শিশুরা আসলেই কাঁদা-মাটির মতো। যেভাবে গড়ে তুলবো তেমন করেই গড়ে উঠে। তবে ব্যাতিক্রম যে নেই তাও নয়। যাই হোক, আপনার কোমল শিশুর অপরাধে কিভাবে শাসন করছেন? তার ভুলগুলি কিভাবে তাকে ধরিয়ে দিচ্ছেন? ব্যাপারটি কিন্তু সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি হয়তো ভাবছেন এখন যদি বড় ধরনের একটা ধমক না দেই বা এখুনি খুব করে একটা মাইর না দেই তবে আর শেখানোই সম্ভব হবে না। হয়তোবা ভাবছেন আমার বাব-দাদারাই সঠিক কাজটি করেছিলো। একটা ভুল হলেই কষে এক থাপ্পর। কিংবা ভাবছেন, বাঙ্গালী – মাইরের উপর ঔষধ নাই। কিন্তু আপনার শিশুর বড় একটা ভুলেও আপনি একটু শান্ত থেকে, একটু চালাকি করে, কম ক্যালরী খরচ করে তাকে ভালো শিক্ষা দিতে পারবেন। এবং সেই শিক্ষাটা দিতে হলে যে তাকে ভয় পেতেই হবে তেমন কোন কথা নেই। বরং আপনারই লাভ হবে তাকে যদি সঠিক শিক্ষাটা দিতে পারেন নির্ভয়ের সাথে।
ধরে নিলাম সুনাতা কাঁচের একটা শোপিস্ ভেংগে ফেললো (যা বর্তমান বাজারে খুবি দামী)। সাথে সাথে হুংকার, চিৎকার, আর গালে কষে থাপ্পর – এমনটিই হয়তো অনেকেই করে থাকি, তাই না? খবরদার এটি একদমই করবেন না, একদম করবেন না। মনে রাখবেন, সে এই পৃথিবীতে নতুন। সে জানেই না কোনটি দামি, কোনটি দরকারি, কোনটি অপ্রয়োজনীয়, কোনটি খেলনা, কোনটি বিপদের… সে এটাও জানে না কোনটি পড়ে গেলে ভেংগে যায় আর কোনটি ভেংগে যায় না। শতশত খেলনা পড়ে গিয়েছিলো আমরা বকা দেইনি কিন্তু একটি কাঁচের জিনিষ ভেঙ্গে যাওয়ায় যখন বকা দেই, সে নতুন করে কিছু একটা শেখে। সে তার মতো করে বুঝতে চেষ্টা করে কেন আব্বু/আম্মু চিৎকার দিলো, কেন থাপ্পর দিলো, কেন মাইর দিলো, ইত্যাদি… মনে রাখবেন সে কিন্তু নিজে নিজে ভুল কিছু শিখে ফেলতেও পারে। আর তা যদি করে সেটা হবে আরেকটা বড় ক্ষতি আপনার শিশুর জন্য, আপনার জন্যও।
কিন্তু এই শিশুটিই একদিন বড় হবে। আর আমরা হবো বুড়ো। আমরা বুড়ো হলে অনেকটাই শিশুর মতোই অবুঝ হয়ে যাবো। হয়তো তখন আমরাও শিশুর মতো কিছু কাজ করে ফেলবো। তখন কি আমরা আশা করবো আমার সন্তান এসে আমার প্রতি এভাবে চিৎকার করুক, হুংকার দিক…
যাই হোক, যদি আপনার শিশু কাঁচের জিনিষ ভেংগে ফেলেই, তবে তার কাছে আসুন, পরিস্থিতি বুঝুন এবং তাকে নির্ভয় দিন। তাকে নড়তে নিষেধ করুন। সবার আগে তাকে বলুন “তুমি কি ব্যাথা পেয়েছো মামনি?”। সে না বললেও আপনি নিঝে বুঝুন যে তার কোথাও কেটে গেছে কিনা। যখন এই কাজগুলি করবেন তখন মুখে উচ্চারণ করে বলুন “দেখিতো কোথাও কেটে গিয়েছি কিনা? তুমি কি পায়ে ব্যথা পেয়েছো নাকি হাঁটুতে?…” (কথাগুলি তার কানে ঢুকা দরকার যে আপনি তার নিরাপত্তার কথা আগে চিন্তা করেছেন। এবং এটাও তার বোঝা দরকার আপনি তাকে কিভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। খেয়াল করে দেখুন, যদি এভাবে আচরণ করেন তবে আপনি কিন্তু অলরেডি তাকে একজন ভালো মানুষ হবার শিক্ষা দিচ্ছেন!)
