আমি টেলিভিশন দেখি কালেভদ্রে। মূলত পেশাগত জীবনের ব্যস্ততা এবং জীবনে ভালোলাগা-মুগ্ধতার বিষয়সমূহ বদলে উন্নত হওয়ায় বিনোদনের সকল পর্যায়ে টেলিভিশনের অস্তিত্ব আমার জীবনে একদমই নেই এখন। ক’দিন আগে এশিয়া কাপে বাংলাদেশের খেলা দেখতে বসেছিলাম। বিটিভিতে খেলা সম্প্রচারে অর্থায়ন করেছে বাংলালিংক। তাই প্রতি ওভারের বল শেষ হলেই বিজ্ঞাপন বিরতি হচ্ছিলো।
বিজ্ঞাপনের মূল আকর্ষণ একজন তরুণ এবং তরুণী। দৃশ্যকল্পে বোঝা যায় যে তারা প্রতিবেশি, সম্ভবত তারা একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে। আর মেয়েটির পিচ্চি একটা ভাই আছে। প্রথম দৃশ্যে হাল আমলের সুদর্শন তরুণ এবং তরুণী দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে — ছেলেটি একটা “গোপন” কথা বলতে যায় মেয়েটিকে কিন্তু পাশে এক আংকেল এসে পড়ায় সে তাকে অক্সিজেন আর হাইড্রোজেনে যে পানি হয় তা বুঝাতে থাকে। যদিও ছেলেটি খুবই “ডিসটার্বড” হয়। পরের দৃশ্যে একটা লিফটে কেবল তারা দু’জনেই থাকে — ছেলেটি সেই “গোপন” কথাটা বলেই ফেলবে বলে আকুতি প্রকাশ করে বেশ। এমন সময় একজন “স্যার” সেই লিফটে প্রবেশ করার ফলে তার “ডিসটার্ব” হয়, ছেলেটা মুখ চোখ বিকৃত করে ফেলে স্যারের উপস্থিতির কারণে এবং প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে পরীক্ষা সংক্রান্ত কী একটা যেন বলতে থাকে। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, ছেলেটা কথা বলতেই মেয়েটার ছোট ভাই চলে আসে এবং সে “গোপন” কথা বলতে না পারায় “ডিসটার্ব” হয়। সেই সাথে আবারো কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য কথা বলতে থাকে।
এই বিজ্ঞাপন দেখেনি এমন উঠতি বয়েসি ছেলে-মেয়ের সংখ্যা সম্ভবত অনেক কম হবে। আমি সেদিনই এই বিজ্ঞাপন প্রথম দেখলাম। সম্ভবত বিজ্ঞাপন নির্মাতারা আজকাল কোন একটা বিশেষ শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের “স্ট্যান্ডার্ড লেভেল” ধরে এইসব বানিয়ে থাকেন। সেই শ্রেণীতে আমার মতন ছেলে ও তার পরিবারেরা থাকে না। আমার বাবা-মা অনেক উঁচু মাপের চারিত্রিক সৌন্দর্য ধারণ করা মানুষ। তাদের সামনে যেখানে সেখানে মনের কথা বলতে চাওয়ার জন্য ছটফট করা ছেলে স্যারের উপস্থিতিতে “ডিসটার্ব” হবে — এমন একটা দৃশ্য দেখতে পারা যায় না। এই দৃশ্যে যেই রকম নির্লজ্জতা আছে, একটা অপ্রীতিকর আচরণের স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা আছে — তা হজম করতে না পেরে আমি অস্বস্তিতে টিভির সামনে থেকে উঠে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম।
বিজ্ঞাপনের মূল বিষয় ছিলো একটা প্রোডাক্টের প্রচার। যেমন ধরেন, চুলের তেলের বিজ্ঞাপনে দেখায় যে তেল ব্যবহার করলে চুল কালো হয়, দীঘল হয়। কিন্তু মোবাইল অপারেটরদের এই প্রোডাক্ট হলো — একটা “ট্যারিফ প্ল্যান”। এই প্রোডাক্টের মূল উপজীব্য হচ্ছে তারুণ্যের আবেগ — তেলের জন্য দরকারী নারিকেলের, এখানে লাগেনা। তাই আবেগকে আজকাল বিপণন করা হয় তুমুল মাত্রায়। তেলের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় তেলের গুণাগুণ — আগ্রহী করা হয় ভোক্তাকে। আর এই বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয় তরুণদের বাঁধভাঙ্গা আবেগের জোয়ার। যারা এই আবেগকে বেশি করে ব্যবহার করতে পারবে — তারাই বেশি বেশি প্রোফিট করতে পারবে। এই প্রতিযোগিতা এখন চরমে। মোবাইল অপারেটর থেকে শুরু করে সমস্ত ব্যবসায়ীরাই এই প্রতিযোগিতায় পাগলা কুত্তার মতন উঠেপড়ে লেগেছে।
