স্টিফেন কোভে’র “7 Habits of the Highly Effective People” বইটার কথা বলেছিলাম না? এই বইয়ে উনি যে ৭ টি ইফেক্টিভ অভ্যাসের কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে সবচে প্রথমে যে অভ্যাসটির উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে- “Be Proactive”।
বিষয়টা আমার খুবই পছন্দের। তো এই ‘প্রোএক্টিভ’ পার্সোনালিটিটা কেমন? একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি-
মনে করুন, আপনি একটি রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলছিলেন, পাশের আরেকটা গলি দিয়ে ঢুকলে রাস্তা শর্টকাট হবে ভেবে ড্রাইভার আরেক রাস্তায় ঢুকিয়ে দিলো। কিন্তু ঐ শর্টকাটে গিয়ে দেখলেন ঐ রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ও ভাঙাচোরা, যা এর আগে ছিলোনা। এইবার আপনি শুরু করে দিলেন চিৎকার-চেচামেচি- ‘ধুর! তুমি এই ঝামেলাটা বাধালে, সব সময় তুমি এমনটাই করো!’ জ্যাম একটু এগোয়, আপনিও একবার করে চেচিয়ে ওঠেন। আপনার মাথা গরম, ড্রাইভার শংকিত, পরিবেশ গরম। সমাধান না খুজে উল্টো আপনাকে ঠাণ্ডা করতেই সবাই ব্যস্ত….. এই আপনিই হলেন ‘রিএক্টিভ’ পার্সন।
অথচ আপনি চাইলেই এখন আর জ্যাম এড়াতে পারবেন না। তাহলে কী পারবেন? এই জ্যাম থেকে বের হওয়ার আর কোন উপায় আছে কিনা, তা খুজতে অথবা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে, কারণ ভুলটা তার ইচ্ছাকৃত না। তার অনুমান সঠিক হলে আপনি বরং তাকে বাহবা দিতেন।
‘গলিতে যখন ঢুকিয়েই ফেলেছো, একটু খুজে দেখো, সামনেই বোধহয় আরেকটা গলি আছে, ওটা দিয়ে বের হওয়া যায় কিনা!” এই মানুষটা নিজে ঠাণ্ডা, পরিবেশও ঠাণ্ডা, ফলে সমাধানও একটা মিলে গেলো। এই মানুষটা প্রোএক্টিভ।
তার মানে, সহজ কথায় বলা যায়, যে বা যারা কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতিকে দায়ী না করে নিজের পক্ষে সম্ভব কাজটুকু করার দিকে মনোযোগ দেন, তারাই ‘প্রো-এক্টিভ’। বিপরীতে যারা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় করণীয় কাজ না করে আফসোস করতে থাকেন কিংবা আশেপাশের মানুষ ও পরিবেশ-পরিস্থিতির দোষ দেয়া শুরু করেন, তারাই ‘রিএক্টিভ’।
এটি একটি সার্কেল থিওরিতে ব্যাখ্যা করা হয়। একটি বড় সার্কেল কল্পনা করা হয়, তার মাঝে আরেকটি সার্কেল, তার মাঝে ছোট্ট আরেকটি সার্কেল। একদম বাইরের সার্কেলটি হচ্ছে আমাদের ‘কনসার্ন’ (দুশ্চিন্তা), এর পরের সার্কেলটি ‘ইনফ্লুয়েন্স’ (প্রভাবিত করা), একদম ভেতরের সার্কেলটি ‘কন্ট্রোল’ (নিয়ন্ত্রণ)। আমরা কনসার্নকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা, কিন্তু কন্ট্রোলের কন্ট্রোল আমাদের হাতেই থাকে।
একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক। মনে করেন, বহু চেষ্টা-তদবিরের পরও আপনাদের সন্তান হচ্ছেনা। মাথায় দুশ্চিন্তার পাহাড়- কি হবে আমাদের ভবিষ্যৎ? কি হবে সংসারের? কার জন্য টাকা-পয়সা কামাই করবো? সারাক্ষণ এগুলোই মাথায় ঘুরছে আপনাদের, কোন কাজে মন দিতে পারছেন না আপনারা। আশেপাশের মানুষ আপনাদেরকে খোচা দিয়ে আপনাদের দুশ্চিন্তাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। তো এই অংশ হলো আপনাদের ‘কনসার্ন’ এর জায়গা, যার উপর আপনার খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ নেই।
