১.

ড্রইং রুমে ল্যান্ডফোনের আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে দৌড়ে ফোন রিসিভ করলো সাবা।

- হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।

- ওয়া লাইকুম আসসালাম, সাবা কেমন আছো?

ফোনের ওপাশের কণ্ঠ শুনে সাবা কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায়। পাশে কেউ থাকলে হয়তো ওর হার্টবিট শুনতে পেতো।

- কে? সাব্বির ভাইয়া! জ্বী ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? অনেকদিন আসেন না আমাদের বাসায়।

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ধীরে উত্তর দিলো সাবা।

- কে বলেছে অনেকদিন যাই না?! গত সপ্তাহে-ই তো গেলাম! তুমি কেক বানালে সেটা খেলাম। আচ্ছা, তুমি কি আগে থেকেই জানতে আমার চকলেট কেক পছন্দ?

- গত সপ্তাহ মানে সাতদিনেরও বেশি! আর ভাইয়া একবার চকলেট কেক খাওয়ার সময় বলেছিলো আপনি নাকি চকলেট কেক এতটাই পছন্দ করেন পারলে একা একটা সাবার করে ফেলেন!

- হুম, তার মানে আমার জন্য ছিল ওইদিনের কেকটা!

- না মানে ভাইয়া…..

- হা হা হা হা, থাক আর বাহানা বানাতে হবে না ছোট্ট পাখি! সাকিব কোথায়? দাও তো ওকে!

- ভাইয়া তো এই সময় বাসায় থাকে না। আপনি জানেন না বুঝি? মোবাইলে ফোন করলে পাবেন।

- ওহ হ্যাঁ! মোবাইলে-ই তো ফোন করা উচিত ছিল। আর এই দুপুরে তো ওর বাসায় থাকার কথাও না। এই সময় আন্টিও কাজে নাহয় নামাজে থাকেন! তুমি ছাড়া আর কেউ ল্যান্ডফোন রিসিভ করে না, তাই না ছোট্ট পাখি?

- আপনি কিভাবে জানেন? আর ভাইয়াকে এই সময় বাসার নাম্বারে পাবেন না জেনেও ফোন করলেন কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো সাবা।

- তোমার জন্য!

সাব্বির ফোনটা রেখে দিল। ফোন কেটে যাওয়ার পরও সাবা ফোনের রিসিভ ধরে রাখলো! কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে যা প্রকাশ করার মতো না। পুরো দুনিয়াটা এত অন্যরকম মনে হচ্ছে সাবার। এক দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো সাবা। “আচ্ছা, আমি যেমনটা ভাবছি তেমন কিছুই কি সাব্বির ভাইয়া মিন করেছে? সত্যিই যদি তা-ই হয় তাহলে! আর সাকিব ভাইয়া যদি জানতে পারে! কি হবে!” মনে মনে ভাবছে সাবা।

মাত্র ক্লাস এইটের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করল সাবা। বাবা, মা আর সাবার সাত বছরের বড় ভাই সাকিব নিয়ে ছোট পরিবার। বড় ভাইয়ের বন্ধু হওয়ার সুবাদে সাবার সাথে সাব্বিরের প্রায়ই কথা হয়। সুদর্শন ও বন্ধুসুলভ আচরণ দেখে সাবা নিষ্পাপ মনে কখন যে সাব্বিরের প্রতি অন্যরকম ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছে সাবা নিজেও বুঝে উঠতে পারে নি। আর বয়সটাও তার অবুঝ! সাব্বির যদিও বুঝতে পেরেছে তার প্রতি সাবার এই দুর্বলতা!

২.

