ইতিহাসের ক্ষেত্রে ঘটনার গভীরতা ও পারিপার্শ্বিকতা চিন্তা করা। ইতিহাস কেবল ধারাবিবরণী না। ইতিহাসে লুক্কায়িত আছে সুন্নাতুল্লাহ বা 'বান্দাদের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত রীতি।' সেটা বের করা গেলেই ইতিহাসের অর্থ বেরিয়ে আসে। [1]
মনের দরোজা জানালা খুলে নিয়ে পড়তে হবে। দুনিয়ার কোনোকিছুই সরল রেখায় চলে না। একেকটা জিনিসের পিছনে বহু ফ্যাক্টর কাজ করে। এরপরও আমরা সবকিছুকেই কমন ফর্মুলায় ফেলি। সেই ফর্মুলাটা ফলো করি বা এভোয়েড করি। এটাই আল্লাহর রীতি ধরে নিই। আর দুআ করি, যাতে আল্লাহ নেপথ্যে ক্রিয়াশীল তাঁর যত রীতি আছে সবগুলোর মাঝে ফাইন টিউনিঙ করে আমার উদ্দেশ্যটা পুরো করে দেন। মোটাদাগে একটা সরলীকৃত ফরমেট আমরা বের করতে চাই নিজেদের অনুসরণের জন্য। এবারও আমরা সেটাই করব। মানবমন ও সমাজের একদম সাধারণ আদিম সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে কিছু কথা বলব।
মানুষ তার পরিবেশ দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়। (১) ভীষণভাবে। এটা কারও সত্যায়নের দরকার নেই। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাই এজন্য যথেষ্ট। এমনকি বাকি সব ফ্যাক্টর অপরিবর্তিত থাকলে (সেটেরিস পেরিবাস) কেবল পরিবেশ একজন লোককে ১৮০ ডিগ্রী বদলে দিতে পারে।
খালদূন বলছেন—প্রথম প্রজন্মের মাঝে ধর্মবোধ প্রবল থাকে। আসাবিয়্যা তত্ত্বটা আমরা ব্যক্তি লেভেলে খাটাবো। প্রতি পরবর্তী প্রজন্ম ভোগবিলাসের দিকে ঝুঁকতে থাকে, ধর্মীয় উপাদান কমতে থাকে, দুনিয়ামুখীতা বাড়তে থাকে। তার মানে প্রথম পুরুষ যতই ধার্মিক ও গোত্রপ্রীতি (ধরে নিচ্ছি ধর্মপ্রীতি/মুসলিমপ্রীতি) ওয়ালা হোক,পরের দুই-তিন পুরুষে তার জায়গা নিয়ে নেয় ধর্মহীনতা ও অসাম্প্রদায়িকতা (নিজ ধর্মের লোকের সাথে দূরত্ব ও পরধর্মের লোকেদের সাহচর্যপ্রিয়তা)। এটা বাড়তেই থাকে প্রজন্মে প্রজন্মে (২) যদি না আল্লাহ অন্য কোনো ফাইন টিউনিঙ করেন।
পশ্চিমা সমাজটাকে বুঝবো আমরা এখন। এখন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমরা সমাজ সংগ্রামে লিপ্ত পশ্চিমা সভ্যতার বিরুদ্ধে। টিভিতে দেখছেন ইউরোপ আমেরিকার বেহেশত, হুর, সুখ, আয়েশ। আবার হুজুর নামক একটা শ্রেণী ওয়াজে বলছে টিভি হারাম, শয়তানের বাকসো। আবার টিভিতেই আরেক হুজুরের প্রোগ্রাম হয়, সেটাও না দেখলে চলছে না। একটা দ্বন্দ্ব। নিজের মধ্যে, সমাজের মধ্যে। না পারছেন পুরো পশ্চিমী হতে, না পারছেন পুরো পশ্চিম ডিনাই করতে। সবখানে একটা দ্বন্দ্ব। ঠিক এই দ্বন্দ্বটাই ইউরোপ-আমেরিকা শেষ করে এসেছে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে। এখন বাংলাদেশে নারীদের যে অবস্থা, সেটা ইউরোপ আমেরিকা ৫০-৬০ এর দশকে শেষ করে এসেছে। ইউরোপ সংলগ্ন মুসলিম দেশগুলো তারপর। আমাদের দেশে নব্বইয়ের দশকের দিকে। এখন সেটা সৌদিতে। এখন পশ্চিম যে অবস্থানে আছে, আমরা সেখানে পৌঁছবো ২০৪০-৫০ এর দিকে (সেটেরিস পেরিবাস)। উপমহাদেশে দেওবন্দী ও সৌদিতে সালাফী আন্দোলন না থাকলে আমরা আরও ২০ বছর আগেই ভেসে যেতাম স্রোতে। যেমন গেছে মিসর, তিউনিসিয়া, সিরিয়া, লেবানন, সিরিয়া আমাদের বহু আগেই।
