[১]

কাজিনের বিয়ে। সব চাচাতো ফুপাতো ভাই-বোন গোল হয়ে বসে প্ল্যান করছে।

- শোন সুমন ভাইয়ের হলুদে কিন্তু মাল খাবো। সবাই চাঁদা দিবি।
- সবাই কেন চাঁদা দিবে? ভাইয়ের বিয়া, ভাই স্পন্সর করবে।
- তাইলে ধর তারে।
- ভাইয়া, আমরা মেয়েরাও কিন্তু…...।
- এই জংলীগুলি কই থেকে আসছে রে? মেয়েমানুষ এইসব কী বলে??
- হবে না হবে না। এখন ছেলে মেয়ে সমান সমান। তোমরা খেলে আমরাও খাবো। ব্যস।
- রেবু শোন, যদি হলুদে সাদিয়ারে নাচাতে পারিস, তাহলে তোদেরকেও দলে নিবো, যা।
- সাদিয়া? ও জীবনেও নাচবে না। ওর মাও দিবে না।
- তাইলে ফুট। আচ্ছা, শোন একটা চ্যালেঞ্জ দেই। কথাটা বলে একটু নিঃশ্বাস নিলো তপন।

সাদিয়াকে দিয়ে যদি এক নাচে পাঁচ বার কোমড় দোলাতে পারিস, প্রতিবারের জন্য এক হাজার টাকা পাবি। সাথে যা খেতে চাস, নইলে ভাগ।

রেবেকা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। কোন গান সিলেক্ট করবে ভাবছে। এমন গান নিতে হবে যেখানে লাইনে লাইনে কোমর দোলানো যায়।

…………………………………

স্টেজে দাঁড়িয়ে আছে সাদিয়া। পিঠের উপর যেন শিরশিরে একটা অনুভূতি নেমে গেলো। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এক মাস ধরে রেবেকা আপা কানের কাছে গান গেয়েছে।

- আরে আমরা আমরাই তো। বাইরের কেউ থাকবে না।
- আব্বা রাগ করবে।
- ফুপার চিন্তা বাদ দে। রাত দশটার মধ্যে মুরুব্বি সবাই নেমে যাবে ছাদ থেকে। শুধু আমরা আমরা।
- না আপা, আমার এইসব ভাল্লাগে না। লজ্জা লাগে।
- কি গাইয়া খ্যাত রে তুই? আজকালকার দিনে এইসব নকশা চলে? নাকি নিজেকে ভার্জিন মেরি মনে করিস তুই? আর আমরা সব খারাপ।
- না না, আমি তো তা বলিনি। আমি বলেছি যে......
- আরে চুপ, এত কথা কিসের? আচ্ছা জাস্ট একটা গানে নাচবি তুই, ব্যস শেষ কথা।

কথাগুলো মানা করার পিছনে আর কোন যুক্তি পায়নি সে। একটা দিনই তো। সবাই করছে, সে না করলে এক ঘরে হয়ে যাবে। কেউ মিশবে না তার সাথে। অতঃপর নিরুপায় হয়েই মত দিয়েছে সে। শর্ত একটাই, ছেলেরা থাকবে না। মেনে নিয়েছে রেবা আপু।

কিন্তু স্টেজে দাঁড়িয়ে সে স্পষ্ট দেখছে ছেলেরা যায়নি। একটু পিছনের দিকে আলো আঁধারিতে দাঁড়িয়ে আছে মইন, তপন, মিতুল, শোভন, রাকিব।

নার্ভাস ভঙ্গীতে রেবার দিকে তাকায় সে। রেবা ইশারায় বোঝায়, সবাই দেখছে। সিন ক্রিয়েট না করতে।

সাউন্ড বক্সে প্রচন্ড শব্দে বেজে ওঠে গান।

হিন্দি গানের কথাগুলো বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তা যদি গানের পাশাপাশি কেউ বলে দিতো, মা-চাচীরা এত খুশি খুশি চোখে তাকিয়ে দেখতেন না হয়ত।

গানের ফাঁকে ফাঁকে ডিজে বলছে, shake it daddy, shake shake.

এই লাইনের সাথে সাথে শুরু হবে কোমড় দুলানো। চারবার দুলিয়ে থামবে।

রেবেকা দোলানো গুনতে যেয়ে স্টেপ মিস করে ফেলছে। আফসোস নাই তার। তপন ভাইকে খসানো যাবে আজ।

তপন মনে মনে ভাবছে, ‘’শালী, ভড়ং ধরে ছিল এতদিন। ঠিকি তো বাইজিদের মত কোমর দোলাচ্ছে।’’ দুই আংগুল মুখে ভরে শীষ বাজায় সে।

সাদিয়া মনে মনে ভাবছে, ‘’OMG, I am doing great. Feeling so appreciated! They just love my performance.’’