ডিসটার্ব সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনে দেখলাম কোন একটা কথা ছেলেটা বলতেই পারছে না মেয়েটিকে। কেন? কারণ সামনে মেয়েটির অভিভাবক, ভার্সিটি/কলেজের স্যার এবং মেয়ের ছোটভাই চলে আসে কথার মাঝেই। ছেলেটির কথা সর্বোচ্চ এগিয়েছিলো তোমাকে দেখলেই আমার বুকে ঢেউ খেলে টাইপের একটা কথা বলে — যা আর শেষ করতে পারেনি। কী এমন কথা ছিলো যা ছোট ভাইটার সামনে বলা যায় না? যেই কথা বললে লিফটে স্যার অস্বস্তি বোধ করবে, খারাপ ভাববে; অথবা ছোটো ভাইটা লজ্জা পাবে — সেই কথা তাই যেন ফোনে বলে দেয়া হয় — সেটাই মনের মধ্যে প্রোথিত করে দেয়াই এই বিজ্ঞাপনের উপলভ্য।
বিজ্ঞাপনের একদম শেষে আবার দেখা যায় দু’জন পাশাপাশি বাসায় থাকায় রাতের বেলা ছাদে-বারান্দায় পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছে এবং ফোনে তুমুল কথা চালাচ্ছে — শেষে জানানো হয় মেয়ে মানুষের সাথে ডিসটার্ববিহীন কথা বলতে একটা প্যাকেজ নেয়ার জন্য। আমরা জানি, আবেগের পরিবহন এই ফোন। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ পরিবারের কাছে যেটা একটা অপরাধ পর্যায়ের কাজ — সেটাকে কী সুন্দর করে সবার সামনে স্বাভাবিক ও আদর্শ হিসেবে পরিণত করে দেয়া হচ্ছে! বাবা, স্যাররা সামনে আসলে যে মিথ্যা কথা বলে প্রতারণা করতে হয় — সেই শিক্ষাও এইসব বিজ্ঞাপনে পাওয়া যায়। অথচ, ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হতো — “মিথ্যা বলা মহাপাপ/ মিথ্যা সকল পাপের জননী।” আমরা কি তবে নির্মম এক নীতিহীন সমাজ গড়ার পথেই এগিয়ে যাচ্ছি? বিশাল বিশাল অপরাধের এখানেই শুরু নয় কি?
বিজ্ঞাপনগুলোতে ক্রমাগত এইসব নির্লজ্জ ও নিষিদ্ধ কাজকে স্বাভাবিক হিসেবে প্রমোট করায় তা একটা সময় হয়ত সবার কাছেই গ্রহণীয় হয়ে যাবে। অপারেটররা যেমন চায় কেবলই ব্যবসা — সেই ব্যবসায়িক এজেন্ডা অনুযায়ী ওরাই হয়ত চায় দেশে এমন পরিবার বাদ না থাকুক যখন প্রতিটা ছেলেই যখন কোন একটা সুন্দরী মনে করা মেয়েকে ফোনে ২৫ পয়সা মিনিটে কথা বলে মনের চাওয়া প্রকাশ করবে কেবলই নিজের মনের খায়েশ থেকে। কোন বন্ধন যদি এতই সস্তা হয়, তবে তা ভাংতেও খুব কম সময় লাগবে — এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সামাজিক সচেতনতা নেই, নীতিনির্ধারক নেই যারা এইসব জঘন্যতাকে এড়াতে চাইবেন। একদিন হয়ত বিজ্ঞাপনদাতাদের চাওয়াই পূর্ণ হবে।
পথের ধারে আজকাল অর্ধনগ্ন মডেলদের বিলবোর্ড দেখা যায়। বিশাল সেইসব বিলবোর্ডে অটবি, আড়ং, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের প্রোডাক্টের জন্য নারীদের উপস্থিতিতে পণ্যের নামটাকেও বুঝে পাওয়া যায়না। আজ থেকে ২০ বছর আগে এইসব ধবল নারীদেহের প্রদর্শনী পথে-ঘাটে দেখে আমাদের শৈশব কাটেনি– এখনকার কিশোরদের চারপাশে এরকম অজস্র নারীপণ্য। তারুণ্যের অমোঘ আকর্ষণকে সঠিক দিকে প্রবাহিত করতে না পারলে ফলশ্রুতিতে ভুল হয়ে যাবার পর তার ফলাফল উক্ত তরুণ-তরুণীরা তো ভোগ করেই; কিন্তু তার পাপ কিন্তু ছাড়িয়ে যায়না বয়ষ্কদেরকেও। ভোগান্তি তাদেরই হয় বেশি কেননা পারিবারিক সমস্যা সমাধান করা, ছেলেমেয়েদের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করার একটা অনিবার্য দ্বায়িত্ব তাদের থেকেই যায়।
এইসব বিষয়ে আমাদের সচেতনতা জরুরি। দরকার প্রতিবাদ করা, আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করা। মুসলিম ভাইদের প্রয়োজন প্রতিদিন চোখকে নিচু করে, সংযত করে দৃষ্টিকে পবিত্র রাখার এই জিহাদে রত থাকা। দৃষ্টিকে নোংরামি মুক্ত রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন থাকা দরকার। আমাদের বোনদের দ্বায়িত্ব তারা ভালো করেই জানেন। ছেলেদের সুযোগ না দেয়া প্রয়োজন। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের হিদায়াহ দান করুন, আমাদের সমাজকে এমন এক সমাজ বানিয়ে দিন — যেই সমাজের মানুষ তাদের পশুত্বকে ছাড়িয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার মতন সুন্দর জীবন পরিচালনা করতে পারবে। আত্মার শান্তি যেখানে থাকবে সবার হৃদয়ে…