সন্ধ্যায় সাকিব বাসায় ফিরে জানায় এবার সাব্বিরদের বাসায় থার্টি ফার্স্ট নাইট পার্টি। আর সাব্বিরের বোন আর কাজিনরা থাকবে তাই সাবাকেও ইনভাইট করেছে। সাবার দুপুরের খুশি আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল। যেমনটা ভেবেছিল তার সম্ভাবনাও আরও বেড়ে গেল। কিন্তু সাকিবের মা দিলারা জাহান কিছুতেই রাজি না।

- প্রশ্নই আসে না সাকিব! তুই-ও যাবি না সাবা তো না-ই!

- আম্মু তোমরা সব সময় এমন করো কেন! কোনকিছুতেই যেতে দাও না আমাদের।

জেদের সুরে বললো সাকিব।

- তোদের বাবা কখনো রাজি হবেন না। আর কি এসব নিউ ইয়ার থার্টি ফার্স্ট নাইট পার্টি সার্টি!

- এটা দাওয়াত আম্মু! আর সাব্বিরদের বাসায় হবে পার্টি। ওদের ফ্যামিলির বড়রাও থাকবে ওখানে।

- আমি কিচ্ছু জানি না। তোদের বাবার কাছে জিজ্ঞেস কর।

- আচ্ছা বাবা আসুক। বাবাকেই বলবো!

রাতের খাবারের শেষে সাকিব বাবার কাছে অনুমতি চাইল। সাকিব জানত সাঈদুর রহমান কিছুতেই অনুমতি দিবেন না রাতে থাকার। তাই শুধু রাতের খাবারের দাওয়াত এইটুকুর জন্য অনুমতি চাইল সাকিব। সাবা আর সাকিব খুশিতে লাফিয়ে উঠল। আর মা দিলারা জাহান দাঁত কটমটিয়ে তাকিয়ে রইলেন দুই ভাইবোনের দিকে।

রুম থেকে বের হওয়ার পর মায়ের পা ধরে সাকিব বললো, “মা গো বাবাকে কিছু বলো না, প্লিজ। টেনেটুনে সাড়ে ১২টার মধ্যে চলে আসব। কাছেই তো ওদের বাসা। তাও তো বন্ধুদের বলতে পারব থার্টি ফার্স্ট নাইটের পার্টিতে গিয়েছিলাম।” সাবাও পাশে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসে ভাইয়ের কান্ড দেখে। রাগ হয়ে রান্নাঘরে চলে গেল দিলারা জাহান।

সাবা পুরো আলমারি খুঁজে মন মতো কিছু পাচ্ছে না। কী পরে যাবে পার্টিতে? সাব্বির কি পছন্দ করবে! হঠাৎ লাল রঙের জামাটার কথা মনে পরলো সাবার। এবারের ঈদে লাল সালোয়ার কামিজ পরা দেখে সাব্বির বলেছিলো, “বাহ! লাল রঙে তো তোমাকে বেশ মানায়।” সেই রাতেই লাল সালোয়ার কামিজের সাথে ম্যাচিং করা সব কিছু ঠিক করে রাখলো সাবা।

পার্টিতে কি হবে? সবার সাথে কীভাবে কথা বলবে! এতো মানুষের ভিড়ে সাব্বির ওর সাথে কথা বলবে কি না! এই ভেবে সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলো সাবা। সাবাদের ক্লাসের কয়েকজন মেয়েরও বয়ফ্রেন্ড আছে। সাবা ওদের প্রেমের গল্প শুনে। সাবার হঠাৎ মনে হলো, “ইশ! স্কুলটা যদি খোলা থাকতো তাহলে কিছু টিপস নেয়া যেত ওদের কাছ থেকে! ফোনে কি আর এত কিছু বলা যায়!”

৩.