কিন্তু যে বিষয়ের উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ আছে, ওটা করতে পারবেন কি? মানে আপনি যেহেতু সন্তানহীন একটা ফ্রি জীবন পাচ্ছেন, তাহলে এই ফ্রি সময়টুকুকে আপনি কোন কোনভাবে প্রোডাক্টিভ কাজে লাগাতে পারেন সেটা বের করুন দেখি। এমন কী কী ভালো কাজ আপনি চাইলেই করতে পারবেন যাতে উম্মাহ উপকৃত হয়, আর অন্যরা তা সময়ের অভাবে করতে পারছেনা? এই যে যেটুকু আপনার সাধ্যের মধ্যে আছে তা হলো ‘কন্ট্রোল’। তাহলে এবার কনসার্নের জায়গাটুকু ছেড়ে দিয়ে আপনার হাতে যে কন্ট্রোলটুকু আছে, তাতে ফোকাস করুন।
আপনি যখন আপনার এই সামর্থ্যের কাজটুকু করছেন, তখন দেখবেন আপনার কন্ট্রোল সার্কেলের পরিধিও ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। কিভাবে? অন্যরা যখন কটাক্ষ করে কিছু বলছে, আপনি তাদের থামাতে পারছেন না, কিন্তু তাদের কথা আপনাকে তেমন প্রভাবান্বিত করতে পারছেনা কারণ আপনি জানেন, আপনি এর থেকে উত্তম কিছু করছেন, আপনার জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়নি। আবার মাথায় যখন দুশ্চিন্তা আসছে, আপনি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করছেন, আল্লাহর শিখিয়ে দেয়া দু’আ পড়ে সন্তান চাইছেন, তাতে আপনার দুশ্চিন্তা দূর না হলেও আপনি দুশ্চিন্তার উপর কিছুটা প্রভাব রাখতে পারছেন। এই যে মাঝের অংশটুকু, এটুকু হলো ‘ইনফ্লুয়েন্স’, এটুকুও আদতে আপনার ‘কন্ট্রোল’ এরই অংশ, কারণ আপনি এটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন। এই পজিটিভ এনার্জির কারণে আপনার কন্ট্রোল সার্কেলটা বেড়ে যাচ্ছে। এটিই ‘প্রোএক্টিভ’ পার্সোনালিটির চিন্তা-দর্শন।
বিপরীতভাবে চিন্তা করলে কী দাড়ায়? আপনি এত বেশি দুশ্চিন্তায় ফোকাস করে আছেন যে ওটা নিয়েই সারাক্ষণ কান্নাকাটি, অভিযোগ করে চলছেন। দিনের যে অংশটুকু একটা প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যয় করতে পারতেন, ঐ সময়টুকুও আফসোসেই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। অন্যদের কথায় আরও বেশি আঘাত পাচ্ছেন। এই এক বিষয় নিয়ে আক্ষেপ করতে গিয়ে আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। ফলাফল কী দাড়াচ্ছে? আপনার ইনফ্লুয়েন্স পার্টটুকুও কনসার্নের ভেতরে চলে যাচ্ছে, ফলে আপনার কন্ট্রোল সার্কেলটা দিন দিন আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে। শুধু নেগেটিভ এনার্জির কারণেই আপনি যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, সেটুকুও হারাচ্ছেন। এটিই হলো রিএক্টিভ পার্সোনালিটির বৈশিষ্ট্য।
সমস্যায় পড়ে গেলেই দিশেহারা হয়ে এর-ওর দোষ দিয়ে বেড়ানো, চিৎকার-চেচামেচি করা, আল্লাহ যা দিয়েছেন তার শোকর না করে যা দেননি তাই নিয়ে অভিযোগ করতে থাকা- এগুলো একজন লীডারের বৈশিষ্ট্য নয়, একজন মুমিনেরও বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিৎ নয়। এই নেগেটিভ আবেগ-অনুভূতিগুলোকে কন্ট্রোল করতে শেখার ইসলামিক পরিভাষায় ‘সবর’ এর একটি অংশ, য ১৪০০ বছর আগে একজন মহামামব মহানেতা রাসূলুল্লাহ সা. হাতে ধরে তার সাহাবীদের শিখিয়ে গেছেন। সবরের বিনিময় সরাসরি জান্নাত বলেও ঘোষণা করা হয়েছে ইসলামে।
