১.

শীতের বিকেল। শর্ষেফুলের হলদে ছোঁয়ায় জেগে আছে মাঠঘাট। কোনো-কোনোটাতে শর্ষে ধরেছে। চারায়-চারায় অসংখ্য শীষ দুলছে বাতাসে। এখনো ফুল ঝরে যায়নি পুরোপুরি। সবুজ আর হলুদের মিশ্রণে জেগে উঠেছে মাঠ। অসংখ্য শর্ষেদানায় পূর্ণ একেকটি শীষ। কৃষকের মুখে হাসি ফোটাবে কদিন বাদেই। ফেটে-ফেটে পড়ছে কোনো-কোনো দানা। কৃষকের প্রয়োজন ভরপুর জমির শর্ষেদানা। কিন্তু, আল্লাহ্‌র যমিনে ইমানের চাষবাসকারী মুমিনের প্রয়োজন কেবল অল্পকিছু শর্ষেদানা—মিসকালা হাব্বাতিম মিন খারদালিম মিনাল ইমান।

অনাকাঙ্ক্ষিত কাল জাহান্নামের অগ্নিতে দগ্ধ হওয়া সর্বশেষ লোকটি ক্লান্ত। জাহান্নামের উত্তাপে গলিত-দলিত-মথিত হয়ে কাটছে জীবন। কবে মিলবে রবের ক্ষমা? কবে মিলবে মুক্তি? মাঝে-মাঝে হতাশ হয়ে যায়। আবার আশা জেগে ওঠে। যে ইমান ধরেছে হৃদয়ে, মুখে বলেছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ—নবিজি আশ্বাস দিয়েছেন সে একদিন জান্নাতে যাবে। দগ্ধ হতে-হতে লোকটি সে আশায় বুক বাঁধে।

আশা-হতাশায় একদিন রব্বে কারিম ঘোষণা দিলেন—দেখো তো কার-কার অন্তরে এক মিসকাল শর্ষেদানা পরিমাণ ইমান আছে? বের করে আনো আমার সেসব বান্দাদেরকে। দেখতে-দেখতে তার পালা এসে গেছে। তারও অন্তরে ইমান আছে; ক্ষীণতম ইমান—মিসকালা হাব্বাতিম মিন খারদালিম মিনাল ইমান। জাগতিক হিসেবে মাত্র চার গ্রাম যার ওজন।

জাহান্নাম—বহুবিধ আযাবে দগ্ধ হতে-হতে ছাই হওয়া এক যন্ত্রণাগার। লোকটিকে বের করে আনা হলো জাহান্নাম থেকে। দগ্ধ মানবছাইকে ফেলা হলো সঞ্জীবনী সুধাময় নদীতে; নহরে হায়াত। নহরে হায়াতের ছোঁয়ায় সুস্থ-সবল ও সুঠাম দেহময় হয়ে বেরিয়ে এলো লোকটি। এবার মহান রবের মুখোমুখি হবার পালা। আচারে-অনাচারে ছেয়ে ফেলা জীবনের শুদ্ধির পর ভৃত্য উপস্থিত হবে জগধিপতির সামনে।

লোকটি এই মুহূর্তে দাঁড়াবে মহান রবের সামনে। বিচারাধিপতি ডেকেছেন তাকে। একবার হাঁটছে তো পরক্ষণে হোঁচট খেয়ে পড়ছে। পেছনে তাড়া করছে আগুন। চেহারায় পড়ছে তার উত্তাপ। হেঁটে, হোঁচট খেয়ে জাহান্নামের সীমান্ত পার হয়ে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে লোকটি—‘বরকতময় আমার রব, যিনি আমাকে উদ্ধার করেছেন এই মহা আযাব থেকে।’ জাহান্নামের সীমান্ত পার হয়েই সে ভাবতে শুরু করেছে—এরচেয়ে শান্তি বুঝি কোথাও নেই। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠল—‘পৃথিবীর প্রথম মানব থেকে শেষ মানব, এই মুহূর্তে আমাকে যে প্রশান্তি মহান প্রভু দিয়েছেন, আজ অবধি তা আর কাউকেই দেননি।’

চলছে প্রভু ও ভৃত্যের রসায়ন। প্রভু তাঁর ভৃত্যকে ডেকে পাঠিয়েছেন। চলছে সে আনন্দিত মনে। জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তি মিলেছে—এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কীইবা হতে পারে? জান্নাত প্রাপ্তির মতো কোনো পুণ্য সে অর্জন করতে পারেনি। তাই সে আশাও করছে না।

লোকটি জানে না কোথায় চলেছে। শুধু জানে, তার রব তাকে যেতে বলেছেন। সুশোভিত প্রান্তর ধরে প্রফুল্ল মনে সে এগিয়ে চলেছে। পথিমধ্যে সম্মুখে পড়ল একটি সুবিশাল ছায়াদার বৃক্ষ। বৃক্ষ দেখে আলোড়িত হয়ে উঠল লোকটির চোখ। চলতি পথে একটুখানি ছায়া পেলে মন্দ হয় না।