সাব্বিরদের বাসায় গিয়ে সাবা দেখল সব মেয়েরা অনেক মেকআপ করে এসেছে। কয়েকজন ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরেছে! মায়ের উপর সাবার ভীষণ রাগ হচ্ছে সাবার, লিপস্টিকটা পর্যন্ত দিতে দেয় নি! তার উপর এই খ্যাত মার্কা সোয়েটার চাপিয়ে দিয়েছে। সাবার মনে হচ্ছে মেইন গেট থেকে পালিয়ে যায়! এত সুন্দর মেয়েগুলোর মাঝে কি সাব্বির সাবার দিকে তাকাবে! পার্টিতে গিয়েই সাকিব সাবাকে এক কর্ণারে বসিয়ে বন্ধুদের সাথে যোগ দিয়েছে। সাবার চোখ শুধু সাব্বিরকে খুঁজছে।

হঠাৎ কোথা থেকে সাব্বির এসে সাবার পাশে ধপ করে বসে পড়লো। সাবা প্রথমে ভয়ে চমকে উঠলো। সাব্বিরকে দেখে সাবা লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে।

“বাহ! সেই লাল রঙ। তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।” সাব্বির পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইল সাবার দিকে। আর সাবা লজ্জায় আর চোখ তুলে তাকায় না।

“সুন্দর নাকি ছাই! সব আপুরা কত্ত সুন্দর! আর আমি…”

সাবা কথা শেষ হওয়ার আগেই সাব্বির বললো, “তুমি তোমার মতো সুন্দর। এরা তো মেকআপ মেখে সুন্দর! তুমি আমার মন মতো সুন্দর। আমার ছোট্ট একটা পাখি তুমি!”

সাবার পুরো শরীর কাঁপছে। ভয়ে নাকি লজ্জায়। সব কিছু যেন থেমে গেছে। এত মিউজিক, এত মানুষের আওয়াজ কিচ্ছু নেই। শুধু সাব্বিরকে দেখতে পাচ্ছে সাবা। মনে হচ্ছে এই একটা মানুষ ওর পুরো পৃথিবী জুড়ে। সাবার নিষ্পাপ মনে ভালো লাগা আজ সাব্বিরের ভালোবাসায় পূর্ণতা পেল যেন।

সাবার সমবয়সী সাব্বিরের কাজিনদের সাথে এক কর্ণারেই বসে ছিল। সবাই গল্প করছে কিন্তু সাবা পার্টিতে থেকেও যেন নেই। সাব্বিরের কথাগুলো ছন্দের মতো কানে বাজছে সাবার। ঘুরে-ফিরে চোখ শুধু সাব্বিরকে খুঁজে বেড়ায়। “নতুন বছরটা কত সুন্দর করে শুরু হলো। পুরো বছরটাও এতো চমৎকার কাটবে”—ভাবছে সাবা।

এইতো রওনা দিচ্ছি করতে করতে পার্টি শেষ করে সাকিব সাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১টা! সাঈদুর রহমানের রাগারাগি বকাঝকা সাকিবের গায়ে বাঁধলো না। শেষ পর্যন্ত জীবনের প্রথম থার্টি ফার্স্ট নাইট সেলিব্রেশন তো হলো! এমন বকাঝকা তো রোজকার কাহিনী।

সারারাত সাবার ঘুম হলো না। সাব্বিরের কথা গুলো মনে পড়ছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে একটু কথা বলতে। সাব্বিরের কথাগুলো আরও শুনতে, বারবার শুনতে! আবার এ চিন্তা মনে আসছে বাসার সবাই জানতে পারলে কি হবে! আবার ভাবছে—ভয় পাওয়ার কি আছে? বাবা মা তো সাব্বিরকে অনেক পছন্দ করে। আর সাব্বিরের পড়ালেখা শেষ হলেই তো বিয়ে করে নিয়ে যাবে। কত যে স্বপ্ন বাসা বাঁধছে সাবার মনে!

