দূর্গম পাহাড়ের উপর দিয়ে হাটছিলাম। কিন্তু কোন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোথায় যাব। আমি একা না, সাথে আমার কিছু বন্ধুরাও ছিল। কিন্তু তারা যে কোথায় হঠাৎ উধাও হল বুঝতে পারছিনা। পশ্চিম আকাশ ধীরে ধীরে লাল হয়ে আসছে, তার মানে সূর্য ডুবে যাবে। মনের ভিতর ভয় আর শংকা জেগে উঠল। আমি খুব একটা ভীতু মেয়ে না। কিন্তু নাইট ফোবিয়া আছে আমার প্রচন্ড পরিমাণে। হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখি কয়েকটা অপরিচিত ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, যাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন জানি! একটু শিহরণ লাগলো। চিন্তা করলাম, দেরি করে লাভ নেই, এখনি আমাকে দৌড়ে পালাতে হবে। কিন্তু একি? আমার পা যে মাটি থেকে সরছেনা! নাহ! খুব বেশি ভয় পেলে চলবেনা, আমাকে পালাতে হবে। যখন দৌড়াতে দৌড়াতে আমি অনেকদূর চলে এসেছি, ভাবলাম ওই অপরিচিত ছেলেরা আমার আর নাগাল পাবেনা ঠিক তখনি সামনে তাকিয়ে দেখি ম্যাজিকের মত তারা যেন কোথা থেকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের মধ্যে প্রচন্ড বড় একটা ধাক্কা খেলাম। পিছনেই তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের একদম শেষ চূড়া। একটু সরে গেলেই ঠিক ১০০ তলা সমান উপর থেকে নিচে গিরিখাদে পড়ে যাব। কি করব? প্রচন্ড ঘামছি। কি করব ভেবে না পেয়ে যখন পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফ দিতে যাব ঠিক তখনি ঘুম ভেঙ্গে গেল……
যাক! ওটা তাহলে স্বপ্ন ছিল। কি অদ্ভুত স্বপ্ন। আরে বাবা, আমি কেন পাহাড়ে উঠতে যাব? ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি আরে আমি মাত্র দশ মিনিট ঘুমিয়েছি। পড়তে পড়তে কখন টেবিলে ঘুমিয়েছি টের পাইনি। অথচ স্বপ্নে মনে হল আমি যুগ যুগ সময় পার করে এলাম। ভাগ্যিস ওটা স্বপ্নই ছিল!
জীবনটাও কি অদ্ভুত, স্বপ্নের মতই! জীবনের সংজ্ঞা তাই খুঁজে ফিরি বারবার। জীবনের উদ্দেশ্য কি? এর সার্থকতা কিসে, কীসে ব্যর্থতা? কি ভাল? কি মন্দ? এই তো পাশের বাড়ির রব্বান চাচা, সারাজীবন ঘুষ খেয়েছে, অন্যের সম্পদ ফাঁকি দিয়ে নিজে রাশি রাশি টাকার মালিক হয়েছে। এখন তার বাড়ি, গাড়ি সবই আছে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। আর জামাল চাচা! সারাজীবন সৎ উপায়ে চাকরি করেছে, কখনও টাকার কাছে নিজের সততা বিকিয়ে দেয়নি। আজ শেষ বয়সে মিথ্যা মামলার আসামী হয়ে জেলে পড়ে আছে। মোটা অংকের টাকা না দিলে নাকি মুক্তি মিলবেনা। আর তার একমাত্র কর্মোক্ষম ছেলেটার নাকি কি জটিল অসুখ হয়েছে, লাখ লাখ টাকা না দিলে নাকি চিকিৎসা হবেনা।
হায়রে জীবন! যে সারাজীবন অন্যের হক নষ্ট করল সেই আজ সুখী। আর যে কষ্ট করে সৎ থেকে গেল আজীবন, সেই অসুখী। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, সৃষ্টিকর্তা বলে কি কিছু আছে এই পৃথিবীতে? থাকলে কি সে ন্যায় বিচারক? তাই যদি হয় তাহলে এ কেমন তার ন্যায় বিচার??
যারা বস্তুবাদি তাদের কাছে সৃষ্টিকর্তা বলে আসলে কিছু নাই, কারণ সৃষ্টিকর্তা থাকলে তো আর জামাল মামার মত লোকেরা জীবনে এত কষ্ট ভোগ করতনা। অন্যদিকে রব্বান চাচার মত লোকেরাও আর সুখে থাকতনা। সুতরাং জীবনের সফলতা মূলতঃ এই জীবনেই। যত বেশি হাই স্ট্যাটাস, যত বেশি গাড়ি-বাড়ির মালিক হতে পারব, তা সে যে উপায়েই হোক না কেন তাহলে আমি সার্থক। কি হবে সৎ থেকে? সৎ থেকে যদি জীবনকে উপভোগ করতে না পারলাম তাহলে সেই জীবনের সফলতা বলে আর কিছু থাকল?
