধ্যে পাহাড় চূড়া থেকে কত… যে রূপ দেখলাম.. আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে হারিয়ে গিয়ে চিনলাম সর্বশ্রেষ্ঠ স্থপতি, সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী, সর্বশ্রেষ্ঠ সংগঠক কে।
He is God, the Creator, the Maker who shapes all forms and appearances! His [alone] are the attributes of perfection. All that is in the heavens and on earth extols His limitless glory: for He alone is almighty, truly wise! [59:24]
আমাদের পাঁচজনের এই গ্রুপের অনন্য দিক হল, কমবেশি মাত্রায় প্রত্যেকেই আল্লাহভক্ত, এবং উঁচুমাত্রার দর্শন আলোচনায় কারো কোন ক্লান্তি নেই। তাই পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে জামাতে নামাজ বা লং ড্রাইভে স্কলারদের লেকচার শোনাই কেবল নয়, কার দৃষ্টিতে এইসব সৌন্দর্য কী উপলব্ধি এনে দিয়েছে, তা শোনারও সুযোগ হয়েছে অনেক। এর অল্প কিছু এখানে বলি –
ইয়োসিমিটি ন্যাশনাল পার্ক (ক্যালিফোর্নিয়া) তে অর্ধবৃত্তাকার এক পাহাড় আছে, একে হাফ ডোম বলে। এ পাহাড়ের উত্তল অংশটাতে দশফুট পরপর স্টিক গুঁজে চেইন দিয়ে ট্রেইল করা হয়েছে। অবিশ্বাস্য রকমের কঠিন হাইক। কঠিন বলেই হয়ত, মানুষের আকর্ষণও বেশি। তাছাড়া আশপাশের সবকিছু মিলিয়ে এই পাহাড়ের নান্দনিক সৌন্দর্য বলে বোঝানো যাবে না। হাফ ডোম একটা সেলিব্রিটি পর্যায়ের পাহাড়, তাকে নিয়ে বিভিন্ন গল্পও চালু আছে শুনেছি। ত যাই হোক, আমাদের মধ্যে একজন বলল, এই পাহাড়টার যদি এমন করে প্রচার প্রসার করা না হত, একে কি এতটাই সুন্দর লাগত? আমরা বললাম, লাগত, কারণ পাহাড়টা ইউনিক। ও তখন একটা গল্প শোনাল, নিউইয়র্কের সাবওয়ে স্টেশনে এক নামকরা মিউজিশিয়ান এককোণে দাঁড়িয়ে পারফর্ম করছিল, কেউ ফিরেও তাকায়নি। আমরা আসলে উপযুক্ত জায়গায় উপযুক্ত ব্যাকআপ ছাড়া সৌন্দর্যটাও ঠিক মত এপ্রিসিয়েট করতে পারিনা। তখন আমার ব্লগার মনপবনের এভারেস্ট বিজয় নোটটার কথা মনে পড়ে গেল – কে-২ পর্বতচূড়ায় আরোহন অনেক বেশি কঠিন হলেও তা নিয়ে মানুষ এত হইচই করেনা, যতটা করে এভারেস্ট নিয়ে।
সে হাফ ডোম দূর থেকে দেখবার জন্য একটা ‘গ্লেসিয়ার পয়েন্ট’ নামে একটা জায়গা আছে, সেখানে ভীষণ মানুষের ভিড়। আমরা ‘দুত্তোরি ছাই’ বলে চলে গেলাম একটু দূরে, অল্প কিছু পাথরের আড়ালে। হইচই, ভিড়বাট্টা সব দূরে চলে গেল। চোখের সামনে শুধু কালো গ্রানাইট পাথরের রূক্ষ উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে একে বেঁকে যাওয়া শীর্ণ গিরিপথ, অনেকের মধ্যে থেকেও সগৌরবে অনন্য হাফ ডোমের আত্মগরিমা, আর একটু দূরে প্রচন্ড গর্জনে ধেয়ে আসা সফেন, নাম না জানা এক ঝর্ণা। কোন মানুষের শব্দ নেই, শুধু ঝর্ণার গর্জন, পাখির ডাক, পাথরের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা আমরা কজন। ওপাশে সূর্য আজকার মত বিদায় নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশে তাকিয়ে দেখি আমার প্রিয় এক আপুর চোখে পানি, আপন মনেই বলল, এসবের কাছে নিজেকে কতটা ছোট মনে হয়! এই এতসব সৃষ্টির মাঝে আমরা কত তুচ্ছ! আর তার চেয়েও কত.. কত… তুচ্ছ আমাদের সমস্যাগুলো….