সাব্বির প্রতিদিন দুপুরের সময়টাতে ল্যান্ডফোনে ফোন করত। আর সাবা ঠিক ওই সময়টাতে ফোনের আশেপাশে ঘুরঘুর করত। মা দেখে ফেললে কোনো এক বান্ধবীর নাম বলে দিতো। বন্ধের দিনগুলোতে ফোনে কথা বলা হতো। তাই সাব্বির সাবাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য সাকিবের সাথে দেখা করার অজুহাতে ওদের বাসায় যেত। সাব্বির সাবাকে একটা মোবাইল গিফট করতে চাইলে সাবা কিছুতেই নিতে রাজি হয়নি।

বাসার কাছেই থাকে এক বান্ধবীর সাথে স্কুলে, কোচিং এ যাওয়া আসা করতো সাবা। সাবার স্কুলের বাইরে, কোচিং এ দেখা করতে যেত সাব্বির। ততদিনে সাবার বান্ধবীরা ওদের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছে। পাঁচ-দশ মিনিটের জন্য দেখা আর ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলা এভাবেই চলছিল। সাবা পুরোপুরি সাব্বিরকে বিশ্বাস করছে। নাকি বলা যায় সাব্বির তার ব্যবহারে জিতে নিয়েছে সাবার বিশ্বাস!

৪.

একদিন সাব্বির সাবাকে জিজ্ঞেস করলো, “সাবা তুমি আমাকে কতটুকু বিশ্বাস করো?”

সাবা বললো, “পুরোপুরি বিশ্বাস করি—এটা কি আবার বলতে হয় নাকি!”

“হুম, তাহলে এভাবে চার পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করো কেন? আমি একটু মন ভরে শান্তি মতো তোমাকে দেখতেও পারি না। প্রতিদিন তোমাকে দেখতে যাই আর তুমি আমাকে সময়ই দিতে চাও না!”—সাব্বির বলল।

- কি করবো বলেন! আমি তো বাসার বাইরে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। আমারও ইচ্ছা করে আপনার সাথে অনেক কথা বলতে। কিন্তু….”

- কিন্তু কী! আর তুমি আমাকে তুমি ডাকো না কেন? প্লিজ তুমি করে বলো! আর আমি কিছু জানি না, আর চারদিন পর ১৪ই ফেব্রুয়ারী। আমাদের প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স ডে! আমি তোমার অনেক সময় চাই। তুমি ম্যানেজ করো লক্ষীটি! আবদারের সুরে বললো সাব্বির।

- ওহ হ্যাঁ তাই তো! আমার ফ্রেন্ডরা বলাবলি করছিল। কিন্তু কীভাবে ম্যানেজ করবো?!!

- স্কুল বাংক করো, কোচিং বাংক করো, বাসায় মিথ্যা বলো, কিছু একটা করো! তোমরা ফ্রেন্ডরাও নিশ্চয়ই ওদের বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবে? প্লিজ যেভাবে হোক ম্যানেজ করো!

- আচ্ছা আমি ট্রাই করবো। আপনি রাগ করবেন না প্লিজ।

- ট্রাই না, কথা দাও আমাকে?

- আচ্ছা, ওকে! এখন রাখি আম্মু চলে আসবে।

- ওকে! লাভ ইউ!

- লাভ ইউ টু!

সাব্বিরের আবদারে কেমন অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে সাবার মনে। কীভাবে সময় ম্যানেজ করবে? সাব্বিরকে না করা যাবে না। রাগ করবে। এই প্রথম এত আবদার করে কিছু বলেছে। কিন্তু কী বলে বাসা থেকে বের হবে! না কি যাবেই না সেদিন! বাসায় জেনে গেলে! সাবা কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে পরদিন স্কুলে গিয়ে বান্ধবী নিশিতাকে সব কিছু বলল।

- হুম, তো যাবি! বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে যাবি না?!

- ঘুরতে যেতে তো চাই। কিন্তু কীভাবে?!! আর কেউ দেখে ফেললে! উৎকন্ঠা মিশ্রিত কন্ঠে বললো সাবা।

- গত মাসে আমার বয়ফ্রেন্ডের বার্থডে ছিল। আমি স্কুলে না এসে ওর সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম। পরদিন লিভ ফর্মে মা’র সাইন নকল করে স্কুলে জমা দিয়েছিলাম। মনে আছে তোর?

