বাংলাদেশে গাঁজা চাষ, উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ। গাঁজাখোরদের অপরাধী মনে করা হয়। প্রথম লাইন 'গাঁজা' শব্দ দিয়ে শুরু করতেও বারবার চিন্তা করতে হয়েছে, মনের মধ্যে সংকোচ কাজ করেছে। কিন্তু পৃথিবীর সব দেশে গাঁজা নিষিদ্ধ নয়। উদাহরণস্বরূপ কানাডার কথা বলা যায়। সুদর্শন কানাডিয়ান প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডোর সরকার ২০১৮ সালের শেষ দিকে গাঁজা চাষ ও বিক্রি বৈধ করেন। [1] পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গাঁজার ফার্মটিও কানাডায় অবস্থিত। বর্তমান রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে যে ক'জন সমকামীদের বিকৃত মুভমেন্টের পক্ষাবলম্বন করছেন তাদের মধ্যে লিবারেল পার্টির নেতা জাস্টিন ট্রুডো অন্যতম। [2]
আইমান সাদিক প্রতিষ্ঠিত রবি টেন মিনিট স্কুলের শিক্ষকদেরকেও দেখা যাচ্ছে সমকামীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে। তারা হোমোসেক্সুয়ালিটিকে গর্হিত কাজ হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। টেন মিনিট স্কুল চ্যানেল সাকিব-মিথিলাদের বহু বিতর্কিত কন্টেন্ট প্রচার করছে যা ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। বিকৃত এক বন্ধনহীন স্বাধীনতার সবক দেয়া হয় সেখানে।
টেন মিনিট স্কুলের বিতর্কিত কাজগুলো এবং জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টি সমকামিতা, গাঁজা, মাদক, নগ্নতা ইত্যাদি বিষয়ে একমত হওয়ার পেছনে একটি অভিন্ন মতাদর্শ রয়েছে। সেই মতাদর্শই তাদের বহু বিষয়ে অভিন্ন অবস্থান গ্রহণের মানদন্ড হিসেবে কাজ করছে। আর তা হলো, লিবারেলিজম। যা পুরোপুরি ইসলামের বিপরীত একটি মতাদর্শ, বহু মুসলিমের ইমান হরণের জন্য দায়ী। ব্যক্তি, সমাজ, মানব জাতির জন্য ক্ষতিকর। তাই বর্তমান সময়ে লিবারেলিজম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা মুসলিমদের জন্য একান্ত জরুরি।
লিবারেলিজমের পরিচয়ে শিক্ষাবিদ জগলূল আসাদ লিখেন—
[লিবারেলিজমের বাংলা সাধারণত করা হয় "উদারনীতিবাদ"। একে "স্বাধীনতাবাদ" বা "খাহেশাতবাদ" বললেও অত্যুক্তি হবে না। এর ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, বিবর্তনও জটিল। সাধারণত জন লককে এর প্রবক্তা বলা হলেও ইউরোপীয় রেনেসাঁস, রিফর্মেশন আন্দোলন, আর এনলাইটেনমেন্ট দর্শন-এর সাথে লিবারেলিজমের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগ আছে।
পশ্চিমা চিন্তায় অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে যা পরিচিত সেটার ভেতর থেকে অর্থনৈতিক-সামাজিক- রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে লিবারেলিজমের জন্ম। একটা এন্টি- অথরিটারিয়ান পলিটিকাল ক্রীড হিসেবে এটাকে বিবেচনা করা হয়। লিবারেলিজম মানুষকে ভাবে স্বাধীন, যুক্তিশীল ও সার্বভৌম সত্তা হিসেবে, যে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, নিজের পছন্দ অনুসারে "বাছাই" করতে পারে। "গুড লাইফ"-এর কোন সংজ্ঞা রাষ্ট্র চাপিয়ে দিবেনা জনগণের উপর, বরঞ্চ রাষ্ট্র একটা অধিকার-কাঠামো দিবে যেখানে "ব্যক্তিমানুষ" নিজের মূল্যবোধ, ধর্মবিশ্বাস, জীবনযাপনপ্রণালী বাছাই করে নিবে।] [3]
