অপ্রয়োজনীয় যেকোন বস্তু থেকে বেঁচে থাকা মু'মিনের বৈশিষ্ট্য। অপ্রয়োজনীয় কথা, অপ্রয়োজনীয় কাজ, অপ্রয়োজনীয় তর্ক এবং- অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান। প্রথম ব্যাপারগুলো নিয়ে আমরা মোটামুটি সচেতন হলেও শেষেরটি প্রায়ই ইগনোর করি। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে জিনিসগুলো থেকে আল্লাহ্র কাছে খুব বেশি পানাহ চাইতেন তার একটি হল সেই জ্ঞান যা কোন কাজে লাগে না।
স্কুলে থাকতে আমার সহপাঠীদের কাউকে কাউকে দেখতাম বিভিন্ন জটিল জটিল বৈজ্ঞানিক থিওরি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখে। স্ট্রিং থিওরি, বিগ ব্যাং থিওরি, রিলেটিভিটি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বরাবরই এসবে অপটু। এরপর আমিও সোরেইন কিয়ের্কেগার্ডের অস্তিত্ববাদ, বার্টান্ড রাসেলের রিলেটিভিটি ইত্যাদি বইপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করলাম। কিন্তু কোনটাই খুব বেশি দূর এগোতে পারিনি, কারণ আগ্রহ আর ধৈর্য দুটোরই অভাব। কোন এক অজ্ঞাত কারণে বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ভারী ভারী বৈজ্ঞানিক আলোচনা আমাকে কখনোই তেমন টানত না। সেসময় সমবয়সীদের প্রিয়পাঠ্য জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনের ভক্তও আমি কোনকালেই ছিলাম না।
আজকে যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করে আমি স্টিফেন হকিং এর থিওরি সম্পর্কে এত অজ্ঞ কেন, খুব সহজে হেসে উত্তর দিতে পারি-"ভাই উনার থিওরির নলেজ আমার কোন কাজে লাগছে না, ভবিষ্যতেও লাগার সম্ভাবনা দেখছি না।"
এই ব্যাপারটা নিয়েই আজকে লিখতে বসেছি। আমাদের জ্ঞানের পরিধি কতটুকু? খুব সামান্য অবশ্যই। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যায় এই সামান্য অংশটুকুরও বেশিরভাগ জুড়েই আছে এমনসব থিওরি, ফিলোসফি, যা আমাদের জীবনে কোনই কাজে আসে না। বলুন তো ছোটবেলার হাট্টিমাটিম থেকে আজ অবধি যত কবিতা মুখস্থ করেছেন, তার সামান্য অংশও কি আজ কাজে আসছে? বলুন তো ছোট থেকে পড়ে আসা এত বই, এত কাহিনী, তার কোনটা আপনার ব্যক্তিগত জীবনে উপকারে এসেছে?
ইসলাম নিয়ে যেকোন ব্যাপারে আমাদের কমন অজুহাত হয়-সময় নেই, কিংবা অজ্ঞতার কারণে এটা করে আসছি। অজ্ঞতা অপরাধ নয়, কিন্তু প্রশ্ন হল জানার চেষ্টা কি আমরা আসলেই করেছি? আজও কি করছি? বেশিরভাগক্ষেত্রেই নেতিবাচক উত্তর আসবে।
ব্যাপারটা হল, আপনার মস্তিষ্ক খালি থাকবে না। দরকারি জিনিস প্রবেশ না করলে তা অদরকারি জিনিস দিয়েই ভর্তি হবে। ইসলামের বেসিক বিষয়গুলো না জানা মানুষগুলোর ধারণা হয়ে গেছে অজ্ঞতার দোহাই দিয়ে আমলের ত্রুটির ক্ষেত্রে পার পাওয়া যাবে।