- হুম! তোর কি সাহস নিশিতা! বাপ-রে! আমাকে দিয়ে এমন কিছু হবে বলে মনে হয় না রে!

- না হলে আবার ঘুরতে যেতে লাফাচ্ছিস কেন? না করে দে তোর বয়ফ্রেন্ডকে। আর এতটুকু সাহস না থাকলে প্রেম করার-ই বা কি দরকার “ডেডিস প্রিন্সেস”!

- তোর কাছে সাজেশন চেয়েছি খোঁটা শুনতে আসি নাই। সাহস আমারও আছে। দেখ আমি কী করি! রাগ করে চলে গেল সাবা।

- সাহস খানা সত্যিই দেখতে চাই বান্ধবী! পেছন থেকে হেসে হেসে বলল নিশিতা।

সাবা সাহস করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে সাব্বিরের সাথে বেড়াতে যাবে। যেভাবেই হোক! সাব্বিরকে জানালো সাবা। সাব্বির সাবাকে প্ল্যান বুঝিয়ে দিল। সাবা আগের দিন ওর স্কুল ফ্রেন্ডদের সব জানিয়ে রাখলো যাতে টিচাররা ওর খোঁজ করলে যেনো ওরা সামাল দেয়।

সাবার আগের রাতটা কাটলো নির্ঘুম। বাসার কেউ বা পরিচিত কেউ দেখে ফেলে যদি—এই ভয় যেমন কাজ করছিল সাবার মনে তেমনি ভালোবাসার মানুষটার সাথে এই প্রথম কোথাও বেড়াতে যাবে এই খুশিও ছিল সাবার মনে।

৫.

১৪ই ফেব্রুয়ারী সারাদিন ভালো কাটলো সাবার। যেভাবে প্ল্যান করেছিল সেভাবেই সব ঠিক ছিল। কোচিং এ গিয়ে ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে জানতে পারলো স্কুলেও কেউ সন্দেহ করেনি, কিছু জিজ্ঞাসাও করে নি। বাসার পরিবেশও স্বাভাবিক। বান্ধবীরা উৎসুক হয়ে জানতে চাইল কোথায় গিয়েছিল ওরা, কী কী কথা হয়েছে! কিন্তু সাবা ওদের প্রশ্নগুলো হাসিমুখে এড়িয়ে গেল।

রাতের খাবারের টেবিলে নিজের প্ল্যাটের ভাতের গুলো আঙুল দিয়ে নাড়ছে সাবা। ওকে চুপচাপ অন্যমনস্ক দেখে সাকিব বললো, “কি রে কই আছিস সাবা! খাচ্ছিস না কেন?”

সাবা যেন চমকে উঠলো! “এইতো খাচ্ছি ভাইয়া!”—অপ্রস্তুতভাবে উত্তর দিলো সাবা।

সাবার মনে কেমন যেন অপরাধবোধ কাজ করছে। এই প্রথম বাবা মা’র সাথে, স্কুলের টিচারদের সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সে। সবাই কতটা বিশ্বাস করে ওকে, যে কেউ টেরই পেল না! বাবা আজও অফিস থেকে ফেরার পথে সাবার পছন্দের ফ্লেবারের আইসক্রিম কিনে এনেছে। সাবার অন্তরে অপরাধবোধ যেন চেপে বসেছে। ইচ্ছা হচ্ছে সব সত্যি বলে দিতে। কী আর হবে! মারবে! অনেক মারবে, মারতে মারতে মেরেই ফেলুক! এরই হয়তো যোগ্য সে! এমন কাজই তো করেছে সে!

