উনিশ শতকের শেষলগ্নে। উসমানীয় খিলাফতের একদম ভঙ্গুর অবস্থা। সেই সময় ফ্রান্স সরকার মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক নাটক মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করে। এমনকি ঐ নাটকের টিকেটও বিক্রি করা হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে উসমানী খিলাফতের সাহসী সুলতান আব্দুল হামিদ খাঁন আস সানি (রাহিমাহুল্লাহ) ফ্রান্স সরকার কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে ঐ ব্যঙ্গাত্মক নাটকটি বন্ধ করতে বলে বার্তা পাঠান।
উত্তরে ফ্রান্স সুলতানকে তাদের দেশের মত প্রকাশ করার স্বাধীনতার কথা বলে নাটকটি মঞ্চস্থ করবেই এই কথা বলে। এর উত্তরে মুসলিম জাহানের খলিফা আব্দুল হামিদ ফ্রান্স সরকার কে জানিয়ে দিলেন– “তোমরা যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে ঐ ব্যঙ্গাত্মক নাটকটি মঞ্চস্থ করো তাহলে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষনা দিব। আমরা তোমাদের দুনিয়াকে বরবাদ করে দিব।” খলিফার এ কথা শুনে ফ্রান্স সরকার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক নাটকটি আর মঞ্চস্থ করার সাহস পায় নি।
আর আজকে খিলাফত বিলুপ্ত হবার পর প্রায় ১০০ বছর হতে চললো। এর ভিতরে পশ্চিমা বিশ্বে কতবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, কত অশ্লীল কার্টুন আকা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিমুহূর্তে মত প্রকাশ করার স্বাধীনতার নামে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে অপমান করছে।
আজকে বছরের পর বছর ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, উইঘুরে, চেচনিয়ায় মুসলমানদের উপর এত নির্যাতন হচ্ছে, প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় সেই সব এলাকার মুসলিম মেয়েরা কাফিরদের হাতে ধর্ষিত হচ্ছে, কই মুসলিম দেশের এত লাখ লাখ সেনাবাহিনীর কেউ কি যেয়ে সেই সব এলাকার নির্যাতিত মুসলমানদের কে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে?
কিন্তু খিলাফতের সময়ের কথা চিন্তা করুন। খুলাফায়ে রাশেদারের সময় শাম বিজয় হয়েছে, ইরাক বিজয় হয়েছে, আফ্রিকার আকাশে কালেমার পতাকা উড়েছে। উমাইয়া খিলাফতের সময়ে একদিকে তুর্কিস্তানে, অন্যদিকে স্পেনে অভিযান চলছে। এমন সময়ে সিন্ধু প্রদেশে সিন্ধু রাজা দাহির কর্তৃক একদল মুসলমান বন্দি হয়েছিল, ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া এক মুসলিম নারীর নিজ রক্তে লেখা একটি চিঠি ইরাকের গভর্নর জালিম হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পৌঁছায়। ক্ষুব্ধ হয়ে হাজ্জাজ ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিম কে একটি বাহিনী দিয়ে পাঠিয়ে দেন হিন্দুস্তানে। মুহাম্মদ বিন কাসিম অল্পকয়েকদিনেই পুরো সিন্ধু পদদলিত করে। একই সময়ে বিজয় হয় মুসা আর তারিকের নেতৃত্বে স্পেন। কুতাইবা বিন মুসলিমের নেতৃত্বে দখল হয় সমগ্র তুর্কিস্তান।
আব্বাসী খিলাফতের সময় এক মুসলিম নারী আম্মুরিয়ায় বন্দী হয়। সে খলিফা মুতাসিমকে চিৎকার করে ডাকছিলো “ইয়া মুতাসিমা, ইয়া মুতাসিমা- ওহে মুতাসিম, ওহে মুতাসিম”। এক রোমান সৈন্য তাকে নিয়ে বিদ্রুপ করছিল, তোমার মুতাসিম কোথা থেকে আসবে? খলিফা মুতাসিম বিল্লাহর কাছে খবর এসে পড়ে। ক্ষুব্ধ খলিফা সিংহাসন ছেড়ে শুভ্রঅশ্বে আরোহন করেন। রণ দামামা বাজিয়ে খলিফা বিশাল এক বাহিনী নিয়ে আম্মুরীয়ার দিকে অগ্রসর হন। রোমানদের থেকে সেই মুসলিম নারীকে উদ্ধার করা হয়। রোমান সৈন্যরা পালিয়ে গেলে পুরো আম্মুরীয়া নগরীকেই খলিফা ধূলিসাৎ করে দেন। আল্লাহু আকবার!