দেখুন, সিরিয়াসলি বলছি, আল্লাহ্র সাথে ফাঁকিবাজি চলে না। এমন না যে মানুষ ইসলামিক বই পড়ে না বলে অন্য কোন বইও পড়ে না। হুমায়ূন, জাফর, সমরেশ, ড্যান ব্রাউন, রবিন্দ্র পড়তে কারো ক্লান্তি আসে না। জটিল জটিল গাণিতিক থিওরেম নিয়ে ম্যাথ সলভ করার সময়ের অভাব হয় না। অপ্রয়োজনীয় সব হাইপোথেটিকাল এক্সপ্ল্যানেশানে আমাদের চেষ্টার ত্রুটি হয় না। অথচ বেশিরভাগ লোক 'মাহরাম কারা'-এই কথাটিও জানে না, জানতে চায় ও না; অথচ এই জ্ঞানটি সব মুসলিমের থাকা আবশ্যক। কিন্তু এদের মতে এসব নলেজ হুজুরদের থাকাই যথেষ্ঠ, সবার হুজুর হবার কী দরকার! হুজুররা পড়বে ধর্ম আর বাকিরা পড়বে বিজ্ঞান আর সাহিত্য! পড়তে শেখার পর সর্বপ্রথম যে বইটা জানা ফরয সেটা হল আল কুরআন। আমাদের কুরআন পড়ার সময়টুকু, ইসলাম জানার সময়টুকু নিয়ে নিচ্ছে এমন সব পড়াশোনা, যা আখিরাতে তো নয়ই, দুনিয়াতেও আমাদের উপকৃত করে না। এই সময়গুলোর হিসাব কি দিতে হবে না?
ইমাম আনোয়ার আল আওলাকি রাহিমাহুল্লাহ এই ব্যাপারটার একটা চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন। কুরআন হচ্ছে সকল জ্ঞানের আধার। আমরা লক্ষ করলে দেখব কুরআনে নবী-রাসূলদের ঘটনা বা কোন ঐতিহাসিক বর্ণনায় স্থান-তারিখ এসব তেমন উল্লিখিত হয় নি। অপরদিকে বাইবেলের দিকে তাকালে আমরা দেখব সেখানে তারিখ, স্থান, কে কার পরিবারে, তাদের সদস্যদের নাম, কার সাথে কার বিয়ে হয়েছে ইত্যাদি বর্ণনা আছে। কুরআনে এসব নেই। কেন? কারণ এই বর্ণিত ঘটনাগুলো থেকে আমরা কী মেসেজটা নেব সেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো কোন তারিখে ঘটেছে তা গুরুত্বপূর্ণ না। কুরআন হচ্ছে হিদায়াহর গ্রন্থ, তাই যে ব্যাপারগুলো হিদায়াহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ না, সেগুলো কুরআনে আসেনি। যেমন নবী-রাসূলদের জন্মের ঘটনাও অমিট করা হয়েছে, ব্যতিক্রম ঈসা (আ), ইয়াহইয়া (আ) এবং মূসা (আ)। কারণ তাঁদের জন্মের ঘটনার মধ্যে আল্লাহ্র নিদর্শন রয়েছে, মুজিযা রয়েছে, যেগুলো মানুষের শিক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইব্রাহীম, সালিহ, হূদ 'আলাইহিমুস সালামদের জন্মের ঘটনার উল্লেখ নেই, কারণ সেগুলোর জ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ না।
সুতরাং আমরা কী শিখছি সেটা ভেবে দেখা উচিত। যে জ্ঞান আমাকে আল্লাহ্র নিকটবর্তী করবে না, সে জ্ঞান আমাকে আল্লাহ্র থেকে দূরেই সরিয়ে নেবে, কারণ এদুটোর একটিই ঘটতে হবে, আর অপশন নেই। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন জ্ঞানের মূল কথা হল আল্লাহ্র ভয় সৃষ্টি। সুতরাং যে জ্ঞান আল্লাহ্র ভয় সৃষ্টি করে না, সেটা মূলত জ্ঞান নয়, শয়তানের অস্ত্র। মিউজিক যেভাবে মানুষের অন্তর থেকে আল্লাহ্র যিকর সরিয়ে ফেলে, তেমনি অর্থহীন থিওরি আর তথ্য দিয়ে মস্তিষ্ক ভর্তি করলে আল্লাহ্র স্মরণ দূরে সরে যাবে, এটা নিশ্চিত।
আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান থেকে হিফাযত করুন। আমীন।