১৩৬ হিজরিতে আবদুল্লাহ বিন আলির বিদ্রোহ দমন করে থিতু হলেন আবু জাফর মানসুর। এবার তিনি নজর দিলেন আবু মুসলিম খোরাসানির দিকে। খলিফা হওয়ার আগ থেকেই আবু মুসলিমের ব্যাপারে তিনি শঙ্কিত ছিলেন, এজন্য সাফফাহকে কয়েকবার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি যেন আবু মুসলিম খোরাসানিকে হত্যা করেন। সাফফাহ তার প্রস্তাবে সায় দেননি। খোরাসানে আবু মুসলিমের কতৃত্ব ও ক্ষমতা মানসুরকে ভীত করছিল। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তার ব্যাপারে এমন কিছু সংবাদ মানসুরের কানে আসে যা তাকে উত্তেজিত করে তোলে। এসব সংবাদের মধ্যে একটি ছিল, আবু মুসলিমের কাছে মানসুরের কোনো পত্র গেলে তিনি বিদ্রুপের সাথে তা ছুড়ে মারেন এবং মানসুরকে গালমন্দ করেন। এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই করার উপায় নেই। হতে পারে আবু মুসলিমের শত্রুরা ইচ্ছা করেই এসব বলে খলিফার কান ভারী করছিল। কিন্তু খলিফা এসব সংবাদ গুরুত্বের সাথে নিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আবু মুসলিমের শক্তি খর্ব করা হবে। আবদুল্লাহ বিন আলির বিদ্রোহ দমন করে আবু মুসলিম শামে অবস্থান করছিলেন। এ সময় মানসুর তাকে একটি চিঠি পাঠিয়ে শামে অবস্থান করার আদেশ দেন। পত্রে মানসুর লিখেছিলেন, তোমাকে মিসর ও শামের গভর্নর নিযুক্ত করলাম। খোরাসানের চেয়ে এই অঞ্চল তোমার জন্য উত্তম। তুমি মিসরে কাউকে পাঠিয়ে শামে অবস্থান কর। তাহলে তুমি আমিরুল মুমিনিনের কাছাকাছি থাকতে পারবে এবং চাইলে যেকোনো সময় সাক্ষাত করতে পারবে।
মানসুরের উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। তিনি আবু মুসলিমকে খোরাসান থেকে সরানোর মাধ্যমে তার শক্তি খর্ব করতে চাচ্ছিলেন। এই পত্র পেয়ে আবু মুসলিম রেগে যান। তিনি বলেন, আমি খোরাসানেই অবস্থান করব। মিসর ও শামে প্রতিনিধি পাঠাব। আবু মুসলিম পত্রের মাধ্যমে মানসুরকে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে খোরাসানের পথে রওনা হলেন। মানসুর আনবার ত্যাগ করে মাদায়িনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন এবং আবু মুসলিমকে তার সাথে দেখা করার আদেশ দিলেন। মানসুরের আদেশের জবাবে আবু মুসলিম একটি পত্র লিখলেন যেখানে ঔদ্ধত্য ও হুমকির সুর ছিল। আবু মুসলিম লিখেছিলেন, আমিরুল মুমিনিন আপনার যত শত্রু ছিল সবাইকে আপনি আয়ত্তে এনেছেন। সাসানি সম্রাটগন বলতেন, রাত যখন নীরব হয়, উযিরগন তখনই ভয়ংকর হয়ে উঠেন। আপনি যতদিন নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন ততদিন আমরা আপনার সাথে থাকবো, তবে দূর থেকে। তাই আমরা আপনার নৈকট্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। যদি আপনি এতে তুষ্ট থাকেন তাহলে আমরা আপনার একান্ত সেবক। আর যদি আপনি রুষ্ট হন তাহলে নিজেকে অপমান থেকে বাঁচাতে আমি আপনার সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করব।
এ পত্রের মাধ্যমে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল আবু মুসলিম খলিফার আদেশ মানতে প্রস্তুত নন। আবু জাফর বুঝতে পারলেন, তিনি আবু মুসলিমকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবেন না। বরং তাকে হত্যা করতে পারলেই তিনি ও তার সাম্রাজ্য নিরাপদ হবে। আবু জাফর মানসুর কয়েকদিন বিষয়টি নিয়ে ভাবলেন। পরে তিনি নিজের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে এ নিয়ে পরামর্শ করলেন। সেই বন্ধু তাকে বললো, হে আমিরুল মুমিনিন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যদি আকাশমন্ডলি ও পৃথিবীতে আল্লাহ ব্যতিত বহু ইলাহ থাকতো, তাহলে উভয়ই ধবংস হয়ে যেত। (আম্বিয়া,২২)
