একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাশ এন্ড কনফেশন গ্রুপ। নিত্যদিন গড়ে দুই চারটা পোস্ট আসে। বছর গড়িয়ে নতুন ইনটেক হওয়ার পর পোস্টের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখা মানব-মানবী নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গ্রুপে যোগ দেয়। এভাবেই সময়ে সময়ে মেম্বার সংখ্যা বেড়ে চলে। কেউ ঢোকে নিছক কিছু মজা নেওয়ার জন্য, কেউ কিছু জানাবার জন্য তো কেউ নিজেদের নিয়ে কোনো লিখা এল কিনা খোঁজার জন্য।

এভাবে দিন কাটতে কাটতে হঠাৎ একদিন এক ছেলের কনফেশনের পোস্ট আসে, যেটা সাধারণের চেয়ে বেশি ছড়িয়ে যায়। এমনকি সেখানকার ক্ষুদ্র দ্বীনদার সার্কেলেও সেই কনফেশন পোস্টের ব্যাপার পৌঁছে যায়।

কী ছিল সেই কনফেশন পোস্টে? সমাজের চোখে ভদ্র সভ্য এক জাহিল ছেলের লিখা কনফেশন। কিন্তু সে যাকে নিয়ে লিখেছে, তিনি একজন দ্বীনদার পর্দাশীন বোন। পূর্ণাঙ্গ শারঈ পর্দা করেন, অর্থাৎ নিকাব এবং হাত মোজা সহ; কেবল তাঁর চোখ দুটো দেখা যায়। কারও সাথে পারতপক্ষ কথা বলেন না। চুপচাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, বাসায় ফেরেন। আল্লাহু আ’লাম, হয়তো দ্বীনে আসার পরও সেক্যুলার শিক্ষা ছাড়তে না পারার কারণ তাঁর পারিবারিক চাপ। যে ছেলেটি তাঁকে নিয়ে লিখেছে, সে ছেলে তাঁর একই ক্লাসের; ক্লাসমেট।

পুরো কনফেশনে ছেলেটি ওই দ্বীনদার বোনকে নিয়ে নিজের কল্পনা এবং ভাল লাগার সাহিত্যিক বর্ণনা দিয়েছে। এর মধ্যে যে ব্যাপারটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল সেটা ছিল এমন – বোনের চেহারা সে কখনোই দেখে নাই। শুধু চোখ দুটো দেখেছে। আর সেই চোখগুলো দেখেই সে প্রেমে পড়ে গিয়েছে। এরপর আবারও সব রসালো বর্ণনা।

কিছুক্ষণ সময় নিন। ভাবুন।

এই যে ঘটনাটি আজকে আপনাদেরকে জানালাম তা নিঃসন্দেহে স্পর্শকাতর। আর স্পর্শকাতর হওয়ার কারণ হল তা আড়াই কি তিন বছর আগে সত্যিই হয়েছে এবং আমার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। আর আমার মতে, ছোট্ট এই ঘটনায় আজকে আমাদের সমাজ এবং আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে আমাদের অসুস্থতার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। এই অসুস্থতার মধ্যে বসবাস করতে করতে আমরা সেই গাইরাতটুকু হারিয়ে ফেলেছি, যা ছিল নিতান্ত আবশ্যক।

নিকাব পরিহিতা পূর্ণাঙ্গ শারঈ পর্দা করা একজন বোন যখন সহশিক্ষার মতো বিষাক্ত পরিবেশে যান, তখনও তাঁকে নিয়ে জাহিল অসুস্থ ছেলেপেলেদের নানা জল্পনা কল্পনার শেষ হয়না। আর শুধু ওরাই না। এমন বোনেরা একজন দ্বীনদার ভাইয়ের জন্যও যথেষ্ট ফিতনাহ। কিন্তু দ্বীনদার ভাইয়েরা শেষমেশ আল্লাহকে ভয় করলেও জাহিলদের ওইসব কামনা থেকে যেন কোনোই রেহাই নেই। আল্লাহ আযযাওয়াজাল এমনি এমনিই অপ্রয়োজনে নারীদেরকে ঘরের বাহিরে যেতে নিষেধ করেন নাই। আর ‘প্রয়োজন’ এর কোন ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আমরা আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে পারব তা নিজের সাথে সৎ হলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। অন্যথা হয় অসার বাগবিতণ্ডা।