এবার তাকে নিরাপদ দুরত্বে রেখে তাকে ঠান্ডা করে ভাংগা কাঁচ পরিষ্কার করার কাজে লাগুন। অনেকেই এই সময়টায় বাচ্চাকে অন্য ঘরে নিয়ে যায় ও কাজের বুয়া (Servant) দ্বারা পরিষ্কার করায়। সংগত কারনেই বুয়ার কাজ আমাদের অনেক সময়ই পছন্দ হয় না আর তখন তাকে ধমক দিয়ে বলে থাকি “এমন করে কেউ ছাড়ু দেয়? ঐ তল দিয়ে ছাড়ু দাও, ঐ যে ভাংগা কাঁচ পড়ে আছে, সেটাকে সরাও, এটাকে সরাও, চোখে দেখো না তুমি,” ইত্যাদি। দয়া করে এমনটি না করে, বাচ্চাকে একটু দুরে নিরাপদে রেখে সম্ভব হলে আপনি নিজে কাজটি করুন। আপনার বাচ্চাকে দেখতে দিন কিভাবে আপনি ভাংগা কাঁচ সংগ্রহ করছেন। তাকে দেখতে দিন কেমন করে আপনি সেগুলি ধরছেন। এই কাজগুলি করার সময় এভাবে মুখে উচ্চারন করে বলুন, “দেখিতো টেবিলের তলে আছে কিনা? সোফার তলে আছে কিনা? এই কাঁচটা একটু বড়, সাবধানে ধরি। এই যে এখানে অনেক ছোট ছোট ভাংগা কাঁচ, এগুলিকে আরো বেশি সাবধানে সরাতে হবে। বিছানার তলে কাঁচের টুকরা চলে গিয়ে থাকতে পারে…” ইত্যাদি। এগুলি তার জন্য শিক্ষা। মনে রাখবেন আপনি নিজে বারে বারে কাঁচ ভেংগে তাকে শেখাতে পারবেন না বা শেখাবেনও না। বরং বাস্তবে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার দ্বারা আপনি সহজেই তাকে শেখাতে পারবেন জীবনের এমন নানা কিছু। (আমি শুধু ভাংগা কাঁচের উদাহরন দিলাম।)
বুয়াকে দিয়ে না করার পরামর্শটা কেন দিলাম সেটাও বলি। ঐ যে বললাম, অনেক সময়ই ওদের কাজ আমাদের পছন্দ হয় না আর হয়তো ধমক দিয়ে বলবো, এভাবে ছাড়ু দাও, ওভাবে ছাড়ু দাও… আপনি যদি এমনটি করেন তবে আপনার শিশু শিখবে যে, একজনের অপরাধে আরেকজনকে ধমকানো যায় বেশ আচ্ছা মতোই।
যাই হোক, কাঁচ পরিষ্কার করার পুরো ঘটনাটি তাকে দেখতে দিন। এভাবে সে খুব অল্প বয়সেই শিখে যাবে পুরো কাজটি। কাজ শেষে তাকে কোলে নিয়ে তাকে আবার দেখুন। তাকে প্রশ্ন করুন যে, সে ভয় পেয়েছে কিনা, নির্ভয় দিন। এবার তাকে আপনার ছোট বেলার গল্প বলুন যেখানে কাঁচ ভেংগে গিয়েছিলো। “আমি দুষ্টমি করে গ্লাস্ ভেংগে ফেলেছিলাম। ভেংগে গেলে বোকার মতো লুকাতে গিয়েছি আর অমনি পা কেটে গিয়েছিলো। অনেক ব্যথা পেয়েছিলাম আম্মু। আমি হাঁটতে পারিনি, খেলা করতে পারিনি কিছুদিন। ধিরে ধিরে ঠিক হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু কষ্টও পেয়েছি অনেক।…”
যাই হোক, আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছেন আমার বক্তব্য। আমি আমার বাচ্চার সাথে এমনটিই করে আসছি ঠিক যখন ওদের বয়স দেড় কি দুই বছর তখন থেকেই এবং মারাত্নক করমের উপকারও পাচ্ছি। মনে মনে হয়তো বলছেন, শিবলী ভাই এইটুকু বাচ্চা আবার কি উপকার করবে। :)
কি উপকার পাচ্ছি?