ভাল কিংবা মন্দের কি আসলেই পরম কোন সংজ্ঞা আছে? যে ছুরি দিয়ে একজন খুনি মানুষের গলা কাটে সে খারাপ, মন্দ। আর একই ছুরি দিয়ে যদি ডাক্তার মানুষের গলা কাটে তাহলে সে মহৎ। কি অদ্ভুত। ভাল-মন্দের ইউনিট তাই একেক জনের কাছে একেকরকম। একজন চোরও তার চুরির পক্ষে সাফাই গাইবে। আর জীবনের উদ্দেশ্য? সেটা তো আরো বেশি রহস্যময়।
যে ছেলেটি বিয়ে করার জন্য কেবল সুন্দরী-রূপসী মেয়ে খুঁজে, যার বাবার প্রচুর টাকা আছে, সমাজে একটা স্ট্যাটাস আছে তার উদ্দেশ্য হল বন্ধুদের কাছে নিজের প্রেস্টিজ বাড়ানো, স্ট্যাটাস বাড়ানো। আর যে ছেলেটি বিয়ের জন্য একজন সৎ চরিত্রের মেয়ে খুঁজে যার মেধা আছে, জ্ঞান আছে, যে পারসোনালিটি সম্পন্ন। তার উদ্দেশ্য জীবন চলার পথে শত বাধা আসলেও যেন মেয়েটি তার চরিত্রের আলো দিয়ে, জ্ঞানের মাধুর্য দিয়ে সব বাধাকে অতিক্রম করতে পারে। দু’টি ছেলে, যাদের উদ্দেশ্য দু’রকম। কে জানে কোনটি ভাল? কোনটি মন্দ?
জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে কুরআনে স্পষ্টরূপে বলা হয়েছে, জ্বীন ও মানুষ জাতিকে কেবল আল্লাহর ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে জীবনের সাকসেস সেটাই যা আল্লাহর সান্নিধ্য আনে, ব্যর্থতা সেটাই যা আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কারো কোটি কোটি টাকা যদি তাকে দাম্ভিক করে তোলে, তাকে অন্যায়-অবিচার করার ইন্ধন যোগায়, আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে তোলে তাহলে তার সেই কোটি কোটি টাকায় তার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। অন্যদিকে কারো জীবনের চরম দারিদ্র্য তাকে ধৈর্য্যশীল করে, অসৎ হতে বিবেকে বাধা দেয়, আল্লাহর আরো বেশি কাছাকাছি হবার সুযোগ করে দেয় তাহলে সেই দারিদ্র্যই তার জীবনের চরম সার্থকতা। অন্যদিকে যারা বস্তুবাদি, স্বল্পদৃষ্টির লেন্স নিয়ে জীবনকে দেখে তাদের কাছে জীবনের সাকসেস-ব্যর্থতার হিসাব পুরাই উলটা হবে।
মৃত্যুর পর যখন জেগে উঠব, যখন অপরাধীরা তাদের সকল অপকর্ম দেখতে পাবে তখন তারা চিৎকার করে বলে উঠবে, আমরা তো কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে ছিলাম মাত্র। অল্প একেবারে অল্প সময়ের জন্য আমরা পৃথিবী নামক গ্রহে বিচরণ করেছিলাম। সেখানে কালো টাকার এসি গাড়িতে চড়ে মনে করেছিলাম, এটাইতো জীবন! আমাদের যেন আমাদের পৃথিবীতে ফেরত দেয়া হয় তাহলে আমরা কিছু ভাল কাজ করে আসতে পারি।
স্বপ্নময় এই জীবন। স্বপ্নীল এই জীবনেও সৃষ্টিকর্তা আছেন। তিনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। তিনি তো দেখছেন এই স্বপ্নের সামান্য সময়ে কে তার সান্নিধ্য পাবার জন্য অবিরাম কষ্ট করে যাচ্ছে। তিনি তো তার জন্য মৃত্যুর পরে সেই অসীম বাস্তব জীবনে এক বিশাল সুখের সম্ভার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তিনিই তো ন্যায় বিচারক। আর যে বস্তুগত সুখ নিয়ে সুখি, যে অন্যকে ঠকিয়ে কালো টাকার পাহাড় জমিয়ে খুশি তাকেও তিনি দেখছেন, তার জন্যও তিনি অসীম বাস্তব জীবনে সীমাহীন আযাব নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তার মত ন্যায়বিচারক আর কে হতে পারে?
জীবনের উদ্দেশ্য, সাকসেস, ব্যর্থতা, ভাল, মন্দ এই স্বপ্নীল জীবনের স্বল্প জ্ঞান দিয়ে হিসাব নিকাশ করা যাবেনা। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গিয়ে দুঃস্বপ্নের মতই জীবনটা কে দুর্বিষহ মনে হবে। মনে হবে কত যুগ ধরে আমি স্বপ্ন দেখছি অথচ জেগে উঠার পর মনে হয়ে কয়েক সেকেন্ড কিংবা কয়েক মিনিট। ঘুম থেকে উঠার পর মনে হবে ভাগ্যিস ওটা স্বপ্ন ছিল! স্বপ্নের মধ্যে যত সুখেই থাকিনা কেন জেগে উঠার পর মনে হয় সেই সুখ কিছুইনা। আর যত বিপদেই থাকিনা কেন, ঘুম কেটে যাবার পর খুব স্বস্তিতে থাকি এটা ভেবে যে ওই বিপদ সত্যি ছিলনা।
জীবনটা তাই স্বপ্নময়। জীবন শুরু হবে তখন যখন আমরা মৃত্যুর পরে জেগে উঠব। তখন অসীম সেই মৃত্যু পরবর্তী বাস্তব জীবনের কাছে পার্থিব জীবন খুব বেশি হেয়ালি মনে হবে। যেমন উপরে বর্ণিত স্বপ্নের মতই ঘুম থেকে জেগে উঠার পর আমার মনে হয়েছিল…..
অনুপ্রেরণাঃ ইয়াসমিন মোগাহেদ