আচ্ছা, শুধুমাত্র যার চোখ দুটো দেখা যায়, সেই চোখ দেখেই যখন পুরুষদের এত জল্পনা কল্পনা হতে পারে, তখন পুরো চেহারা দেখা গেলে? আমাদের ইমামদের বক্তব্যগুলো ঘাঁটলে দেখবেন যারা চেহারা খোলা রাখার ব্যাপারে মত দিয়েছেন, তাঁরাও একটি শর্ত দিয়েছিলেন – ‘ফিতনাহের আশঙ্কা না থাকা’। আর এই ব্যাপারটা খুবই ওজনদার। এটা তাঁদের সময়ে ‘দারুল ইসলামের যুগে’ যেমন ছিল, আজকে আমাদের যুগে ঠিক যেন তার বিপরীত। আর ইমামাদের বক্তব্যে যারা এই ফিতনাহের অংশটুকু না পেয়ে চিৎকার করে উঠে, তবে কি তারা বলতে চায় আমরা যদি ইমামদেরকে এমন বলতাম, ‘শাইখ, ফিতনাহের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি দ্বীনদার বোনদেরকে নিয়ে নিজেদের কামনা বাসনা বলে বেড়ানোরও সমূহ সুযোগ রয়েছে।’ এরপরও ইমামগণ এমন পরিস্থিতিতে নিকাব না করার পক্ষেই রায় দিতেন? আল্লাহ আহলুস সুন্নাহর ইমামগণের ওপর সন্তুষ্ট হন। আল্লাহর কসম, তাঁরা এমন পরিস্থিতির ব্যাপারে কখনোই মুখ খোলা রাখার কথা বলতেন না।

আজকে নিকাবের ব্যাপারে, সহশিক্ষার ব্যাপারে উম্মাহ যতটা নোংরা অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, তা সত্যিই অবাক করা। ইসলামি আন্দোলনগুলোতে বোনদেরকে ‘পুরুষদের ন্যায়’ কর্মী বানিয়ে কাজ করানোর স্রোতে এইসব নোংরা আবর্জনাও ঢুকে গিয়েছে। অথচ আল্লাহ আযযাওয়াজালের দ্বীনের যে হাকিকত, দ্বীন যেমনটা হওয়া উচিত, সেই ব্যাপারগুলোই তলিয়ে গিয়েছে। একজন পর্দাশীন মায়ের ঘরের যেসব ব্যাপার দ্বীনের প্রকৃত দায়িত্বের মধ্যে যায়, যার জন্য নারীর পায়ের নিচে হয় সন্তানদের জান্নাত সেই ব্যাপারগুলো উম্মাহর এক বিশাল অংশ ভুলেই বসেছে।

গাইরাত অন্তরের গহীনের ব্যাপার, উপলব্ধি ও ধারণ করার ব্যাপার। যার লজ্জা নেই, সে সবই করতে পারে। তাকে কোনো খারাপি থেকেই ঠেকানো যায় না। তেমনি যাদের গাইরাত কম, তাদেরকেও দ্বীনের দোহাই দিয়ে, ইমামদের বক্তব্যের দোহাই দিয়ে নিকাবকে খাটো করা, সহশিক্ষাকে সহজ করা ইত্যাদি থেকে বিরত রাখা যায় না। আর আজকে যখন অসুস্থতা গ্রাস করেছে, সেখানে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ঘষামাজা চলতে থাকবেই। অল্পই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অধিক তাকওয়াপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো আঁকড়ে ধরতে পারবে। এই অধমের লিখাটা তাঁদের জন্যই। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমিন।


02/01/2020, 15:01