একটা উদাহরণ দিলে সহজ হবে। প্রফেসর জেফ্রি লাঙের আত্মসমর্পণের দ্বন্দ্ব বইটা আমাকে খুব সাহায্য করেছে পশ্চিমা সমাজকে বুঝতে। বইটা আমি সবাইকে পড়তে নিষেধ করব, কেন তা পরে আসছি। একটা ইসলামিক সেমিনারের ঘটনা উল্লেখ করেন উনি। একজন মুসলিম বোন উপস্থিত গেস্ট আলিমকে জিজ্ঞেস করেন: "আচ্ছা শায়খ, এই যে আপনারা নারী-পুরুষ আলাদা করে বসিয়েছেন, এটার দ্বারা আমরা অফেন্ডেড ফীল করছি। আপনার কি মনে হয়না, একসাথে মিশিয়ে বসার সুযোগ দিলে আমরা মেয়েরা আরও ভালো শুনতে পারতাম?" শায়খ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পরের প্রশ্নে চলে যান। আমাদের সমাজের সাথে মেলান এবার। আমাদের সমাজে মেয়েরা এখনও আলাদা বসতেই কমফোর্ট ফিল করে। এটা ঐ বোনের দ্বীনি জ্ঞানের কমতি যতটা না, তার চেয়ে বেশি আমেরিকার সমাজ বাস্তবতা। সমাজমানসে নারী-পুরুষ সমতা, ফ্রী-মিক্সিং এতটাই নির্দোষ এতোটাই স্বাভাবিক, এতোটাই। যে, আলাদা বসতেই তারা আনইজি ফিল করছে। এটা আমেরিকার সমাজ। এটা আমাদের মতো না। ইসলামের যে বিষয়গুলোতে আমাদের এখানে, বা অন্য মুসলিম সমাজে প্রশ্ন উঠবে না, ওখানে সেগুলোতেও মুসলিমদের মধ্য থেকেই প্রশ্ন ওঠে। কারণটা কী?
ইসলাম ব্যক্তিপর্যায়ে সীমাবদ্ধ ধর্ম নয়। ব্যক্তির নিজস্ব আধ্যাত্মিকতা-সর্বস্ব ধর্ম না। যেমনটা খৃষ্টধর্ম। খৃষ্টবাদের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ আকীদা হল: ঈসা আ. কে আল্লাহর একমাত্র ঔরসজাত (begotten) পুত্র বলে মেনে নেয়া এবং এটা মেনে নেয়া যে তিনি আমাদের পাপমোচনের জন্য ক্রুশে আত্মাহুতি দিয়েছেন। এরপর আপনি কী করলেন না করলেন, তা আর গুরুত্বপূর্ণ না। এরপর আপনি চাইলে গে হন, চাইলে ঈসায়ী মুসলমানও থাকতে পারেন। যা ইচ্ছে করতে পারেন, আপনাকে ঈসা জাহাজে করে বেহেশতে নিবেন। এজন্য দেখেন খৃষ্টান মিশনারীরা কোণায় কোণায় গিয়ে উপজাতিদের খৃষ্টান বানিয়েছে। ডন রিচার্ডসনের 'ইটারনিটি ইন দেয়ার হার্টস' বইয়ে দেখবেন, পাদ্রীরা গিয়ে সাঁওতালদের বলছে, আমরা তোমাদের 'ঠাকুর জিউ'-এর লোক। বিশ্বাস বদলে দিয়ে আচার পার্বণ, ব্যস। বিপরীতে ইসলামের প্রচারটা ভিন্ন। দেখেন, সাহাবীরা যুদ্ধ করেন, দেশ জয় করেন, এরপর ইসলাম প্রচার করেন। মুসলিম খলিফার জন্য বছরে একবার বা দুবার ফৌজ পাঠিয়ে ইকদামী জিহাদ ফরজ। জয় করে প্রচার। কেননা ইসলাম শুধু বিশ্বাস না। যখন আপনি কাউকে ইসলাম শেখাচ্ছেন, আপনি প্রথমত তাকে
- আধ্যাত্মিকতা শেখাচ্ছেন
- এরপর আত্মশৃঙ্খলা
- এরপর শেখাচ্ছেন সমাজজীবন (আচার-পার্বণ সমাজজীবনের অংশ)
- এরপর অর্থব্যবস্থা
- রাষ্ট্রনীতি
- যুদ্ধনীতি
- আইন বিচার
ভূমি জয় না করে নতুন একটা সমাজ, নতুন একটা বাজার-অর্থনীতি, নতুন একটা রাষ্ট্রচিন্তা আপনি কখনোই প্র্যাকটিক্যাল দেখাতে পারেন না। কেউ পারেনি, সমাজতন্ত্র না, গণতন্ত্র না, কেউ না। যখন সামনে ব্যবহারিক একটা কাঠামো থাকবেনা, তখন জন্ম নেবে প্রশ্ন। যেমন এখন। হদ নিয়ে প্রশ্ন, পর্দা নিয়ে, মুরতাদের শাস্তি নিয়ে, জিযিয়া নিয়ে। কারণ, সামনে কোনো উদাহরণ নেই। রাষ্ট্র ও আইন নেই সামনে, তাই মুসলিম অধ্যুষিত দেশেও প্রশ্ন উঠছে। এখানে আপাত একটা সমাজ আছে, তাই সমাজ নিয়ে কিছু উত্তর এখনও অবশিষ্ট আছে। এখন যেখানে মুসলিম সমাজ নেই (পশ্চিম), শিক্ষা দিয়ে ধুমসে ঢুকছে তাদের সমাজের বিষ, সেখানে স্বাভাবিকভাবে ইসলাম নিয়ে মুসলিমদের আরও প্রশ্ন থাকবে।