আপুর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চোখ রাখলাম পাহাড়সীমায়। চিরচেনা কথাগুলো আবারও নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে নতুন মনে হল।
ইউটাহ থেকে ইয়োসিমিটি পার্ক এ যাওয়ার পথে গিরিসংকুল এক পথ পড়ে, তিয়োগা রোড। বছরের অধিকাংশ সময় সে রাস্তা তুষারের কারণে বন্ধ থাকে। আমরা ইউটাহ থেকে মরুভূমি দেখতে দেখতে আসছি, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই তুষারপাত শুরু হয়ে গেল। যে মোটেলে উঠব সেখানকার মালিক ফোন করে জানাল তিয়োগা পাস বন্ধ হয়ে গেছে, আমরা যেন প্ল্যান করে আসি। আমাদের ত আর ফেরার উপায় নেই, সে কি রাস্তা! অন্ধকারে একটা গাড়ি নেই, একেবেঁকে পিচ্ছিল রাস্তার উপর দিয়ে বর্ষার ফলার মত গাড়ির শিল্ডে এসে ফুটছে বরফকণা – আমরা সমানে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে এগোচ্ছি। কোনমতে এসে পৌঁছলাম হোটেলে। পরদিন তিয়োগা খুললে ইয়োসেমিটি যাত্রা। আমাদের হোটেল তিয়োগার অল্প একটু আগেই। ট্যুর এর হোটেল বুকিং, গাড়ি বুকিং, ফ্লাইট বুকিং সব করেছে আমার স্বামী। তাকে এই ইয়োসিমিটির হোটেল নিয়ে খুব যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে, কোথাও কোন হোটেল খালি নেই, তিন দিন ধরে সাধ্যসাধনা করে যে একটা পেল, সেটাও তারা শেষ মুহূর্তে ওকে মানা করে দিল। অবশেষে তিয়োগার আগে এই একটা দু’কামরার চিলেকোঠা।
মোটেল মালিকের ফোন পেয়ে আমার স্বামী উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল, আল্লাহকে অশেষ অশেষ ধন্যবাদ। যে হোটেলটা না পেয়ে আমি মন খারাপ করেছিলাম ওটা ছিল ইয়োসিমিটি পার্কের ভেতরে। ওটা পেলে আজকে রাতে তিয়োগা পারও হতে পারতামনা, এই বরফের মধ্যে আমাদের গাড়িতে রাত কাটাতে হত। আল্লাহ আমাদের জন্য কী নির্ধারণ করে রেখেছেন তা বুঝতে না পেরে আমরা অকারণেই হতাশ হই। নিকষ কালো পথে হেডলাইটের আলোয় তুষারের ঝিলিক দেখতে দেখতে আবারও মনে পড়ল, আল্লাহ ইজ দা বেস্ট প্ল্যানার।
লেখাটা লিখতে লিখতে হাসিই পাচ্ছে, কারণ, সে রাতেই আমি আর আমাদের আরেক বন্ধু তর্ক করছিলাম প্রকৃতি কুরআনের বিকল্প হতে পারে কিনা। আমার সে বন্ধু বলছিল, কুরআন যেমন আল্লাহর উপহার, প্রকৃতিও তাই। তুমি যদি চোখকান খোলা রাখ, এবং চিন্তা করতে পার, প্রকৃতির সবকিছুই তোমাকে একই মেসেজ দিবে। আমি বলছিলাম, হতে পারে, কিন্তু কুরআনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর প্রকৃতি খুব প্যাঁচালো, কে জানে আমরা কতটুকু ঠিক শিক্ষা পাব। এখন লিখতে গিয়ে দেখি আল্লাহর অন্তত পাঁচ ছয়টা নাম আমার অন্তরে গাঁথা হয়ে গেছে কেবল মাত্র এই ট্যুর থেকে।