অর্থাৎ লিবারেলিজমের ধারণায় ব্যক্তি চিন্তা, কর্ম ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীন, সার্বভৌম। আল্লাহর মর্জি, ইচ্ছা ও বিধানের সামনে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পরিবর্তে জীবনের মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা হয় নিজের খায়েসাত তথা প্রবৃত্তিকে। মানুষ আল্লাহার দাস না হয়ে হবে প্রবৃত্তির দাস। আর আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কোরআনে বারবার প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। [4]
লিবারেলিজমের অন্যতম মূলনীতি হলো 'অপরের ক্ষতি না করে, তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো'—তোমার ব্যক্তিজীবনে তুমি স্বাধীন। অর্থাৎ তুমি যা ইচ্ছে পরবে, তা ইচ্ছে খাবে, যা ইচ্ছে করবে। ইচ্ছে হলে নগ্ন হয়ে বীচে যাবে, কুকুর, বিড়াল, মদ, গাঁজা যা ইচ্ছে খাবে। লিবারেল ডকট্রিনে জিনা-ব্যভিচার-লিভটুগেদার সবই ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। শুধু এটুকু মনে রাখতে হবে অন্যের ক্ষতি করে বা অসম্মতিতে কিছু করা যাবে না। পরস্পরের সম্মতিতে সকল নিষিদ্ধ কাজও সিদ্ধ হয়ে যায় লিবারেল ডকট্রিনে। টেন মিনিট স্কুলের ভাষায় শুধু Consent (সম্মতি) থাকলেই হবে।
Consent শিরোনামের ভিডিওতে যেমন বলা হয়েছে, "কেউ আপনার বান্ধবী হলেই তাকে জড়িয়ে ধরা যাবে না, আগে জানতে হবে এতে তার consent (সম্মতি) আছে কিনা।" [5] অর্থাৎ শুধু সম্মতি থাকলেই বিবাহ বহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক বৈধ হয়ে যাবে। এই সম্মতি ও স্বাধীনতার দৃষ্টিকোণ থেকেই লিবারেলদের কাছে সমকামিতা, পরকিয়ার মতো জঘন্য সমাজবিধ্বংসী কাজগুলো বৈধ।
আবার অন্য ভিডিওতে দেখা যায়, বাবা-মাদের জ্ঞান দেয়া হচ্ছে, মেয়েকে রাতে বাইরে সময় কাটাতে বাঁধা দেয়া, ছেলে মেয়েদের আলাদা পোষাক দেয়া (নারী পুরুষের ভিন্ন পোষাক), মেয়েকে ছেলেদের সাথে লং টুরে না যেতে দেয়া, এগুলো উচিত নয়। অর্থাৎ এতে বাবা-মা সন্তানের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করছে, মেয়ে চাইলে টেন মিনিট স্কুলের ট্রেইনার মিথিলার মতো বহু পুরুষের সাথে অপকর্ম করার স্বাধীনতা দিতে হবে। টেন মিনিটের এ পাঠগুলোতে মূলত খুব সচেতনভাবে লিবারেলিজমের দিকে আহ্বান করা হচ্ছে। যেমনটা পশ্চিমা লিবারেল সমাজে আমরা দেখি সন্তানের অনৈতিক কাজে বাবা-মা'র শাসনের কোন অধিকার নেই, বাধা দিতে গেলে উল্টো বাবা-মাকেই মামলা খেতে হয়।
লিবারেলিজমের আরেকটি মূলনীতি হলো tolerance (সহনশীলতা)। অপরের এই বিকৃত স্বাধীনতাচর্চার প্রতি সহনশীল হতে হবে, শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় টেন মিনিটের শামির মুন্তাজীর বা প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো নিজেরা হয়তো সমকামী নন। কিন্তু সমকামী মুভমেন্টের পক্ষে। তাদের যুক্তিমতে তারা(সমকামীরা) সমকাম করছে পরস্পরের সম্মতিতে, তাই লিবারেল ধর্মে তা বৈধ। তাই তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ ও সমর্থন লিবারেল ধর্মের অনুসারীদের জন্য জরুরি। না হলে তারা সহনশীল হতে পারবেন না।
বলার অপেক্ষা রাখে না এটি খুবই জঘন্য এক দৃষ্টিভঙ্গি। হারাম কাজ না করলেও হারাম কাজকে বৈধ বা রাইট ভাবতে শেখায়। আর কোন হারামকে হালাল (বৈধ, রাইট) মনে করা কুফরি এবং ইমান ভঙ্গের কারণ। সহনশীলতার নামে ধ্বংস করে দেয় আল ওয়ালা আল বারাহ (আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব ও আল্লাহর জন্য সম্পর্কছেদ) এর চেতনা।