তাদের রাষ্ট্রচিন্তা আমাদের রাষ্ট্রচিন্তা আলাদা, সাংঘর্ষিক। তাদের সমাজচিন্তা, আমাদের সমাজচিন্তা আলাদা এবং সাংঘর্ষিক। ইসলাম একটা টোটালিটি, হোলিস্টিক সিস্টেম। যখন আপনি ইসলামের রাষ্ট্রচিন্তাকে কম্প্রোমাইয করলেন, তো সমাজবিধানের কিছুটাও আপনাকে ছাড় দিতে হবে। এরপর তা এসে পড়বে পরিবারের উপর, পারিবারিক ইসলামেও ছাড় দিতে হবে আপনাকে। এরপর ব্যক্তিগত আচারেও আপনাকে ছাড় দিতে হবে। প্রতিটি ছাড় আপনাকে আরও ছাড় দিতে বাধ্য করে। কীভাবে পশ্চিমা রাষ্ট্রচিন্তা তাদের সমাজচিন্তাকে চাপিয়ে দিয়ে মুসলিমের ব্যক্তিক ইসলামকে নষ্ট করে, তার কিছু উদাহরণ দেখুন:
ক. ছেলেকে LGBT ক্লাস করতে না দেয়ায় বৃটেনে মুসলিম পিতাকে জেল। কয়দিন দিবে জরিমানা এই বাবা। থাকতে তো হবে (?) সেখানেই। (Dad who refuses to send son to school over LGBT lessons is facing jail)
খ. নিকাব নিষিদ্ধ করে দেশে দেশে আইন পাশ ও জরিমানার বিধান। (Which countries have a 'burqa ban'?)
জরিমানা গুণতে হবে (Denmark veil ban: First woman charged for wearing niqab)
গ. জার্মান কোর্ট হেডস্কার্ফ পরতেও বারণ করেছে। (Berlin court bars Muslim teacher from wearing headscarf)
ঘ. ইনসিওরেন্স ইত্যাদি সুদী ব্যবস্থার আওতায় সব নাগরিককে আসতে হয়। (কেটে নেয়া টাকা ব্যালেন্স করতে অনেক আলিম জমাকৃত টাকার সুদ গ্রহণকে জায়েজও বলে থাকেন সেখানে)
সেখানে রাষ্ট্রব্যবস্থায় সমাজব্যবস্থায় অর্থব্যবস্থায় একথা বলার কোনো সুযোগই নেই যে, আমি ইসলাম পালন করছি। শুধু নামায পড়তে পারার নামই কি ইসলাম? কোনো না কোনোভাবে আপনি হাজারো কবীরা গুনাহে লিপ্ত হচ্ছেন। কিংবা আপনি এমন ইসলামকে 'ভালোভাবে মানছেন', যে ইসলামের সাথে নবী-সাহাবা ও সালাফগণের কোনো সম্পর্ক নেই, এক রিফাইনড ও রিডিফাইন্ড ইসলাম আপনি ভালোভাবে মানার দাবি করছেন। কাফির সমাজব্যবস্থায় টিকে থাকার মাকাসিদকে সামনে নিয়ে কুরআন-হাদিসের স্পষ্ট বিধানকে ইনিয়ে বিনিয়ে সাইড করে এক আশ্চর্য ইসলাম আপনি পালন করছেন। আর আত্মতৃপ্তিতে ভুগছেন। আজ আপনি যে পরিমার্জিত 'গুড' ইসলাম মানছেন, আপনার সন্তান সেটুকুও মানবে না, নাতি আরও ছেড়ে দেবে। আমাদের আগের (১) ও (২) নং থেকে দেখুন, এই প্রভাব ২/৩ প্রজন্ম পর হয় পুরো বিশ্বাসকেন্দ্রিক মুসলিম (নামায না পড়লেও ঈমান ঠিক আছে টাইপ) কিংবা মুরতাদে (এ যুগে এদেশে ইসলাম মানা সম্ভব না) (যে ভাববে ইসলাম পুরনো মডেল, আধুনিক রাষ্ট্র মডেলের সাথে ইসলাম যায় না) পরিণত করবে আপনার বংশধরদের। এর পিছনে কী আপনার কোনো দায় নেই? আজ কাফির রাষ্ট্রে আপনি সেটেল হবার যে সিদ্ধান্তটা নিলেন, সেই সিদ্ধান্তের কোনো দায় নেই আপনার প্রজন্ম মুরতাদ হবার পিছনে?
