"আমি অপার হয়ে বসে আছি
ও হে দয়াময়
পারে লয়ে যাও আমায়" …

গানটার কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেলো। লালনের এই গানটা কবে শেষ শুনেছিলাম জানিনা। কিন্তু এখন মনে পড়লো কারণ বারবার মনে হচ্ছে আমি তো অপেক্ষাই করছি। এটাকে কি অপার হয়ে বসে থাকা বলে? অপার শব্দটার মানে আমি অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছু পেলাম না। পার হওয়া মানে তো অতিক্রম করা। ''অ' উপসর্গটা এখানে 'না-বোধক' যুক্ত হয়ে সম্ভবত অপার এনেছে। অর্থাৎ অতিক্রান্ত হতে না পারাকে অপার হওয়া। অপার হয়ে বসা থাকা মানে তীরে এসে অপেক্ষা করা। কেউ এসে পার করে দিবে। অপর পাড়ে যাবো। তখন পার হবো। যতক্ষণ না পার হতে পারছি না, ততক্ষণ অপার হয়ে বসে আছি।

আমি অনেকদিন কিছু লিখিনা। কারণ অনেকদিন যাবতই আমার মন খারাপ -- সেটা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। আমার মন খারাপ থাকাতে শারীরিক, মানসিক, আত্মিক -- সবগুলো কারণই গভীরভাবে যুক্ত। আমি জানি, এসময় কলম বেয়ে যা গড়াবে সবই হবে মন খারাপের গান। সেই গানের সুরে আমার প্রিয় মানুষরা মন খারাপ করেন, বিরক্ত হন। প্রিয় মানুষরা আসলে এই কাজটা খুব ভালো পারেন -- মনঃক্ষুণ্ণ হতে। প্রত্যাশার বিশাল একটা অশ্বত্থ লাগিয়ে তারা আমাকে তার ডালপালা হতে বলেন-- যেটা ছড়িয়ে যাবে এইপ্রান্ত থেকে ওই দূরের প্রান্তে! অথচ, আমি ক্ষয়ে ক্ষয়ে যেতে থাকি। তারা বুঝেন না। তারা ভাবেন সময় নিয়ে গাছটা বড় হচ্ছে। আমি জানি আমার শেকড়ে পোকা খেয়েছে। আমার সময় কমে আসছে…

অবশ্য আমি নিজেও নিজের উপরে বিরক্ত হই এই ডিপ্রেশন নিয়ে। এটা আমার জীবনের পরীক্ষাই হবার কথা। কিন্তু সবগুলো জিনিস কেমন যেন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। হতবুদ্ধি হয়ে কঠিন সময়কে আমি কেবল আলিঙ্গন করে চলেছি। অপার হয়েই বসে আছে তাদের ছাড়িয়ে নেয়ার ব্যাপারটাতে।

গানের লাইনগুলো আবার মনে পড়ে যাচ্ছে--

"আমি একা রইলাম ঘাটে…
ভানু সে বসিল পাটে-
(আমি) তোমা বিনে ঘোর সংকটে
না দেখি উপায়… "

আমি একা ঘাটে রইলাম কিনা জানিনা। তবে আমার জীবনের ঘাটে আমি একাই রয়েছি। আর কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছেনা কী তীব্র শারীরিক, মানসিক আর আত্মিক ক্ষত আমাকে বিক্ষত করছে। আমার আশার ভানু (সূর্য) পাটে বসেছে। আর আমি আমার স্রষ্টার আশায় বসে আছি। তাকে বিনা আমি ঘোর সংকটে আছি। না দেখি উপায়, আমি তোমা বিনে ঘোর সংকটে। ওহে দয়াময়, পারে লয়ে যাও আমায়।

কঠিন সময়গুলো সরে যাবে জানি। জানি একদিন আবার সূর্য হাসবে। ভানু ফিরে আসবে। আমি সেই সময়ের জন্য অপার হয়ে বসে আছি। আমার দয়াময়ের দয়ার স্পর্শ আসবে আমার উপর, আমি আবার আগের মত করে সুস্থ হয়ে চলাফেরা করবো, আগের মতন করে আশাবাদী হবো নিজেকে নিয়ে, আমার পরিবার-সমাজকে নিয়ে, আমার উম্মাহকে নিয়ে… এই স্বপ্ন দুনিয়া কাটিয়ে আখিরাত ছুয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। সূর্য কখনো চলে যায়না। আমি জানি সূর্য পাটে যায়নি। স্রেফ একখন্ড মেঘ এসে তাকে আড়াল করে নিয়েছে। আমার মতন করে এখন আত্মা আরো বড় বড় সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে। তারা সবাই অপার হয়ে অপেক্ষা করছে তার অপার ভালোবাসার বর্ষণের।

এই মন খারাপদেরকে আমি খুব ভালো করে চিনি। আমার সাথে জনম জনমের দোস্তি। কিন্তু আমি ওদের জানিয়ে দিয়েছি -- আমি এখন চিনি আমার আল্লাহকে। আগে তারা এসে আমার আল্লাহকে ভুলিয়ে দিতে চাইতো, পারতো। এখন আর তা হতে দিইনা। দিতে চাইনা। আমি জানি, একবার আমি আমার কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললে মেঘনার মোহনার প্রবল ঘূর্ণির মতন করে এই মনখারাপের দল আমাকে গভীরে ডুবিয়ে নিয়ে যাবে -- আমি হারিয়ে যাবো, মরে যাবে আমার স্বপ্নদের দল।