ধীরে ধীরে অস্বস্তি কমে আসছে তার। জানে না, তাকে তার কাজ সুশোভিত করে দেখাচ্ছে কেউ। ডিসেনসিটাইজড হয়ে যাচ্ছে সে।

[২]

হনুফার বয়স পাঁচ। ওর মা বাসা-বাড়িতে ছুটাবুয়ার কাজ করে। সন্ধ্যায় এক বাসায় যেয়ে রুটি বানিয়ে দিয়ে আসে পরদিন সকালে খাওয়ার জন্য। হনুফার বাবা নেই। অনেক আগে মাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না।

মা কাজে গেলে হনুফা একাই বাসায় থাকে।

আজকেও তাই ছিলো। বাসার সামনেই মুদি দোকান। এই দোকান থেকেই বাকিতে চাল-ডাল-তেল আনে মা। বেতন পেয়ে শোধ করে দেয়।

দোকানদারের ছোট ছেলে জাফরভাই অনেক আদর করে হনুফা কে। মাঝে মাঝেই চকলেট দেয় বিনা পয়সায়।

আজকে তাকে দূর থেকে দেখেই ডাকলো হাত ইশারা করে।
- চল তোকে একটা জিনিস দেখাবো, খুব ফাইন একটা জিনিস।
- মা আইসা না পাইলে বকবো।
- আরে তর মায়ে আসার আগেই ফিরত আসবো।

হনুফার মুখ কে চেপে ধরলো মনে নেই। জ্ঞান হারানোর আগে সে শুনতে পাচ্ছিলো কেউ বলছে, আরে গানটা জোরে দে বেটা, সাউন্ড ফুল কর। চিল্লাইলেও কেউ শুনব না।

কান ফাটানো শব্দে গান ছাড়ে কেউ। ব্যাথায়, ভয়ে জ্ঞান হারায় হনুফা।

[৩]

শাতিন কে নিয়ে মিউজিক ইন্ড্রাস্ট্রিতে বিস্তর কানাঘুষা। শাতিন নাকি আত্মা বিক্রি করে দিয়েছে সাফল্যের বিনিময়ে। তার এই একের পর এক ব্লকবাস্টার হিটস নাকি সেই বিনিময়েরই ফল।

আজকের কনসার্টে যত মানুষ ভিতরে ঠাঁই পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি মানুষ বাইরে। টিকিট না পেয়েও দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। শাতিনের গাড়িটা যদি একটু দেখা যায়, এক পলকের জন্য যদি শাতিন কে দেখা যায়, এই আশায় অপেক্ষা করছে ওরা।

………

শাতিন যখন স্টেজে দাঁড়ায়, তখন তার ব্যক্তিত্বে অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। এমনিতে শাতিন ইন্ট্রোভার্ট—শান্ত শিষ্ট, চুপচাপ। অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে। সেই শাতিনই স্টেজে নাচে, লাফায়, চিৎকার করে, মানুষকে নাচায়। শাতিন নিজেই বলে কী যেন ভর করে তার উপর।

সে যার কাছে নিজের আত্মা বিক্রি করেছে, সেই অশুভ শক্তিই তার উপর ভর করে হয়ত, জানেনা সে। অথবা জানে।

…………………………

- শাতিন! শাতিন! শাতিন!

স্লোগান দিচ্ছে ভক্তরা

- SHATIN, I love youuuuuuu.

বলেই জ্ঞান হারায় মেয়েটা।

হাত নেড়ে অভিবাদন জানায় সে ভক্তদের। হাতের আংগুলগুলো ভাঁজ করে এক অদ্ভুত সাইন বানায় শাতিন। ভক্তরা বলে রক সাইন। রক সাইন দেখতে দুই শিং এর মত। শাতিন যখন হাতটা মাথার সামনে এনে দেখায়, মনে হয় শয়তানের মাথার শিং।

- Can you make it? ভক্তদেরকেও রক সাইন দেখাতে উৎসাহ দেয় শাতিন।

বলতে দেরি হয়, ভক্তদের ফলো করতে দেরি হয় না।

- Awesome! Can you bow like this?

মাথা ঝোঁকাতে বলে সে ভক্তদের। ভক্তরা জানেনা, কার উদ্দেশ্যে এই মাথা ঝোঁকানো, কী উদ্দেশ্যে ঝোঁকানো। তারা অন্ধের মত অনুসরণ করে তাদের প্রিয় রকস্টারকে।

- Okey now I want all of you to denounce God, right here, right now. Only then I will start.

- Denounce! denounce! denounce!

ভক্তদের চিৎকারে কান পাতা দায়। ওরা জানেই না কী হারিয়ে ফেলেছে কথায় কথায়। ওরা জানেই না, কাকে সিজদাহ দিয়েছে একটু আগে, ওরা জানেই না হাতের আংগুল দিয়ে কি দেখিয়েছে ওরা রক সাইনের নামে। ওরা তো এও জানেনা যে কার কথায় কাকে অস্বীকার করে বসেছে। মাতাল ওরা, গানের মদে।

[৪]

- বুঝিনা, গান শুনলে সমস্যা কি? ইসলামে তো কঠোরতা নেই। তোরা এইসব বাড়াবাড়ি পাস কই থেকে?

ভাবির কথায় উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকাই সমীচীন মনে করছে জুঁই।

কিছু না বলে মুচকি হাসি দেয় সে।

মনে মনে বলছে,
- শুনলাম ও মানলাম।


.......................................

মাতাল হৃদয়
নূরুন আ'লা নূর