সংখ্যাগরিষ্ঠ আলিম কাফের অধ্যুষিত দেশে সেটেল হবার বিপক্ষে মত দিয়েছেন। ব্যবসা বা শিক্ষার জন্য যাওয়া যাবে, তবে স্থায়ীভাবে থাকা যাবে না। হানাফী মাযহাবে সবচেয়ে বেশি ছাড় দেয়া হয়েছে। ফতোয়াগুলো লক্ষ্য করবেন, এর চেয়ে বেশি লক্ষ্য করবেন ফতোয়া চাইবার ভাষাটা। মুসলিম দেশে তিনি ইসলাম পালন করতে পারছেন না, বরং কাফির রাষ্ট্রে তিনি নিরাপত্তার সাথে ইসলাম পালন করতে পারছেন। মানে কী এগুলোর? কোন সে ইসলাম যা তিনি মুসলিমদের মাঝে পালন করতে পারছেন না। সেই ইসলাম পালন করতে তাঁকে কাফিররাই বেশি সহায়তা করছে। অনেকে বলবেন, মুসলিমদের দেশগুলোতে যুদ্ধ চলছে, জানমালের নিরাপত্তা নেই, বরং কাফিরদের দেশে স্থিতিশীলতা আছে, রাষ্ট্র কাঠামো সুসংহত।
এবার আসেন, দেখি। একটা বই দেখলাম, নাম ডেসটিনি ডিজরাপ্টেড। মুসলিম উম্মাহর নিয়তি নিয়ে আমেরিকায় বসে চিন্তিত আমেরিকা-প্রবাসী লেখক। যেখানে তাঁর নিজের দেশে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত যুদ্ধ চলছে। একজন ঈমানী গায়রতওয়ালা মুসলিমের কী করণীয় ছিল, যে আসলেই উম্মাহর নিয়তি নিয়ে চিন্তিত? লেখক আমেরিকা-প্রবাসী আফগান। আফসোসের বিষয় হল, এই লেখকের বই আবার ইসলামপন্থীরাই অনুবাদ করে প্রচার করছে সোকল্ড 'দরদ'। এরকম লক্ষ লক্ষ মুসলিম আপনি পাবেন, যারা নিজ দেশে কাফিরদের হাতে নির্যাতিত মুসলিমদের রেখে, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার এস্টাবলিশড মেহনতকে রেখে সেই কাফিরদেরই সিটিজেন হয়ে 'আল্লাহ মালুম' কোন সে ইসলাম পালনের দাবি করছেন।
মাঝে কিছু ছবি দেখলাম। গ্রীক সীমান্ত থেকে সিরীয় যুবকদের খেদিয়ে দিয়েছে। আন্ডারপ্যান্ট পরে শীতে যারা কাঁপছে, তাদের সবাই যুবক। তাদের দেশে অলরেডি একটা অংশ ইসলাম কায়েমের জন্য, দ্বীনি পালনের পরিবেশদায়ী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মেহনত করছে। আর এরা প্রাণভয়ে আশ্রয় নিচ্ছে কাফির দেশে। এমন না যে, সংগঠিত হওয়া কঠিন, অলরেডি সংগঠিত মেহনত চলছে। আসল কথা হল, কাফিররা না; মুসলিমদের মধ্যে বিরাট একটা অংশ ইসলামকে ভয় পায়। ইসলামী সমাজ - আইন - বিচার - শাসনকে ভয় পায় কাফিদের চেয়ে বেশি। এরা ইসলাম চায়, ইসলামী রাষ্ট্র চায় না। সেকুলার ইসলাম চায়। কাফিরদের মনমত ইসলাম পালন করতে চায়। আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি ১৪০০ বছর আগে। মদীনা নগররাষ্ট্র। কিছু মানুষ সেখানে সামনের কাতারে নামায পড়ে, এশা ও ফজরের নামাযও জামাতের সাথে পড়ে, কুরআন তিলওয়াত করে আবেগঘন তারতীলে। কিন্তু মক্কার মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক রাখে, সাজিশ করে ইয়াহুদীদের সাথে। যেকোনো সুযোগে মুহাম্মদকে উৎখাত করার জন্য। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ইসলামকে সহ্য হয়, সহ্য হয় না ইসলামী রাষ্ট্র - সমাজ - আইন - বাজার। মিলিয়ে নিন, এরাও বড় গলায় বলত আমরা মুসলিম, আমাদের ইসলামে কোনো খাদ নেই। আল্লাহর খাতায় তারা কী? সুতরাং ইসলাম পালনের নামে সুবিধার যে অজুহাত দাঁড় করাচ্ছেন, সেই ফাঁকি আল্লাহকে দিতে পারবেন তো?