এছাড়া লিবারেলিজম সমাজে সেক্যুলারাইজেশ ঘটায়। যা রাষ্ট্রের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ধর্মকে নানা সেক্টর থেকে উচ্ছেদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে তিরোহিত করতে কাজ করে। সাথে সাথে লিবারেলিজম ভোগবাদকে উস্কে দিয়ে সুদভিত্তিক বৈষম্যমূলক পুঁজিবাদের বিকাশে সহায়তা করে। গড়ে তুলে অর্থনৈতিক বৈষম্য। চমস্কির মতে, আধুনিককালে লিবারেলিজম হচ্ছে অনেকটাই রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ।
লিবারেলরা ধর্মের ততটুকুই মানে যতটুকু তাদের দিল স্বায় দেয়, প্রবৃত্তির অনুগামী হয়। পরিপূর্ণভাবে ইসলামের সকল বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করেনা। এভাবে লিবারেল দর্শন বহু মুসলিমদের মানহরণ করে চলেছে। হৃদয়ে ঈমানের স্থলে কুফর প্রবেশ করাচ্ছে। প্রবৃত্তি পূজার দিকে আহ্বান করছে।
লিবারেল দর্শনের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো স্রষ্টার বিধানের মতো প্রবৃত্তির চাহিদাকেই নির্ভুল, উপকারী ও সর্বোচ্চ সুখের দিশারী মনে করা। ব্যক্তিকে মানবসভ্যতার অংশ হিসেবে না দেখে ইনডিভিজুয়াল মনে করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভালো মন্দের হিসেব কষা। আপনারে লয়ে বিব্রত থাকতে উৎসাহিত করা।
ব্যক্তির ভালো বা মন্দ কাজের কারণে যে সমাজে ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তা এখানে অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়া হয়। তাই মানসিক, নৈতিক, শারীরিক বিকৃতিমূলক কাজগুলোর বৈধতা দেওয়া হয় আর তার ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে পুরো মানবসমাজকে। বৈধ হয়েছে মাদক, ভ্রুণহত্যা, সমকামিতার মতো কাজগুলো। মানবতার ইতিহাসকে করছে কলুষিত। আর বাস্তবায়িত হচ্ছে আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে ইবলিসের এজেন্ডা।
লিবারেলিজমের সকল ভ্রান্তি ও ক্ষতিকর দিক, এ লেখায় তুলে ধরা সম্ভব নয়। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে বিস্তৃত আলাপ হতে পারে। আইমান সাদিকরা যে শিক্ষার আড়ালে একটি ক্ষতিকর মতাদর্শ প্রচার করছে তা আশা করি চক্ষুষ্মান সকলের নিকট দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সর্বশেষ বলবো সমকামিতা সাপোর্ট করে আমাদের লিবারেল হবার প্রয়োজন নেই, আমাদের জন্য মুসলিম পরিচয়ই যথেষ্ট এবং গর্বেরও। আমাদের লেখায় কষ্ট পেয়ে তেড়ে আসার আগে এটাও মাথায় রাখা উচিত, কোন ব্যক্তির প্রতি অন্ধ ভালোবাসা যেন আমাদের ইমান ধ্বংসের কারণ না হয়।
প্রাসঙ্গিক ১ [৬]—
সামাজিক বিজ্ঞানগুলো কাজ করে ব্যক্তির একটি বিশেষ সংজ্ঞাকে ঘিরে, যাকে Human Being বা ব্যক্তিমানব বলা হয়ে থাকে। সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর মতো ব্যক্তির এই নির্দিষ্ট ধারণা ও সংজ্ঞাও এনলাইটেনমেন্টের ফসল। হিউম্যান বিয়িং এর এই ধারণা ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে ধরে নেয় (freedom as self-evident value)। হিউম্যান বিয়িং মানে কিন্তু শুধু মানুষ না।
সে হল এমন কেউ যে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অমুখাপেক্ষী মনে করে। বিভিন্ন জীবনব্যবস্থা ও দর্শনকে সে মূল্যায়ন করে একটি ও কেবল একটি মাপকাঠি দিয়ে—মানবিক চাহিদা। মানবিক চাহিদা ও কামনা-বাসনার সীমাহীন পূর্ণতাই এই ব্যক্তিমানবের জীবনের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ সীমাহীন অর্থনৈতিক উন্নতি।