? রাসুলে করীম সা. বলেছেন:
أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّى فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ»
‘‘তোমার কোনো বিপদ হলে তুমি এ রকম বলোনা, যদি এমন করতাম তাহলে এমন হত। বরং তুমি বল যে قدر الله و ما شاء فعل ‘এটি ছিল আল্লাহর ফয়সালা, তিনি যা চেয়েছেন তাই করেছেন’। কেননা এরূপ ক্ষেত্রে ‘যদি’ কথাটি শয়তানের কাজকে সহজ করে দেয়।”
? রাসূল সা. বলেন-
‘যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করতে চায় আল্লাহ তাকে ধৈর্যশীল করে দেন। ধৈর্যের চেয়ে উত্তম ও সুপ্রশস্ত অন্য কোনো দান আল্লাহ কাউকে প্রদান করেননি।’ (বুখারী: ১৪০০)
? আল্লাহ্ তাআলা বলেন:
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
‘‘আল্লাহ্র নির্দেশ ব্যতীত কোন বিপদ আসে না এবং যে আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎ পথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে সম্যক অবগত’’। (সূরা তাগাবুন: ১১)
الَّذِیْنَ اِذَاۤ اَصَابَتْهُمْ مُّصِیْبَةٌ قَالُوْۤا اِنَّا لِلهِ وَ اِنَّاۤ اِلَیْهِ رٰجِعُوْنَ.
যারা যে কোনো রকম বিপদে আক্রান্ত হলে বলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন- সন্দেহ নেই, আমরা আল্লাহরই, আর আমরা তো তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’ (সূরা বাকারা: ১৫৬)
? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ يُرِدِ الله بِهِ خَيْرًا يُصِبْ مِنْهُ.
“আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে বিপদে আক্রান্ত করেন।” (বুখারী: ৫৬৪৫)
? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন:
إِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الخَيْرَ عَجَّلَ لَهُ العُقُوبَةَ فِي الدُّنْيَا، وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى يُوَافِيَ بِهِ يَوْمَ القِيَامَةِ.
“আল্লাহ যখন তাঁর বান্দার কল্যাণ চান তখন দুনিয়াতে তার শাস্তি ত্বরান্বিত করেন, আর যখন কোনো বান্দার অকল্যাণ চান তখন তার পাপগুলো রেখে দিয়ে কিয়ামতের দিন তাঁর প্রাপ্য পূর্ণ করে দেন।” (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৯৬)
? আরেকটি হাদীসে এসেছে:
إِنَّ عِظَمَ الجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ البَلاَءِ، وَإِنَّ اللَّهَ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلاَهُمْ، فَمَنْ رَضِيَ فَلَهُ الرِّضَا، وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ.
“সত্যি, বড় পুরস্কার তো বড় বিপদের সঙ্গেই রয়েছে।”
? রাসূল সা. বলেন,
‘বিপদের প্রথম আঘাতে ধৈর্য ধারণই হচ্ছে প্রকৃত ধৈর্য।’ (বুখারী: ৬৭৩৫)
আল্লাহ আমাদের ‘স-বিরুন’দের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তাউফীক দিন।