যাই হোক, আরো একটা গল্প বলি। আমরা ইউটাহ তে জায়ন ন্যাশনাল পার্ক এ একরাত থেকেছিলাম, সে পার্কটা বেশ মজার, নবীদের (আ) দের নামে পাহাড়ের নাম, এক পাহাড় চূড়ার নাম অ্যাঞ্জেল’স ল্যান্ডিং (অর্থাৎ যেখানে কিনা ফেরেশতাদের আড্ডা বসে) – সে পার্কে হাইক করতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, ইনশাআল্লাহ জান্নাতে আমাদের প্রত্যেকের এরকম ঝর্ণাওয়ালা পার্সোনালাইজড পাহাড় থাকবে, সেখানে সত্যিকারের অ্যাঞ্জেলরা ল্যান্ড করবে। ত সে পার্কে বিরা…..ট বিরা…..ট সব রেডউড ট্রি, ইয়া মোটা মোটা তার গুঁড়ি। একেকটার ভেতর দিয়ে টানেল বানিয়ে গাড়ি চলতে পারবে। তেমন এক গাছ শেকড়সুদ্ধ উপড়ে মাটিতে পড়ে আছে। পৌনে দুই তলা সমান উঁচু একপাশের বেড়। আমি অবাক হয়ে সে গাছের শেকড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম, এ ত রীতিমত আধুনিক ভাস্কর্য! সিমেন্ট দিয়ে বানিয়ে এ জিনিস প্রদর্শনীতে দিলে বাহবা পড়ে যাবে। আল্লাহ সত্যিই সেরা আর্কিটেক্ট। তখন মনে পড়ল, একটা সময় আমি কনফিউজড ছিলাম, আল্লাহ আমাদের ক্রিয়েটিভিটি কেন দিয়েছেন। তা নিয়ে নোট লিখেছি, প্রশ্নের আকারে, ইবাদত বনাম ক্রিয়েটিভিটি নামে। এই জিনিস দেখে বুঝলাম, আর্কিটেকচার কী না জানলে ত এই জিনিসের মহিমা বুঝতেও পারতাম না। যেমন করে অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং না দেখলে বুঝতাম না বালির পাহাড়ে এত রংয়ের মহিমা কোথা থেকে আসে! আবারও প্রকৃতির মধ্য দিয়ে আমি পেলাম আমার প্রশ্নের উত্তর।
আমাদের গ্রুপের সবচাইতে ভাবুক সবচাইতে দার্শনিক মানুষটি হচ্ছে আমাদের সেই জ্যামাইকান বন্ধু, যার কথা ঘুরে ফিরে বারবারই লিখি। আমার সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নগুলো আমি তার জন্য তুলে রাখি। এতসব পাহাড় দেখে আমাদের মনে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে পাহাড় চড়ার মত আপাত অর্থহীন কাজটাও আমাদের স্রষ্টার সান্নিধ্যে নিয়ে যায়। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? একটা ত জানি, এত বিশালতার মধ্যে নিজের ক্ষমতার ক্ষুদ্রতা বোঝা যায়। আর কী? সে বলল, এ ধরণের কাজে তোমার মন ফোকাস হয়, সবধরণের ডিস্ট্রাকশন দূর হয়ে যায়। আবারও জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? শারীরিক পরিশ্রম, এমনকি জিম করলেও শুনেছি মন ফোকাস হয়, কীভাবে?