কাফিরদের মাঝে থাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, তাদের সাথে ওঠাবসার ফলে সহমর্মিতা তৈরি হয়। তার কুফরকে নির্দোষ মনে হয়, শিরককে তার অধিকার মনে হয়। তাওহীদকে আবশ্যিক মনে হয় না। হয় আপনার কাছে, নয় আপনার সন্তানের কাছে, নয়তো আপনার নাতির কাছে। দ্বীনি গায়রত চলে যায়, দ্বীনের প্রবল বিধান নিয়ে হীনমন্যতা, তা থেকে সংশয়, তা থেকে ইরতিদাদ। একদম সরলরেখা। একসময় এটা হবেই। এবং এজন্য এককভাবে আপনি দায়ী। সামান্য দুনিয়ার চাকচিক্য, নিরাপত্তা, আরাম, স্বস্তির জন্য আপনি অনন্তকালের শাস্তির রাস্তা বেছে নিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা সমাজ-মানস খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেছে। পশ্চিম আর ইসলাম খুব দ্রুত প্রতিপক্ষ হয়ে গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে 'কাফির দেশে স্থায়ী বসবাস' নিয়ে ফকীহদের আবার ভাবার সময় এসে গেছে। রাষ্ট্রীয় পলিসির কারণে নারী-উদ্দামতা, সমকামিতা, নাস্তিকতা, ইসলামের ফরজিয়াত অস্বীকার প্রভৃতি বাধ্যতামূলকভাবে সন্তানদের শেখাতে হচ্ছে। আর ওয়ালা-বারাআ তো এমনিতেও নষ্ট হয়, খালদূনীয় ফর্মুলায়।
কাফির রাষ্ট্রে মুসলিম মনস্তত্ব কেমন হয়, আরেকটা উদাহরণ দিই। আমেরিকাতে বিভিন্ন ভার্সিটিতে মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন আছে (MSA)। এমনই এক MSA-র প্রোগ্রামে, খেয়াল কইরেন মুসলিম ছাত্রদের প্রোগ্রামে একজন মুসলিম ছাত্র প্রশ্ন করলেন দাঈ উস্তায ড্যানিয়েল হাকিকাতজু-কে: সমকামীদের অধিকারের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান। তো উনি হীনমন্যতা না রেখে স্ট্রংলি ইসলামের অবস্থান তুলে ধরলেন। পরে শুনলেন: এমন একজন কট্টরপন্থী দাঈকে কেন প্রোগ্রামে আনা হল, তা নিয়ে মুসলিম ছাত্ররাই প্রশ্ন তুলেছে।
ইসলাম একটা বুননের মত। আমি একটা উদাহরণ দিই। একটা লম্বা সময় আমি খিদমাহ হাসপাতালে ডিউটি করতাম। আপনারা যারা জানেননা, তাদের সুবিধার জন্য বলছি, এটা তাবলীগের সাথী ও আলিমদের পরিচালিত হাসপাতাল, খিলগাঁওয়ে। মহিলা-পুরুষ আলাদা ফ্লোর। সব বিষয়ের মহিলা ডাক্তার আছে (অর্থোপেডিক্স মানে হাড্ডি ছাড়া)। পুরুষ ফ্লোরে পুরুষ নার্স। আল্ট্রাসনো থেকে ব্লাড যে নেয় সে পর্যন্ত আলাদা, ক্লিনারও আলাদা। মোটামুটি চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই একটা ইসলামসম্মত পরিবেশ বজায় রাখার। স্টাফদের-ডাক্তারদের সবাই তাবলীগ-সম্পৃক্ত অবশ্যই না, স্বাভাবিকভাবে মেজরিটিই তাবলীগের সাথে সম্পর্কহীন। কিন্তু আমার আন্দাজে এখানে শতভাগ স্টাফ-ডাক্তারই নামাযী, এবং জামাআতের সাথে নামাযী। একদম কট্টর লীগঘেঁষা কয়েকজন স্যার ছিলেন, তাঁরাও নামাযী। একজনের ভয়ে আমরা সবাই তটস্থ থাকতাম, তিনিও। একাধিক স্যারকে স্টাফকে আমি দেখেছি চোখের সামনে দাড়ি ছেড়ে দিতে, টাখনুর উপর কাপড়ে অভ্যস্ত হতে। যাক, আমি যে পয়েন্টে আসতে চাচ্ছি সেটা হল, এখানে প্রায় শতভাগ স্টাফ জামাআতের সাথে নামাযী, দাড়ি থাক বা না থাক, পাঞ্জাবী বা টাই-স্যুট পরা হোক। এমন না যে অথোরিটি হুকুম করেছে, বা নামাযী দেখে দেখে নিয়েছে। এর পিছনে কর্তৃপক্ষের একটা সিদ্ধান্ত জাস্ট। সেটা হল, বেসমেন্টে যে মসজিদ আছে, সেখানকার জামাআতটা একদম পাশের খিলগাঁও শাহী মসজিদের জামাআতের ১৫ মিনিট পর। শুধু এতটুকু। আপনার পাশের চেয়ারের সহকর্মীটা মূল মসজিদের জামাআতের জন্য গেল, সে আসার পর আপনার ভিতর থেকেই একটা ঠেলা কাজ করছে: এখন বেসমেন্টে জামাত। এত সুন্দর সুযোগ, তারপরও যদি না পড়ি, কেমন হল ব্যাপারটা। এই ভিতরের তাড়না যেকোনো ঈমানওয়ালাকে নামাযে টেনে নেবে।