বন্ধুর কথা শুনে মানসুর স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন তিনি আবু মুসলিমকে হত্যা করবেন। মানসুর ছিলেন ঠান্ডা মাথার লোক। তিনি কাউকে কিছু টের পেতে দিলেন না। তিনি আবু মুসলিমের প্রতিনিধিদলের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করলেন এবং আবু মুসলিমকে বললেন মাদায়েন এসে তার সাথে দেখা করতে। খলিফার কয়েকটি আন্তরিক বার্তা পেয়ে এবং নিজের দূতদের কাছে খলিফার আন্তরিকতার কথা শুনে আবু মুসলিম আশ্বস্ত হলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন খলিফার সাথে সাক্ষাত করবেন। আবু মুসলিমের উযিররা তাকে বাঁধা দিয়েছিল। তাদের অনুমান ছিল খলিফা আবু মুসলিমকে হত্যা করবেন। দুয়েকজন উযির আবু মুসলিমকে পরামর্শ দিল, খলিফা আপনাকে হত্যা করার আগে আপনিই তাকে হত্যা করে ফেলুন। আবু মুসলিম উযিরদের সন্দেহকে গুরুত্ব দিলেন না। তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। ছোট একটি কাফেলা নিয়ে রওনা হলেন মাদায়েনের পথে।
আবু মুসলিমের কাফেলা মাদায়েন পৌঁছলে খলিফা আন্তরিকভাবে তাকে স্বাগত জানান। কিছুক্ষন কুশল বিনিময় করেন। তারপর খলিফা বললেন, তুমি সফর করে এসেছ, ক্লান্ত। আজ বিশ্রাম নাও। আগামিকাল দেখা করো।
আবু মুসলিম সেরাতে বিশ্রাম নিলেন। পরদিন তিনি খলিফার সাথে দেখা করতে গেলেন। খলিফা তার কক্ষের পর্দার পাশে চারজন প্রহরীকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের উপর আদেশ ছিল খলিফা হাত তালি দিলে তারা বের হয়ে আবু মুসলিমকে হত্যা করবে। আবু মুসলিম দরবারে উপস্থিত হলে খলিফা তার সাথে নানা বিষয়ে আলাপ চালাতে থাকেন। তিনি আবু মুসলিমের ব্যাপারে বিভিন্ন অভিযোগ করতে থাকেন। আবু মুসলিম সেসবের জবাব দেন। এক পর্যায়ে খলিফা বলেন, তুমি কেন সোলাইমান ইবনু কাসির, ইবরাহিম ইবনে মায়মুন ও অন্যান্যদের হত্যা করেছ? আবু মুসলিম জবাব দিলেন, তারা আমার অবাধ্যতা করেছিল তাই তাদের হত্যা করেছি। খলিফা বললেন, তোমার অবাধ্যতা করলে তুমি হত্যা কর। তুমি আমার অবাধ্যতা করেছ তাই আমিও তোমাকে হত্যা করব। এরপর খলিফা হাত তালি দিলে পর্দার আড়াল থেকে চারজন অস্ত্রধারী প্রহরী বের হয়ে আসে। আবু মুসলিম আতংকিত হয়ে উঠেন। তিনি খলিফাকে বলেন, আমাকে জীবিত রাখুন। আমি আপনার শত্রুদের মোকাবেলা করব। খলিফা জবাব দিলেন, আমার জন্য তোমার চেয়ে বড় কোনো শত্রু নেই। খলিফার ইশারায় প্রহরীরা আবু মুসলিমের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তরবারির আঘাতে তাকে কয়েক টুকরো করে ফেলে। তারপর তার লাশ একটি কাপড়ে জড়িয়ে দজলা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। এভাবেই পতন ঘটে আব্বাসিদের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র আবু মুসলিম খোরাসানির। এটি ছিল ১৩৬ হিজরির শাবান মাসের ২৬ তারিখের ঘটনা।