রাতে অনেক কাঁদে সাবা। কীভাবে এমনটা করলো। কেন সাব্বিরকে নিষেধ করলো না সে। কাউকে কিছু বলতেও পারবে না। নিজেও সইতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পরেছে সাবা নিজেও জানে না।

পরদিন দুপুরে সাব্বির যথারীতি ফোন করে খোঁজ নেয়। জানতে চায় কেউ সন্দেহ করেছে কি না! স্বাভাবিকভাবে কথা শেষ করে রেখে দিলো সাব্বির। সেই থেকে আর সাব্বিরের কোনো ফোন আসে না। প্রতিদিন সাবা অপেক্ষা করে কিন্তু আর ফোন আসে না। প্রতিদিন স্কুলে, কোচিং এ যাওয়া আসার পথে সাবা পুরো পথে সাব্বিরকে খোঁজে। সাকিবের সাথে দেখা করতেও বাসায় আসে না সাব্বির। দু’চারবার সাব্বিরের মোবাইলে ফোন করেছিল সাবা, কিন্তু সাব্বির ফোন রিসিভ করে নি।

এদিকে বাসায় সাব্বিরকে নিয়ে যখনই কথা উঠে সাবা খুব ইতস্তত বোধ করে। বাবা মায়ের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতার অপরাধবোধ আর সাব্বিরের এমন লাপাত্তা হয়ে যাওয়া সাবা যেন মেনে নিতে পারছে না। নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নিয়েছে সাবা। খাওয়া দাওয়া, পড়াশোনা, স্কুল কোচিং, বান্ধবীদের সাথে গল্প করা—কোথাও আর সাবা নেই।

বান্ধবীরা হাসি ঠাট্টার ছলে বলে, “কি রে সাবা প্রথম প্রেমেই ছ্যাকা খেলি! থাক! প্রেম আবার আসবে জীবনেএএএ…..”

সাবা আরও নিজেকে একা করে নিলো। পরিবারের সবাই কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, কী হয়েছে ওর! কিন্তু সাবার কাছে এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই!

৬.

স্কুল থেকে সাবার ক্লাস টিচারের ফোন পেয়ে ছুটে গেলেন মা দিলারা জাহান। সাবা সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছে। সাবার বাবাকেও তারা ফোন করেছে এখনই স্কুলে যাওয়া জন্য। স্কুলে পৌঁছে হেডমিস্ট্রেসের রুমে গিয়ে যা জানতে পারলো সাঈদুর রহমান ও দিলারা জাহান, তা হয়তো তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। হেডমিস্ট্রেস জানালেন, ডাক্তার যে টেস্ট দিয়েছে সাবাকে সেটার রিপোর্ট যদি পজেটিভ হয় তাহলে সাবাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হবে।

সাবাকে নিয়ে বাসায় ফেরার পর সাবার মা যা হাতের কাছে পেল তা দিয়েই সাবাকে ইচ্ছা মতো মারল। সাবা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। মা বাবার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো সাহস তার হচ্ছে না। সাব্বিরের সাথে যদি কোনো যোগাযোগ থাকতো তাও হয়তো সে নামটা বলতে পারত। কিন্তু সাব্বিরের কোনো খবর নাই আজ তিন মাসের বেশি।

সাঈদুর রহমান এখনো শান্ত আছেন। তার ছোট্ট মেয়েটা এমন কিছু করবে এটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। রাতে রিপোর্ট হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। সাকিব বাসায় ফিরে সব জানতে পেরে সাবাকে মারার জন্য যায় কিন্তু বাবা সাঈদুর রহমান বাঁধা দেন।

সব রিপোর্ট হাতে ডাক্তারের কাছে গিয়ে যা জানতে পারলেন সাঈদুর রহমান, তাতে তার পায়ের নিচের মাটি যেন সরে গেল। লজ্জায় মাথা নুয়ে পড়ল। সাবার দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে বলল, “এরচে তুই মরে যেতিস। আমার এত কষ্ট হতো না।”