এবার উল্টোটা ভাবেন। ধরেন বেসমেন্টে মসজিদ আছে। কিন্তু টাইম দুই মসজিদে একই। যারা নামায পড়ে, তারা পড়বে। কিন্তু যে পড়তো না, সে আর পড়বে না, অজুহাত খাড়া করবে: সবাই একসাথে গেলে কী হয়? পাশের জন তো গেছে, আমি পরে পড়ে নেব ইত্যাদি। নতুন নামাযী তৈরির সুযোগ থাকল না। আবার ধরেন যদি বেসমেন্টে মসজিদটা না থাকে, তাহলে নামাযী লোকদেরও অনেকে কাজের মাঝে বেরিয়ে পাশের মসজিদে গিয়ে জামাআত ধরার আগ্রহ হারাবে। হয় ভিতরে পড়ে নেবে, বা বাসার জন্য জমাবে। নতুন করে নামায ধরা তো বাদই দিলাম। জামাআতে যারা আগে পড়ত, তাদের সংখ্যাই কমতে থাকবে। এবার খিদমাহ হাসপাতালটাকে একটা রাষ্ট্র চিন্তা করেন। আর আমল হিসেবে শুধু নামায চিন্তা করেন। দেখেন নামাযের একটা রাষ্ট্রীয় বুনন আছে (মসজিদ-টাইম-সুযোগ তৈরি), একটা সামাজিক বুনন আছে (নামাযীদের মাঝে থাকা/বেনামাযীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি), পারিবারিক বুনন আছে (বাবা-মায়ের কেয়ার, তিরস্কার ইত্যাদি), সেই সাথে ব্যক্তিক বুনন (দায়বদ্ধতা, অভ্যাস ইত্যাদি)। সবক'টা বুনন মিলে 'ইকামাতে সালাত' হচ্ছে, নামায প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। নামাযী বাড়ছে, বেনামাযী নামাযী হচ্ছে, নামাযী জামাআতের পাবন্দি করছে, নামাযকে জীবনে ধরে রাখছে। এভাবে দ্বীনের প্রত্যেকটা বিধানেই এমন পরতে পরতে বুনন আছে। এক পরত ছুটিয়ে দিলে বাকিগুলোও ছুটে যায়। কর্তৃপক্ষের লেভেলে নামাযের সহায়তা বাদ দিলে শেষে গিয়ে ব্যক্তিজীবনেও নামায বিঘ্নিত হয়। গ্রামের দিকে এখনও বেনামাযীকে অন্যচোখে দেখা হয়, গুষ্ঠির মধ্যে ভিন্ন নজরে দেখা হয়। নামাযের মত একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় দিয়ে উদাহরণ দিলাম। তাহলে অপেক্ষাকৃত বেশি সামাজিক বা পারিবারিক বিধানগুলো এখন মুসলিম দেশেই সেকুলারিতার কারণে এড়ে যাচ্ছে। সেখানে কাফের দেশে কীভাবে আপনারা ইসলাম ভালোভাবে পালনের দাবি করছেন, আমি বুঝতে পারছি না।
যদি শুধু ব্যক্তি/পরিবারে আপনি ইসলাম চর্চা করছেন বলে মনেও করেন, সেটা নিম্নমুখী, ক্ষয়িষ্ণু। যেটা উপরের উদাহরণ থেকে দেখলাম। রাষ্ট্র নেই (মুসলিম দেশেও রাষ্ট্র নেই অবশ্য), সমাজ নেই (এটা তো মুসলিম দেশে আছে এট লীস্ট কিছুটা), অতএব আপনার পারিবারিক ও ব্যক্তিক ইসলাম ক্ষয়িষ্ণু। ইবনে খালদূনও সেটাই বলছেন। আরাম আয়েশ নিরাপত্তা বাড়বে, ধর্ম কমবে। আপনার যা আছে, তাও থাকবে না, সন্তানে আরও থাকবে না, নাতি আরও না। এটাই পরিবেশ। এমনকি পশ্চিমের আলিমরাও এ থেকে মুক্ত নন। তারা ফেরেশতা নন, তাই পরিবেশ-সমাজ-সাহচর্যের প্রভাব থেকে মুক্ত নন। দেখেন একজন মুসলিম মেয়ে অপমান বোধ করছে, কেন তাকে আলাদা বসানো হল, কেন ছেলেমেয়ে মেশানো হল না। মুসলিম ছেলেরা দাঈকে অপছন্দ করছে, কেন তাদের সমকামী বন্ধুদের মেনে নেয়া হবে না। এই রকম মুসলিম কমিউনিটির কাছে জনপ্রিয় হতে চাইলে/ বা এদের মাঝে কাজ করতে চাইলে হিকমাহর নামে আপনাকে অবশ্যই দ্বীনের কিছু অংশ চেপে যেতে হবে। নইলে এরা আপনার কথা শুনবে না, আপনাকে অপছন্দ করবে। মেয়েটির প্রশ্নে সেই আলিম জবাব না দিয়ে কেন পরের প্রশ্নে গেলেন, এটা জেফ্রিলাঙের লেগেছে। কেন হাকিকাতজু ভাই সমকামীদের অধিকারের পক্ষে অবস্থানকে কুফর বললেন, এটা মুসলিম ছাত্রদের লেগেছে। এভাবে আপনি পশ্চিমা মুসলিম কমিউনিটির কাছে পাত্তা পাবেন না।