এরপর খলিফা আবু মুসলিমের সংগি-সাথীদের দিকে দৃষ্টি দেন। তাদেরকে নানা উপহা-উপঢৌকন দেয়ার মাধ্যমে নিজের করায়ত্ত করেন। আবু মুসলিমের মত শক্তিশালী একজন সেনাপতি ও গভর্নরকে খলিফা সহজেই নিজের পথে থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হন। আবু মুসলিম ছিলেন বিচক্ষণ ও দুরদর্শী একজন সেনানায়ক। যে কোনো পরিস্থিতি তিনি সহজেই অনুমান করতে পারতেন। কিন্তু তিনি যখন মাদায়েন গিয়েছিলেন, তখন তিনি কল্পনাও করতে পারেননি খলিফা তাকে খুন করবেন। আবু মুসলিমের আমিররা কিন্তু সন্দেহ করেছিলেন খলিফা তাকে খুন করবেন। তারা বারবার তাকে নিষেধ করছিল, কিন্তু তিনি কারও কথাই শুনেননি। তখন আবু মুসলিমের একজন আমির কবিতা আবৃত্তি করেছিল, তাকদিরের সাথে কোনো কৌশল চলে না, তাকদির সকল কৌশলকে নস্যাত করে দেয়। আবু মুসলিম খোরাসানি তার জীবন দিয়ে এই কবিতার সত্যায়ন করেছিলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
আবু মুসলিম খোরাসানি যদিও আঞ্চলিক প্রশাসক ছিলেন কিন্তু শক্তির দিক থেকে তিনি খলিফার চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। ইমাম যাহাবি লিখেছেন, আবু মুসলিম খোরাসানি ছিলেন শক্তিশালী শাসকদের একজন। তিনি একটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে অন্য একটি সাম্রাজ্যকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৬/৪৮)।
বারোশো বছর পার হয়েছে। আবু মুসলিম খোরাসানি ও আবু জাফর মানসুর দুজনই তাদের কৃতকর্ম নিয়ে রবের দরবারে পৌঁছে গেছেন। আমাদের কোনো নিন্দা বা প্রশংসা তাদের কর্মকে বদলাতে পারবে না। কিন্তু আমরা চাইলে তাদের জীবন ও কর্ম পর্যালোচনার মাধ্যমে নিজেদের জীবন ও কর্মের গতিধারা ঠিক করতে পারি।
আবু মুসলিমের জীবনি পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই তিনি আব্বাসি আন্দোলনের পক্ষে লড়েছিলেন। এই আন্দোলনের জন্য প্রচুর খুনখারাবি করতেও তিনি পিছপা হননি। ইমাম যাহাবি লিখেছেন, আবু মুসলিম খোরাসানি খুনখারাবি ও রক্তপাতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের চেয়েও এগিয়েছিল। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৬/৫১)। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহিমাহুল্লাহকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আবু মুসলিম খোরসানি ও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মধ্যে কে উত্তম? তিনি জবাব দিয়েছিলেন, আবু মুসলিম কারো চেয়ে উত্তম ছিল, একথা আমি বলবো না। তবে এটা বলবো, হাজ্জাজ তার চেয়েও নিকৃষ্ট ছিল। (তারিখু দিমাশক, ৩৫/৪২৭, ওফায়াতুল আইয়ান, ৩/১৪৮, লিসানুল মিজান, ৫/২৯)
আবু মুসলিমের এসব হত্যাযজ্ঞের উদ্দেশ্য কী ছিল? উদ্দেশ্য ছিল আব্বাসি আন্দোলনকে বিজয়ী করা। আব্বাসিদেরকে ক্ষমতায় বসানো। আব্বাসি আন্দোলন কোনো ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না। এটি ছিল নিছক একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। ক্ষমতা দখলের লড়াই। আবু মুসলিম তাদের এই রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেন। আব্বাসিদের পার্থিব স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি নিজের আখিরাতকে বরবাদ করেন। আবু মুসলিম যুদ্ধক্ষেত্রে বহু বিচক্ষনতা দেখিয়েছিলেন, কিন্তু এর চেয়ে বড় বিচক্ষনতা হত যদি তিনি অন্যের দুনিয়া অর্জনের জন্য নিজের আখিরাতকে বরবাদ না করতেন। তিনি রবের সন্তুষ্টির উপর আব্বাসিদের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের হাতেই তার পতন হয়েছিল।
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি তালাশ করে, আল্লাহ তার উপর অসন্তুষ্ট হন এবং মানুষকেও তার উপর অসন্তুষ্ট করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান, ২৭৬, শোয়াইব আরনাউত একে হাসান বলেছেন)
আবু মুসলিমের হত্যাকান্ড আমাদের সামনে এই হাদিসের শিক্ষাকেই স্পষ্ট করেছে।