সে তখন বোঝাল, তোমার মধ্যে তোমার শরীর আর তোমার আত্মা, দু’টোরই অস্তিত্ব আছে। ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, ও…. তার মানে শারীরিক পরিশ্রমে আমার শরীর ট্যাঁ ফো করার সুযোগ পায়না, কন্ট্রোল এ থাকে, তখন আত্মা মুক্তভাবে চিন্তা করার সুযোগ পায়? যেমনটি তারিক রামাদান তার লেকচারে বলেছেন, spirituality is the most demanding among all of your religious requirements? সে বলল, শুধু তাই না, মনকে মুক্ত করার দু’টো উপায় আছে, এক হচ্ছে, নির্বিঘ্নে চিন্তা করতে করতে এমন পর্যায়ে চলে যাওয়া যেখানে তোমার সব চিন্তা থিতিয়ে যাবে, এবং হঠাৎ করে মন পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমনটি রাসুলুল্লাহ (স) করেছিলেন, হেরা গুহায়। আরেকটা হচ্ছে শর্টকাট মেথড, যেখানে তুমি আর সব কিছু বাদ দিয়ে শরীরকে মনকে কেবল একদিকে ফোকাস করে রাখবে, যেমন হাইকিং এ – তখন সব বাজে চিন্তা দূর হয়ে তোমার মন পরিষ্কার হয়ে যাবে। সত্যিকার অর্থে রাসুলুল্লাহ (স) এর দু’টোই একসাথে করেছিলেন। হেরা গুহায় যাওয়া চাট্টিখানি কথাটা না, আমার মামা দেখতে গিয়েছিলেন, তিনি বলেছেন। আর আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে চিন্তা করার ত কোন বিকল্পই নেই। আমরা হাফ ডোমের ওখানে মানুষজন থেকে দূরে গিয়ে প্রকৃতিতে চোখ রাখতেই হারিয়ে গিয়েছিলাম আপন আপন জগতে। এ এমন এক অনুভূতি, যেখানে আটপৌরে জীবনের ক্লান্তিকর ভারগুলো আপনা থেকেই লঘু হয়ে আসে। মন চায় বড় কিছু করতে, ভাল কিছু ভাবতে। ফিরে আসতে ইচ্ছে করেনা, এ যেন একটুকরো স্বর্গের থেকে মনকে টেনে হিঁচড়ে পৃথিবীতে নামিয়ে আনা। ফিরে এসেছি এই আশা নিয়ে, এই পৃথিবীর ডিজাইনার যিনি, জান্নাতের ডিজাইনারও তিনি; ওখানে গেলে সময় আর কখনও ফুরাবে না।
সবকিছু মিলিয়ে আমি আবারও আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ, আমাকে এ পথ দিয়ে এভাবে জীবনটাকে চেনার সুযোগ করে দেবার জন্য। কৃতজ্ঞ, পথচলায় এমন মানুষদের বন্ধু হিসেবে পাইয়ে দেবার জন্য। কৃতজ্ঞ মনপবনের কাছেও, তার ‘এভারেস্ট বিজয়’ নোটে পাহাড় আরোহণের অসারতা নিয়ে কথা হয়েছিল বলেই এসব নিয়ে এতটা চিন্তা করেছিলাম। আল্লাহ সত্যিই মানুষের মনকে মুক্ত করেন, তাঁর নিদর্শনের মাধ্যমে। কোন নিদর্শন কাকে কতটুকু প্রভাবিত করবে সেটা একজন আরেকজনের উপর চাপিয়ে দিতে পারেনা, তাই নিজের বোধটুকু চাঙা রাখার পাশাপাশি অন্যদের পথকে শ্রদ্ধা করাও খুব দরকার।