এজন্যই পশ্চিমা দাঈ-আলিমদের উপস্থাপিত ইসলাম অপূর্ণাঙ্গ হয়। পুরোটা তাঁরা তুলে ধরতে পারেন না, চাইলেও পারেন না। পুরোটা প্রেজেন্ট করতে চাইলে তাঁরা সমস্যায় পড়বেন। ইসলামের সামাজিক বুনন তুলে ধরলে সামাজিকভাবে আপনি বয়কট হবেন, যেমন হাকিকাতজু ভাই হলেন। রাষ্ট্রীয় বুনন তুলে ধরলে আপনি জেলে যাবেন, যেমন শাইখ জিবরীল গেছেন। পশ্চিমা দাঈদের উপস্থাপিত ইসলাম হতে হয় পশ্চিমা সমাজের সাথে মিলিয়ে, পশ্চিমা রাষ্ট্রচিন্তার সাথে মিলিয়ে। 'ব্যালান্সিং ইসলাম উইথ সিভিল রাইটস।' এ এক নতুন ইসলাম, এক নতুন ধর্ম হয়ে যায় তখন। পশ্চিমা ইসলাম। এখানে ইসলামের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বুনন থাকে না। পারিবারিকও না, ব্যক্তিস্বাধীনতার তোড়ে। বেশি তেড়াব্যাড়া করলে সন্তান কেসও করে দিতে পারে। ফলে অতিক্ষয়িষ্ণু এক আজীব ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে কুফরের পাশে দাঁড়ানো হয় টিকে থাকার কৌশল, ধর্মের খুঁটি। ব্যক্তিজীবনের ইসলাম নিশ্চিত করতে আপনাকে জগতের নিকৃষ্টতম কর্মকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাস্তায় নামতে হবে। অথচ অলরেডি আপনি কুফরের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছেন। হাদিস: অন্যায় হতে দেখলে হাত দিয়ে বাধা দাও, নয়তো মুখে নিষেধ করো। তাও না পারলে অন্তরে ঘৃণা কর। এর নিচে আর ঈমান নেই। আর আপনি অন্তরে ঘৃণা না করে সেটাকে সিভিল রাইট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করছেন। মানে ঈমানের শেষ সীমার নিচে চলে এসেছেন। প্রবেশ করেছেন কুফরের সীমায়।
এজন্য পশ্চিমা দাঈদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ খুব সতর্কতার সাথে গ্রহণ করতে হবে। ঠিক যেমন ডাক্তার জাকির নায়েক যখন কোনো হিন্দুকে বুঝানোর জন্য হয়ত কোনো একটা বিষয় ব্যাখ্যা করলেন, যেটা আপনার জন্য নয়, সেটা হয়ত ইসলামের ব্যাখ্যাও নয়, বা ডিফেন্সিভ ব্যাখ্যা। তেমনি এসব দাঈর ব্যাখ্যা, ভেঙে ভেঙে বিশ্লেষণ করে লঘুকরণ, এটা আমেরিকান মুসলিমদের জন্য, তাদেরকে তাদের সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষিতে অচেনা ইসলামী সমাজের বুঝ দেয়ার জন্য। আপনার জন্য নয়। আমেরিকান একজন মুসলিমের মেন্টাল সেট-আপ ও সমাজবাস্তবতা আপনার মত নয়। ঠিক একই কারণে কাফির ভূমিতে বেড়ে ওঠা কোনো দাঈর সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বিধানের ব্যাখ্যা অবশ্যই আপনি নিবেন না। কেননা একই মানস-গঠনের কারণে এলিয়েন (অপরিচিত) ইসলামী সমাজ-রাষ্ট্র-আইনকে সে তার চেনা সমাজ-রাষ্ট্র-আইনের সাপেক্ষে ব্যাখ্যা করবে। উদাহরণ যদি দিই, উস্তায নোমান আলী খান। বড় হয়েছেন, পড়াশুনা করেছেন আমেরিকায়। আপনি কুরআনের ব্যাকরণিক বিস্ময়গুলো তাঁর থেকে নিলেন। কিন্তু যখন তিনি বলছেন: সাহাবীরা পরিচয়ের ভিত্তিতে নিজেদের মাঝে বৈধ কোর্টশীপ (প্রেম) করতেন। তখন আপনাকে ভুরু কুঁচকাতে হবে। এই ভুরু কুঁচকানো আপনাকে শিখতে হবে, কখন কুঁচকাতে হয় জানতে হবে। এটা ইলমের বিষয় না, কাণ্ডজ্ঞানের আওতায় পড়বে। কারণ নোমান আলী খান যে সমাজে বড় হয়েছেন সেখানে হারাম সম্পর্ক পানিভাত। সেই চোখে তিনি ব্যালেন্স করতে চেয়েছেন স্বাভাবিক মানবপ্রকৃতির তাড়নায়।
সুতরাং ব্যক্তিক ও পারিবারিক ইসলাম আপনি পশ্চিমা দাঈদের কাছে পেতে পারেন। সব আবার পাবেন না। অর্থনৈতিক অংশটুকুও পশ্চিমের অর্থব্যবস্থার আলোকে ব্যালেন্স করে তারা আপনাকে জানাবে, ঐটুকুই জানাবে যেটুকু আপনার পশ্চিমে থাকার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। ঐটুকুই আপনি শুনতে চান, বাকিটুকু শুনতে চান না। কারণ যাদের উদ্দেশ্যে উনি বলছেন, তাদেরকে থাকতেই হবে পশ্চিমে। পশ্চিমে থাকতে অসুবিধা হয়, ইসলামের এমন অংশটুকু তাদের কাছে অপ্রিয়। অপ্রিয়টুকু আপনাকে তারা শোনাবে না। সামাজিকও পাবেন না। তাহলে কোথায় পাবেন। সেটা পাবেন মুসলিমপ্রধান দেশে, যেখানে ইসলামের সামাজিক দিকগুলো এখনও রয়েছে, আংশিক রয়েছে, বা আলিমরা নির্ভয়ে