অর্থনীতির পুরো কাঠামো গড়ে উঠেছে ব্যক্তির এই নির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও এর অন্তর্নিহিত মূলনীতিগুলোর ওপর ভিত্তি করে। অর্থনীতির সব বিশ্লেষণ ও তত্ত্ব এমন একজন ব্যক্তি বা ইকোনোমিক এজেন্টকে ঘিরে তৈরি করা যে,
১) কেবল তার ব্যক্তিস্বার্থের প্রতি নিবেদিত
২) যে বিশ্বাস করে সর্বোচ্চ স্বার্থ অর্জিত হয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিস্বাধীনতার মাধ্যমে। অর্থাৎ আমার জন্য কোনটা ঠিক সেটা আমিই ঠিক করবো। ব্যক্তির স্বার্থ নির্ভর করে ইচ্ছেমতো যেকোন কিছু করার সক্ষমতা ও স্বাধীনতার ওপর।
৩) অন্য কারো ঠিক করে দেয়া ভালোমন্দের মাপকাঠি গ্রহণ বা বর্জনে ব্যক্তি বাধ্য না। কোন উচ্চতর শক্তির ঠিক করে দেয়া নৈতিকতা মেনে চলা ব্যক্তিমানবের (Human Being) দায়িত্ব না। কান্টের ভাষায়, ব্যক্তি স্বাধীন, স্বশাসিত (autonomous)। তার জীবনে কী করা উচিৎ, এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার অধিকার শুধুই তার নিজের। অন্য কোন কর্তৃপক্ষের এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার অধিকার আছে বলে স্বাধীন ব্যক্তি স্বীকার করে না।
৪) কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কী বেছে নেয়া হচ্ছে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল তার "যেকোন কিছু বেছে নেয়ার স্বাধীনতা ও সক্ষমতা" থাকা।
৫) যেহেতু স্বাধীনতার বস্তুগত প্রকাশ (material manifestation) পুঁজির মাধ্যমে ঘটে, তাই নিজের ইচ্ছে ও পছন্দ অনুযায়ী যেকোন কিছু বেছে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা থাকাটাই দিনশেষে ব্যক্তিমানবের (Human Being) কাছে মুখ্য। আর সে কী পছন্দ করবে, কোনটা বেছে নেবে তা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আর কারো অধিকার নেই এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার।
সবগুলো সামাজিক বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হল এই হিউম্যান বিয়িংয়ের জন্য উপযুক্ত বাজার, সমাজ, শক্তি ও সরকার গড়ে তোলা। যেমন অর্থনীতির উদ্দেশ্য হল অর্থনৈতিকভাবে ব্যক্তির উন্নতির ক্ষেত্র ও সুযোগগুলোকে সহজ থেকে সহজতর করার লক্ষ্যে উপযুক্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, কাঠামো সমাজ ও নেতৃত্ব প্রস্তুত করা।
প্রাসঙ্গিক ২ [৬] —
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা (যাকে একসময় ‘সুশীল সমাজ’ বলা হতো) প্রতিনিধিত্ব করে ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর গড়ে ওঠা সমাজের সম্পূর্ণ প্রত্যাখানের। কারণ সুশীল সমাজে কাজের মূল্যায়ন ইসলামের কোন বক্তব্য কিংবা বিধানের আলোকে হয় না। প্রতিটি কাজের মূল্যায়ন নির্ভর করে সম্পদ পুঞ্জিভুত করার ব্যাপারে তার কার্যকারিতার ওপর। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সবকিছুর হিসেব হয় দামের (price) ভিত্তিতে, যা বাজারই নির্ধারণ করে দেয়।
সুশীল সমাজের সমৃদ্ধি হয় উদারনৈতিক গণতন্ত্রের (Liberal Democracy) মতো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায়। কারণ এই ব্যবস্থা ‘স্বাধীনতা’র মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আর এই স্বাধীনতার অর্থ হল আল্লাহ্র আনুগত্য থেকে ‘স্বাধীনতা’। মর্ডানিস্ট এপিস্টেমোলজির (আধুনিক জ্ঞানতত্ত্ব) ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা স্বাধীনতা [৭], সাম্য [৮] আর সম্প্রীতির [৯] লিবারেল বা উদারনৈতিক আদর্শগুলো এমন দুটি মৌলিক নীতিকে অস্বীকার করে যা মুসলিম হিসেবে আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য:
1) মানুষের প্রথম পরিচয় হল সে আল্লাহ্র বান্দা, আল্লাহ্র গোলাম। কিন্তু মর্ডানিযম মানুষকে দেখে স্বনির্ভর, স্বায়ত্বশাসিত ও স্বাধীন সত্তা হিসেবে যার কোন স্রষ্টা কিংবা রব্বের প্রয়োজন নেই।
2) মানবজীবনের উদ্দেশ্য আল্লাহ্র প্রতি শর্তহীন ও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পন। কিন্তু মর্ডানিযমের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মানবজীবনের উদ্দেশ্য হল বিশ্বের ওপর মানুষের কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে আমরা বিশ্বাস করি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-তে, সেখানে মর্ডানিস্ট এপিস্টোমোলজি মানুষকে দেবতার পর্যায়ে উন্নীত করে।
যেহেতু ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদ মর্ডানিযমের এই আদর্শগুলোর বাস্তবায়ন চায়, তাই এটা বলা ভুল হবে না যে পুঁজিবাদের কালেমা হল লা ইলাহা ইলাল ইনসান (‘মানুষ’ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই)। তাই পুঁজিবাদ হল আল্লাহ্, নবীগণ ও ইব্রাহীমী ধারার ধর্মগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
প্রাসঙ্গিক ৩ [৬] —
এক অর্থে লিবারেলিযমের মূলনীতি হচ্ছে ইউটিলিটারিয়ান প্রিন্সিপাল। প্লেযার প্রিন্সিপাল।
আর লিবারেলিযমের গড হচ্ছে—ব্যক্তির দেবত্ব অর্জন।
লিবারেলিযমের জন্মের সাথে বেশ কিছু এসোটেরিক ডক্ট্রিনের কঠিন প্রভাব আছে। তবে মুসলিম হিসেবে আমাদের যে বিষয়টা মাথায় রাখা দরকার সেটা হল। লিবারেলিযম সহ এধরনের সব পরিভাষা আসলে ডাবলস্পিক। অর্থাৎ এই শব্দগুলো দিয়ে আসলে শব্দগুলোর পেছনের বাস্তবতাকে আড়াল করা হয়।
একটা ক্রুড উদাহরণ। অ্যামেরিকাতে গর্ভপাত/শিশুহত্যার সাথে জড়িত সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানের নাম হল Planned Parenthood. এরা গর্ভপাতের আইনী বৈধতার জন্য আন্দোলন করাকে নাম দেয়—Pro Choice—অবস্থান—একজন নারীর শরীরে কী করা হবে না হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার সেই নারীর থাকা উচিত।
শুনতে খুব ভালো। কিন্তু বাস্তবতা কী? একজন মহিলা বিভিন্ন লোকের সাথে যিনা করে বেড়াবে। কিন্তু প্রেগনেন্ট হয়ে গেলে কোন রকমের মোরাল অথবা আইনী অস্বস্তি ছাড়াই সে যেন এই শিশুকে হত্যা করতে পারে। আর এই হত্যাকান্ড যেন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় করা যায়। এই অবস্থান হল প্রো-কিলিং। কিন্তু তারা এর নাম দিয়েছে প্রো-চয়েস।
এভাবেই স্বাধীনতা, সাম্য, নারীবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাসহ সব টার্মগুলোর কাজ হল এই বিষাক্ত দর্শনগুলোর বাস্তবতাকে আড়াল করা।
[২] A proud record of Fighting Together for LGBTQ2 Rights
[৩] জগলুল আসাদের প্রবন্ধ ‘লিবারেলিজম’
[৫] https://youtu.be/-FDncXjH2B8
[৬] By Asif Adnan
[৭] মানুষ স্বনির্ভর, স্বাধীন এবং সম্পূর্ণভাবে স্বায়ত্ত্বশাসিত। শর্তহীনভাবে যখন ইচ্ছে, নিজের যেকোন চাহিদা ও কামনাবাসনা মেটানোর অধিকার তার আছে।
[৮] প্রতিটি মানুষের অধিকার আছে এই শয়তানী আত্ম-উপাসনায় নিমগ্ন হবার।
[৯] সবার উচিৎ অপরের স্বাধীনতা বাস্তবায়নের এই অধিকারকে শ্রদ্ধা করা