সন্দেহ নেই যে, ইলম শেখার গুরুত্ব সব যুগেই রয়েছে। নর হোক বা নারী, প্রতিটি মুসলিমেরই নিজের জীবনের প্রাসঙ্গিক সকল বিষয়ের বিধিবিধান জানা ও তৎসংশ্লিষ্ট ইলম শেখা ফরজ। কিন্তু অত্যন্ত আফসোসের বিষয় হলো, বর্তমানে সাধারণ মাসআলা-মাসায়িল তো দূরে থাক, অধিকাংশ মানুষের তাওহিদ ও ইমানের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরও প্রাথমিক জ্ঞান নেই। অথচ ইসলামের নামে বিদআত ও কুসংস্কার পালনে তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকে সবচেয়ে বেশি। তারা অল্পতেই জান্নাত পেতে চায়, কষ্ট না করেই মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু না, অবশ্যই এর জন্য তাদের শ্রম দিতে হবে, সময় দিতে হবে এবং নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করতে হবে। নইলে কিয়ামত দিবসে ‘আমি তো অমুকের বয়ান শুনে কিংবা অমুকের কথা শুনে এমনটা করেছি’ বলে পার পাওয়া যাবে না। বস্তুত যাচাই-বাছাই না করে ভুল জায়গায় শ্রম দেওয়া বোকামি বৈ কিছু নয়।

বর্তমান সময়ে বিশুদ্ধ ইলম শেখা অধিক আমল করার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত তাওহিদ, ইমান, আকিদা, ফিতান, মালাহিম, কিতাল, মাগাজি, হিজরত ইত্যাদি-সংক্রান্ত ইলম শেখাটা অনেক অনেক বেশি জরুরি। পাশাপাশি তাহারাত, সালাত, সিয়াম ও সামর্থ্যবানদের জন্য হজ, জাকাতসহ অন্যান্য জরুরি ইবাদতের মাসায়িল তো রয়েছেই। এগুলো যদি আপনি শেখার চিন্তা না করে কেবল অমুক-তমুকের বয়ান-বিবৃতিকেই যথেষ্ট মনে করেন, তাহলে আপনার পদস্খলনের সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমানে সত্য বয়ান ও সঠিক বিধান খুব কম জায়গাতেই পাবেন। তাই আপনার যদি ইলম না থাকে বা ন্যূনতম যাচাইয়ের যোগ্যতা না থাকে, তাহলে বর্তমানের এ অন্ধকারাচ্ছন্ন ফিতনার জমানায় কুফর-শিরক ও গোমরাহির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবেন। কখন যে আপনার মূল্যবান ইমানটা হারিয়ে ফেলবেন, উপলব্ধিও করতে পারবেন না। তাই সঠিক সোর্স থেকে ইলম শেখার কোনো বিকল্প নেই।

শেষ জমানায় বক্তা হবে বেশি, আলিমের সংখ্যা থাকবে নিতান্তই কম। যারাও বা আলিম নামে পরিচিত, তাদের মধ্যেও প্রকৃত আলিম হবে হাতে-গোনা। এসংক্রান্ত একটি বিশুদ্ধ হাদিসে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন :

إِنَّكُمْ قَدْ أَصْبَحْتُمْ فِي زَمَانٍ كَثِيرٍ فُقَهَاؤُهُ، قَلِيلٍ خُطَبَاؤُهُ، كَثِيرٍ مُعْطُوهُ، قَلِيلٍ سُؤَّالُهُ، الْعَمَلُ فِيهِ خَيْرٌ مِنَ الْعِلْمِ، وَسَيَأْتِي زَمَانٌ قَلِيلٌ فُقَهَاؤُهُ، كَثِيرٌ خُطَبَاؤُهُ، كَثِيرٌ سُؤَّالُهُ، قَلِيلٌ مُعْطُوهُ، الْعِلْمُ فِيهِ خَيْرٌ مِنَ الْعَمَلِ

‘আজ তোমরা এমন এক সময়ে আছ, যখন ফকিহদের সংখ্যা বেশি, বক্তাদের সংখ্যা কম, উত্তরদাতা অনেক বেশি, প্রশ্নকারী কম। এ জমানায় ইলমের চাইতে আমলই উত্তম। সত্বরই এমন এক জমানা আসবে, যখন ফকিহদের সংখ্যা হবে অল্প, বক্তাদের সংখ্যা থাকবে বেশি, প্রশ্নকারী হবে প্রচুর, উত্তরদাতা হবে কম। সে সময় আমলের চাইতে ইলমই উত্তম হবে।’ (আল-মুজামুল কাবির, তাবারানি : ৩/১৯৭, হা. নং ৩১১১; জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাজলিহি : ১/১১৪, হা. নং ১০৩)

তাই নিজেকে বাঁচানোর জন্য হলেও ইলম শিখুন। কোথা থেকে শিখবেন, সেটা আলাদা করে বলে দেওয়ার কিছু নেই। দুনিয়ার অধিকাংশ ভালো-মন্দ যাচাই করার ক্ষমতা থাকলে এখানেও ভালো-মন্দ যাচাই করতে পারবেন। দরকার কেবল শেখার অদম্য হিম্মত, কষ্ট করার সুদৃঢ় মানসিকতা ও ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে অবিচলতা। আপনি আল্লাহর ওপর ভরসা করে শুরু করে দিন; রাস্তাগুলো অটোমেটিক খুলে যাবে। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষ হীনম্নন্যতায় ভোগে। ইলম শিখতে চাইলে আপনি যেমন শয়তানের কুমন্ত্রণা ও বাধা পাবেন, ঠিক তেমনই মানুষের পক্ষ থেকেও অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হবেন। মনে রাখবেন, বয়স ও অর্থের স্বল্পতা কখনো ইলম শেখার পথে অন্তরায় হতে পারে না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যাই বলুক না, আপনি আপনার ইপ্সিত লক্ষ্যে এগিয়ে যান। দেখবেন, সফল হলে তারাই প্রথম আপনাকে অভিনন্দন জানাবে, যারা একসময় আপনাকে ভর্ৎসনা করেছিল।


বর্তমানে অনলাইন-অফলাইনে অনেক বেশি বক্তা ও আলোচক দেখতে পাওয়া যায়, প্রকাশনীর জগতেও পাওয়া যায় অসংখ্য লেখকের দেখা। সন্দেহ নেই যে, এ আধিক্য কিয়ামতের একটি আলামত। ভালো-মন্দ সবার মিক্সে প্রচুর মানুষ বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে এবং ভুল পথে চলে যাচ্ছে। তাই নিজের ইলম না থাকলে এবং ভুল-শুদ্ধ যাচাই করার মতো যোগ্যতা না থাকলে বর্তমান সময়ে সঠিক ইলম পাওয়া বেশ দুরূহ ব্যাপার। তবে হ্যাঁ, যদি কারও ব্যাপারে ভালো করে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তিনি নির্ভরযোগ্য ও হকপন্থী আলিম, কারও ভয়ে তিনি সত্য লুকিয়ে রাখেন না এবং তার আমল ও তাকওয়ার ওপর আস্থা রাখা যায়, তাহলে তার থেকে ইলম নেওয়া ও শেখা নিরাপদ। তবুও উচিত হলো এমন একাধিক আলিমের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রাখা, যেন মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে সঠিকটা ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া যায়। আল্লাহ আমাদের সঠিক ইলম শিখে সে অনুসারে সকল প্রস্তুতি নেওয়ার তাওফিক দান করুন।


Tuesday, 31 March 2020 at 19:20