সাবা এতো কিছু শুনেও প্রাণহীন দেহের মতো বসে রইল ডাক্তারের সামনে। ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, বাচ্চা এবোর্ট করা পসিবল না! এতে সাবার লাইফ রিস্ক আছে। পুরো প্রেগন্যান্সিতে সাবার অনেক যত্ন প্রয়োজন। শত হোক বাবা মা তাই মেয়েকে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার মতো নিষ্ঠুরতম সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি।

বাসায় নিয়ে গিয়ে সাবাকে সামনে বসিয়ে জানতে চাওয়া হয়—কে সেই ছেলে! সাবা চুপ করে বসে থাকে। সাবাকে মারতে গিয়েও পারলো না বাবা আর ভাই। সাবাকে আশ্বাস দেয়া হয় সেই ছেলের পরিবারের সাথে কথা বলে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। অনেকক্ষণ পর সাবার মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দ বের হলো, “সাব্বির!” সাবার পরিবারের কারো কল্পনাতেও আসেনি যে সাব্বির এমন কিছু করবে—তাও সাবার সাথে! সাকিব এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সাব্বিরের বাসার উদ্দেশ্য বাসা থেকে বের হয়ে গেল। সাকিবকে এভাবে বের হয়ে যেতে দেখে সাঈদুর রহমানও পিছু নিলেন।

সাব্বিরদের বাসায় গিয়ে সোজা সাব্বিরের রুমে ঢুকে কলার চেপে ধরে তিন চারটা ঘুষি বসিয়ে দিলো সাকিব। আর চিৎকার করে বলতে থাকে, “তুই আমার বোনের সাথে এমন করলি কেন? তোর এত বড় সাহস হয় কি করে?” সাকিবের চিৎকার শুনে সাব্বিরের বাবা মা সেখানে যায়। সাকিবকে টেনে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে সাব্বিরের বাবা মা ও সাঈদুর রহমান। সাব্বিরও চিৎকার করে বলে উঠে, “কি করেছি আমি! হ্যাঁহ!”

সাকিব উত্তেজিত কন্ঠে আবার বলে, “কী করেছিস সেটা তুই ভালো করে জানিস সাব্বির। মাই সিস্টার ইজ ক্যারিয়িং ইয়োর চাইল্ড, সাব্বির!”

পাশ থেকে সাব্বিরের বাবা ইকবাল হাসান বলে উঠলেন, “চুপ করো! কি আবলতাবল বকছো আমার ছেলেকে নিয়ে!”

“আমি যা বলছি, সত্যি বলছি। আপনার ছেলেকে এখন সব স্বীকার করে নিতে বলেন”—সাকিব বলল।

সাঈদুর রহমান সাহেব সবাইকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করলেন। সাব্বিরের বাবা মাকে সব জানানো হলে তারা উত্তেজিত কন্ঠে বললেন, “আপনার মেয়ে কিসের জন্য গিয়েছিল?! আপনারা মেয়ে সামাল দেন নি কেন! এই বয়সেই এই হাল মেয়ের। এই মেয়েকে আমরা বউ করে আনি কি করে!”

সাঈদুর রহমান রাগ চেপে বললেন, “দুজনেরই দোষ এতে। সাব্বিরকেও আমরা নিজের পরিবারের মতো জেনেছি। একই টেবিলে বসে খেয়েছি। অনেক পছন্দ করতাম ওকে আমরা। আমার ছেলেকেও আপনারা অনেক আদর যত্ন করতেন—সেটাও আমরা জানি। এটা দুই পরিবারের মান সম্মানের ব্যাপার। এবরশনের অবস্থা থাকলে আমরা এখানে আসতাম না।”

সাব্বিরের মা বললেন, “আচ্ছা আপনি কী করে শিউর হলেন বাচ্চাটা সাব্বিরের?”

সাকিব আর চুপ থাকতে পারল না। সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “সাব্বির এখনো চুপ কেন? তুই নির্দোষ হলে জবাব দে! আঙ্কেল, আপনার ছেলে যদি নির্দোষ হতো তবে কি চুপ করে বসে থাকতো?”