সেলজুক সুলতান আল্প আরসালানের সময় মুসলিম বিশ্বের সীমানা গিয়ে পড়েছিল বাইজান্টিয়াম সাম্রাজ্যের রাজধানী কস্তনতুনীয়ার প্রাচীর পর্যন্ত। এর পূর্ণতা ঘটে উসমানীয় সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহর কস্তনতুনীয়া বিজয়ের মধ্য দিয়ে। তাঁর উত্তরসূরী ইয়ার্ভূজ সেলিম, কানুনী সুলতান সুলেইমান বিজয় করেছিলেন ইউরোপের অর্ধভাগ। তার জানিসারী বাহিনীর অশ্বখুরের শব্দে কেঁপে উঠতো তিন মহাদেশ আর সাত সমুদ্র।
খিলাফতের সময় বাগদাদ হয়েছিল প্রাচ্যের রাজধানী আর সবখান থেকে ছুটে আসা জ্ঞানপিপাসুদের গন্তব্য। সেই সময়ে কর্ডোভা ছিল পাশ্চাত্যের রাজধানী আর সবার জন্য ছিল পশ্চিমা সভ্যতা ও জ্ঞানের কেন্দ্রস্থল।
আল-মাদিনাতুল মুকাদ্দাস ততদিন নিরাপদ ছিল যতদিন খিলাফত নিরাপদ ছিল। এর মধ্যে হুমকির মুখেও পড়েছে কিন্তু উদিত হয়েছিলেন ইমাদুদ্দিন, নুরুদ্দিন আর সালাহুদ্দিনরা। তারা তাদের সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন ক্রুসেডারদের থেকে মুকাদ্দাস ভূমি উদ্ধারে। তারা পরিচয় দিয়েছেন তাদের খোদাভীরুতা ও আল-ওয়ালা ওয়াল বারা-এর। শত অক্ষমতা বাধা-বিপত্তির মাঝেও খলিফারা আগলে রেখেছিলেন আরজে মুকাদ্দাসাকে।
খিলাফত ব্যবস্থা মুসলিমদের দিয়েছে বিজয় ও গৌরব, মর্যাদা। একের পর এক ভূখণ্ড বিজয় করেছে। জিহাদের মাধ্যমে কাফিরদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। আমাদেরকে কালেমার ছায়াতলে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে। এই খিলাফতের সময় একজন মুসলিম নারীর জন্য গোটা নগরীকেই ধূলিসাৎ করে দেয়ার অসংখ্য নজির আছে। আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত-আব্রু নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। খিলাফত দিয়েছে মুসলিমদের জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা। যেখানে জিম্মি কাফিরও পেতো ন্যায়বিচার।
কিন্তু যেদিন থেকে শেষ মুসলিম খিলাফত দেভলেত ই উসমানীয়্যাহর পতন ঘটলো, এক উম্মাহ ও এক দেহকে ৫৭টি ভাগে বিভক্ত করা হলো সেদিন থেকে শুরু হলো মুসলিম মিল্লাতের পরাজয়, লাঞ্চনা ও অপদস্ততার এক নতুন অধ্যায়। কোথাও পায়না কোন আশ্রয়।
১৯২৪ সালের ৩ মার্চে আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল পাশা আনুষ্ঠানিকভাবে খিলাফতকে উচ্ছেদ করে দেয়। মুসলিম বিশ্ব হয়ে পড়ে অভিভাবকহারা। এর মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও ভাতৃত্ব, বীরত্ব ও গৌরবের স্বাক্ষী হয়ে নামেমাত্র যে খিলাফত টিকে ছিলো তার কফিনে শেষ পেরেকটি ঢুকিয়ে দেয়া হল। খিলাফাহ!
যা তাদের আতঙ্কিত করে রাখতো, ঘুমন্ত বা জাগ্রত কোন অবস্থাতেই তাদের পিছু ছাড়তনা, যা তাদের ঘুম কেঁড়ে নিয়েছিল আর তাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছিল।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পর থেকে ইতিহাসে এ প্রথমবার মুসলিম জাতি খিলাফত বিহীন দীর্ঘ প্রায় একশো বছর পার করছে। খলিফা ছিল মুসলিমদের ছাঁদের মতো, সেই ছাঁদবিহীন উম্মাহ ইয়াতিমের মতো শতবছর যাবৎ জিল্লতীর জীবন অতিবাহিত করছে। যুগের পর যুগ কুফফারদের গোলামী ও তাবেদারীর মধ্য দিয়ে জাতি নিজের আজাদী খুঁজে ফিরছে। যদিও তা অধরায় রয়ে গেছে।