সামাজিক দিকগুলো বলছেন। যেমন বাংলাদেশের কথাই ধরি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলোর আলোচনা কমে গেলেও এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সুদ, পর্দা, মাহরাম বিষয়গুলোর আলোচনা এলে পরদিন ইমামের চাকরি নাই। তারপরও কিছু আলোচনা আছে। এগুলো জায়েজ বা ইনিয়েবিনিয়ে জায়েজ তো বানাচ্ছে না এটলীস্ট। আবার রাষ্ট্রীয় বিধানগুলোতে তাঁরা কম্প্রোমাইজ করছেন, তাঁদের মুখে 'ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামী জিনিস', 'শাসকের আনুগত্য না করলে খারেজী'—এসব বয়ান পেলে আপনার ভুরু কুঁচকাতে হবে। কেননা তাঁদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নেই, ফলে রাষ্ট্রচিন্তাগুলোও তাঁদের প্রভাবিত, যেমনটা পশ্চিমা দায়ীদের সমাজচিন্তা প্রভাবিত। এটা আবার কোথায় পাবেন? এটা পেতে হলে আপনাকে তাকাতে হবে, কোথায় ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে আছে। সেখানে আপনি ইসলামের রাষ্ট্রীয় হুকুমগুলোর নির্ভেজাল ব্যাখ্যা পাবেন। তেমনি জি.হাদ এমন একটা বিষয় যার সঠিক আনইন্টেরাপ্টেড আনবায়াসড পিওর হুকুম ও ব্যাখ্যা আপনি এ যুগে সেখানেই পাবেন, যেখানে সেটার আমল হচ্ছে। সুবিধার জন্য, হিকমাহর নামে, কারও হুমকি থেকে বাঁচতে কোনো কাটছাঁট করা হচ্ছে না। বিকৃতির জন্য প্রভাবক থেকে তারা মুক্ত। ইসলামের ব্যক্তিক-পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-বিচারিক-রাষ্ট্রীয়-আন্তর্জাতিক সকল হুকুমের ব্যাখ্যা ও দর্শন যদি একসাথে চান, আপনাকে সেই ভূমির দিকে তাকাতে হবে, যেখানে ইসলাম জয়ী, ইসলাম যেখানে মিন মিন করে চলেনা, বুক চিতিয়ে চলে সেখানে আল্লাহর হুকুম। এজন্য ইমাম শাফিঈ বলতেন: যখন আমি কোনো মাসআলায় আটকে যাই, আমি দেখি মু.জাহিদীনরা সেটার কী ব্যাখ্যা করছেন, সেটাই প্রকৃত ব্যাখ্যা।
এখন আপনি যদি আমেরিকায় অবস্থানকারী কোনো দাঈ থেকে বা আমেরিকায় বেড়ে ওঠা কোনো দাঈ থেকে জি.হাদের মত ইসলামের আন্তর্জাতিক দর্শনের ব্যাখ্যা চান, সেটা হবে আপনার ভুল। যেখানে সে পাশ্চাত্য সমাজের প্রভাবে ইসলামের সামাজিক দর্শনই তুলে ধরতে অপারগ, সেখানে আন্তর্জাতিক দর্শন ক্লিয়ার করা আপনি কীভাবে আশা করেন। হতে পারে তার জ্ঞান সম্পর্কে আপনার অগাধ বিশ্বাস। এটা জ্ঞানের বিষয় নয়, এটা টিকে থাকার ইস্যু। সে সমাজে টিকে থাকতে হলে সে এগুলো আপনাকে ক্লিয়ার করতে পারবে না। সম্প্রতি নোমান আলী জি.হাদ সম্পর্কে যা বলেছেন, তা তার জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক। আপনি এই বিষয়ে তাঁর উপর আস্থা রাখছেন এটা আমার আপনার ভুল। ঠিক একারণেই পরিপূর্ণ ইসলামকে বুঝতে আপনাকে পূর্ববর্তী আলিমদের বক্তব্য নিতে হবে যেসময় ইসলাম বিজয়ী ছিল, তাহলে আপনি পুরো বুননটা পাবেন। আধুনিক সময়ে মুসলিমরা পরাজিত, মানসিকতাও পরাজিত। আধুনিক যুগের স্কলারদের কথা যদি জমহুর (অধিকাংশ) ক্ল্যাসিক্যাল স্কলারদের বিরুদ্ধে যায়, আপনাকে বুঝতে হবে তার সীমাবদ্ধতা, যেটা ক্ল্যাসিক্যালদের বিজয়ের যুগে সীমাবদ্ধতাটা ছিল না। তবেই আপনি আংশিক ইসলামের হাত থেকে মুক্তি পাবেন। 'তবে কি তারা কিতাবের কিছু অংশ মানে, কিছু অংশ মানেনা'র অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো স্পষ্ট নির্দেশনা আমাদের দিয়েই গেছেন: সর্বোত্তম আমার যুগ, এর পরের যুগ, তার পরের যুগ, তার পরের যুগ। এরপর মিথ্যা প্রকাশ পাবে। (হাদিস)
প্রথম চার যুগের চোখে ইসলামকে জানুন, পুরো বুননটা পাবেন। আর এখনকার চোখে নিলে পাবেন সুতোছেঁড়া বুনন-এড়ে যাওয়া শতচ্ছিন্ন এক ইসলাম, যাতে সতরই ঢাকে না।
আল্লাহ আমাদের গুনাহগুলো ঢেকে রাখুন। ইয়া সাত্তার।
[1] ‘ইবনে খালদূন’