সাব্বিরের বাবা মায়ের কোনো জবাব নেই।

সাঈদুর রহমান সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে আপনারা যখন প্রমাণ চাচ্ছেন তাহলে ডিএনএ টেস্ট করে দেখা হবে।”

সাব্বিরদের বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সাকিব সাব্বিরকে জিজ্ঞেস করলো, “সাব্বির আমি কি কোনদিন তোর কোনো ক্ষতি করেছিলাম? আমার ছোট বোনটার জীবন কেন নষ্ট করলি?”

সাব্বির হেসে উত্তর দিলো, “ডুড, তুইও তো তোর গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটে যাস। তারাও কারো না কারো বোন, মেয়ে!”

সাকিব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে। বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। বারবার মনে হয়, “আমি কি কারো এত বড় ক্ষতি করে ফেলেছি?!”

সাবার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে সব জানাজানি হয়ে যায়। এমন মুখোরচক গল্প কি আর গোপন থাকে। মানুষের কথার ভয়ে সাবার পরিবার ডোর বেলের আওয়াজে আঁতকে উঠে।

এলাকা বদলাতে হলো শেষ পর্যন্ত। সাকিবকে ইউনিভার্সিটি ছাড়তে হলো। কষ্টে অপমানে সাঈদুর রহমান সাহেব হার্ট অ্যাটাক করে হাসপাতালে। এদিকে ঘটনা জানাজানির দুই সপ্তাহের মধ্যে সাব্বিরকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে ওর বাবা। সাব্বিরের বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ছাড়া আর কিছু পায়নি সাবার পরিবার।

আর সাবা! আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার মত ভয়ঙ্কর সাহসটাও পাচ্ছে না। ওই যে স্কুলের ধর্ম টিচার বলেছিলেন, আত্মহত্যা মহা পাপ! চির ঠিকানা জাহান্নাম! মনে গেঁথে গিয়েছিল কথাটা। যদি কেউ হারাম সম্পর্ক, যিনা, ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কে সাবধান করতো, তাহলে হয়তো এই পথে হাঁটা হতো না সাবার!

ছয় মাস পর সাবা একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান জন্ম দেয়। সন্তান জন্মের সময় সাবার অবস্থা খুব ক্রিটিকাল হয়ে যায়। দুইদিন পর্যন্ত জীবন মৃত্যুর মাঝে লড়ে সাবার জীবন হেরে যায় মৃত্যুর কাছে। সাবার সদ্যোজাত সন্তানের ঠিকানা হলো এতিমখানা। সাবা মারা যাওয়ার পর আত্মীয় স্বজনরা এসে বলছিল, “মরে গিয়ে তোমাদের রক্ষা করে গেল। আর কেঁদো না ওমন মেয়ের জন্য।”

কিন্তু বাবা মায়ের মন কি আর তা মানতে চায়! সাবা তো না জানি শেষ কবে কথা বলেছিল। চুপ করে ঘরের এক কোনায় বসে থাকতো। সাবার দিকে তাকিয়ে বাবা মায়ের অন্তর কেঁদেছে বহুবার। মরণ অব্দি চলবে তাদের এই কান্না। কত স্বপ্ন ছিল এই সন্তানকে ঘিরে। সাবার বাবা-মাও নিজেদের দোষ খুঁজে বেড়ায়। সন্তান লালন পালনের কোন দিকটায় কমতি রেখে ছিলেন তারা? ভালো স্কুল কলেজ, খাবার, পোশাক সব-ই তো দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আদব, শিক্ষা দিক্ষা সব কিছুতেই কি কমতি ছিল?!!


14/02/2020, 10:00
চোরাবালি
আদিনা আমাতুল্লাহ

১. Who are the mahrams in front of whom a woman can uncover?
২. He committed zina with her and she got pregnant; can he marry her..
৩. What is the ruling on celebrating Valentine’s Day?
৪. Celebrating new year: https://youtu.be/vFyBYQi9uWY