এই তিলোত্তমা নগরী ঢাকার জনমানবের মাঝে কেন যেন প্রবল পশুত্বকে আবিষ্কার করি -- অনৈতিক, জিঘাংসু আর ভোগময় পশুর দল। তখন খুব ইচ্ছে হয় সবাইকে সুন্দর জিনিসগুলোকে চিনিয়ে দিই, ইচ্ছে করে আত্মার মুক্তির অর্থ আর পথগুলো বুঝিয়ে দিই। দিন দিন আমি অনুভব করছি যারা খারাপ কাজ করে, তারা আসলে খুব বেশি খারাপ না। আসলে তাদের কেউ বুঝাতেই পারেনা। তারা যে জানেন না সুন্দর কী -- এই অজ্ঞানতা খুব বড় অপরাধ নয়। কিন্তু তাদের বুঝাতে হলে তাদের চাইতে সুন্দর "আত্মা" হতে হয়। এটুকু বুঝি আমি! অথচ, হতভাগা আমি যে আমাকেই সামলাতে পারিনা! আমি আমাকে পেরিয়ে কবে অন্যদের কাজে আসবো! কবে সুন্দর আত্মা হয়ে তাদের ডাকবো সুন্দরের পথে! আমাদের সমাজের সুন্দর আত্মার মানুষদের প্রয়োজন তাদের বোধগুলোকে চারপাশে ছড়িয়ে দিতে। হাসনাহেনার সুবাসের মতন যখন সেই সৌন্দর্যের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে যাবে -- হতে পারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা ওই নির্বোধ মানুষদেরকে সেরা মানুষ বানিয়ে দেবেন!

আমি জানি, মুক্তির পথ ওই "তাঁর" মাঝে নিজেকে সঁপে দিতেই। তিনি ছাড়া আমার আসলে আর কিছুই করার নেই। আমি এখন যেকোন প্রচেষ্টার উর্ধে। ব্যক্তিগত জীবনে আমার অনেক পরিবর্তন দরকার। এভাবেই দিগভ্রান্ত হয়ে চলেছে অনেকগুলো বছর। এই স্পর্শকাতর আত্মা মরতে বসে কেন বারবার আমি জানিনা। একাকীত্ব আর দিকভ্রান্তির মাঝে ডুবে আমার রবের নির্দেশগুলোর কোন একটিকে যখনই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অমান্য করে ফেলি, তখনই বুঝি এই আত্মাতে অমোচনীয় কালির দাগ পড়লো। সে দাগ ঘষে ঘষেও তুলতে পারিনা। ঘষতেই থাকি, ঘষতেই থাকি -- তা হতাশা বাড়াতে থাকে, লজ্জা বাড়াতেই থাকে… আমি এখন আত্মায় দাগ ফেলতেই ভয় পাই।

আমি ইদানিং শরীরের ব্যথাগুলোকে আবিষ্কার করে লজ্জিত হই। যখন ব্যথাগুলোতে প্রবল কষ্ট হয়, তখন পথের ধারে পড়ে থাকা বিকলাঙ্গ মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে। আমি তো আর বিশেষ কৃতকর্মের কারণে তাদের চাইতে ভালো নেই, তাইনা? আমি জানি হে দয়াময়, আমি অনেক ভাগ্যবান। তবু এই ক্ষুদ্র বান্দার মনের, শরীরের, আত্মার কলঙ্কগুলোকে মোচন করার শক্তি দাও, ভালোবেসে ক্ষমা করে তাকে প্রশান্তি দাও।

এটা হয়ত কোন ব্লগ হতে পারেনা। তবু লিখবো। কারণ, আমি জানি, আমাদেরই সমাজের অনেক মানুষ আমার মতন করেই মন খারাপ নামক রোগে ভুগছে। এই রোগটা মূলতঃ আত্মার। আত্মা হাসিখুশি আর আশাবাদী থাকলে মনও ভালো থাকবে। আর আত্মাকে খুশি রাখতে স্মরণ করা দরকার আমারই রব্বের পাঠানো সেই শব্দমালা --

"মানুষকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে আমাকে ডাকতে শুরু করে, এরপর আমি যখন তাকে আমার পক্ষ থেকে নেয়ামত দান করি, তখন সে বলে, এটা তো আমি পূর্বের জানা মতেই প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না।

তাদের পূর্ববর্তীরাও তাই বলত, অতঃপর তাদের কৃতকর্ম তাদের কোন উপকারে আসেনি।

তাদের দুষ্কর্ম তাদেরকে বিপদে ফেলেছে, এদের মধ্যেও যারা পাপী, তাদেরকেও অতি সত্বর তাদের দুষ্কর্ম বিপদে ফেলবে। তারা তা প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না।

তারা কি জানেনি যে, আল্লাহ যার জন্যে ইচ্ছা রিযিক বৃদ্ধি করেন এবং পরিমিত দেন। নিশ্চয় এতে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।

বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।" [৩৯:৪৯-৫৩]


১১ অক্টোবর, ২০১১