আমি যখনই কোন বিপদজনক কাজ করতে যাই ওরা সব সময় বলে, “বাপু, সবাধানে কাজ শুরু করো।” এভাবেও বলে, “বাপু তুমি কি সাবধানে কাজ করছো?” আবার কাজটি করতে গিয়ে যেন দূর্ঘটনা না ঘটে সেটার জন্য দুয়াও করে অগ্রিম। শুধু তাই নয়, ভুল করে আমার কিছু হয়ে গেলে ওরা অযথা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে যেটা করা দরকার সেই কাজটাই করে। :)
আল্লাহ্ আমাদের সকল শিশুকে সুন্দর রাখুক এবং বড় হবার সাথে সাথে সুন্দর করেই বড় করুক।
সেপ্টেম্বর 10, 2009
Additional Comment By: Kamal Ahmed Liton
শিশুকে নির্মম শাসন কখনোই করা যাবে না…। শিশুকে শাসন করার প্রক্রিয়া আলাদা…! শাসন মানেই প্রহার নয়, নয় চিতকার-চেঁচামেচি করা….।
“তুমি যদি এমন কর, তাহলে তোমার সাথে আব্বু আর কথা-ই বলবো না” কিংবা – “তুমি যদি এমন কর, তাহলে আব্বু দূরে চলে যাবো, তখন আব্বু কোথায় পাবে, বল..!!??” – কোন অপরাধের কারণে ক্ষণিক সময়ের জন্য এরূপ ঘোষণা দিয়ে শিশুর সাথে কথা বলা বা তার সাথে খেলায় অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকলে খুব ভাল কাজ হয়- এটা আমি দেখেছি। “… তাহলে আব্বু কিন্তু অনেক রাগ করবো….!”- কপট অভিমান জড়িয়ে এরকম অভিনয় করলেও শিশু তার জেদ বা রাগ বা ধ্বংসাত্বক কোন কাজ হতে বরং ফিরে আসে, তবু আব্বুর রাগ/অভিমান সে বরদাশত করে না…!
তাছাড়া শিশুকে ধমক যদি দিতেই হয়ে, তবে “আ-ব – বু- উ” কিংবা “মা-ম-ণি-ই” শব্দটাই বলেন, স্বরটা একটু উচ্চ করে আর কি…. অনেক ক্ষেত্রে ওটুকুই যথেষ্ট হয়ে যায়….!!
মনে রাখতে হবে, শিশুরা দুষ্টুমি করবেই, অবুঝ হবেই, ভুল করবেই, কিছুটা জ্বালাতন করবেই…। আরও মনে রাখতে হবে- আপনি যখন তার বয়সী ছিলেন আপনি নিশ্চিতভাবেই ওর মতো কিংবা হয়তো তার চেয়ে বেশী চঞ্চল/দুষ্টু ছিলেন। আর আপনার বর্তমান বয়সে যখন ও আসবে তখন নিশ্চিতভাবেই আপনার এখনকার মতোই বুঝতে শিখবে….!!! আপনি তার বাবা-মা/অভিভাবক হয়েছেন বলেই তাকে অমানবিক শাস্তি প্রদানে আপনার কোন অধিকার নেই।
শিশুরা আপনার ঘরে মহান আল্লাহ তায়ালার আমানত, আপনার নিজস্ব কোন সম্পত্তি নয়। যাদের ঘরে শিশু নেই- তারা বুঝে—- বেহেশতের কী নেয়ামত হতে তারা বঞ্চিত !! আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন- “…আমার যাকে ইচ্ছা ছেলে সন্তান দান করি, যাকে ইচ্ছা মেয়ে সন্তান দান করি, যাকে ইচ্ছা উভয়টাই দিই, আর যাকে ইচ্ছা কোনটাই দিই না।” (দুঃখিত, এই মুহূর্তে সূরা-আয়াত নং মনে করতে পারছি না)।