– ‘আয় রব, আমাকে বৃক্ষটির কাছে যাওয়ার সুযোগ দিন। একটু ছায়ায় বসতে চাই। খানিকটা সুধাও পান করব’, বলে উঠল লোকটি।
– ‘বান্দা, এটা দিলে তুমি তো আরও কিছু চাইবে’, জগধিপতি জবাব দিলেন।
– ‘না ইয়া রব, আর কিছু চাইব না। এই নিন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি’, লোকটি বলল।

বড্ড অস্থির মানব। নেয়ামত দেখে সবর করতে পারছে না। প্রভু তাঁর ভৃত্যের অস্থিরতা বুঝতে পারলেন। ধৃষ্ঠতা ক্ষমা করে তাকে কাছে যাওয়ার সুযোগ দিলেন। অনুমতি পেয়ে গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিল কিছুক্ষণ। পান করল বৃক্ষসুধা।

বিশ্রাম শেষে পুনরায় যাত্রা শুরু হলো অজানার পথে, রবের নির্দেশে। পথ চলছে অদ্ভুত আনন্দে। চলতে-চলতে কি খানিকটা ক্লান্তি এসে গেলো? কিছুক্ষণ পথ চলার পর এবার পূর্বের চেয়েও সুন্দর একটি বৃক্ষ সামনে পড়ল। পূর্বের মতোই আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠল তার মন।

– ‘ইয়া মালিক, বৃক্ষটি কাছ থেকে দেখার সুযোগ করে দিন। একটু ছায়ায় জিরুব, একটু পানি পান করব। এ-ই, আর কিছু চাইব না’, আবারও আবদার করে বসল রবের দরবারে।
– ‘আদমের বেটা, তুমি না একটু আগে প্রতিশ্রুতি দিলে, আর কিছু চাইবে না? এখনই তো চেয়ে বসেছ। এবার যদি সুযোগ দিই, একটু পর তো আবার আরও কিছু আবদার করে বসবে’, পূর্বের করা প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিলেন প্রভু।

আবারও সে আর কিছু চাইবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিল। রব্বে কারিম নেয়ামতের প্রতি তার ব্যাকুলতা বুঝতে পারলেন; ক্ষমা করলেন তার ধৃষ্ঠতা। সুযোগ দিলেন বৃক্ষটির নিকটে যাওয়ার। পূর্বের ন্যায় এবারও ছায়ায় বসে জিরোনো হলো, পানি পান করা হলো। তারপর আবার পথচলা শুরু হলো।

জান্নাতের প্রবেশপথের কাছাকাছি পৌঁছতেই আরেকটি বৃক্ষ দৃষ্টিগোচর হলো। পূর্বের সকল বৃক্ষের চেয়ে মনোরম। জান্নাতের যত কাছাকাছি, বৃক্ষের সৌন্দর্যও যেন পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। পূর্বের সব প্রতিশ্রুতি ভুলে বসল মোহময় সৌন্দর্যে আচ্ছন্ন হয়ে।

– ‘প্রভু, একটু সুযোগ দিন বৃক্ষটির ছায়ায় বসে জিরোই, একটু পানি পান করি। এ-ই শেষ, আর কিছু চাইব না’, ব্যাকুল কণ্ঠে বলল সে।
– ‘তুমি কি প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেলে বান্দা? আর কিছু চাইবে না বলে ইতিমধ্যে দুইবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছ’, পূর্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন রব।
– ‘আয় রব, বলেছিলাম বটে। তবে এ-ই শেষ। আর কিছু চাইব না’, মিনতি ঝরে পড়ল লোকটির কণ্ঠে।

ব্যাকুলতা দেখে ক্ষমা করে দিলেন প্রভু, সুযোগ দেওয়া হলো তাকে। বৃক্ষের গোড়ায় গিয়ে বসতেই শুনতে পেল কথার আওয়াজ। কোত্থেকে আসছে এত কথাবার্তার আওয়াজ? আওয়াজের উৎস খুঁজে পাওয়া গেলো। জান্নাতিদের কথাবার্তার আওয়াজ আসছে। ব্যাকুল হয়ে উঠল লোকটি। আকুল চিত্তে প্রার্থনা করে বলল—‘প্রভু, আমাকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিন।’

– ‘বলো তো বান্দা, কী পেলে তোমার আবদার বন্ধ হবে?’, জিজ্ঞেস করলেন মহান রব। ‘ঠিক আছে, জান্নাতে যাও’, তারপর অনুমতি দিলেন।

লোকটি ছুটে জান্নাতের প্রবেশপথের কাছে গেল। ব্যথা, বেদনা, হতাশা ও দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো সে। জান্নাতে তার জায়গা কোথায়? মনে হচ্ছে—পুরো জান্নাত পরিপূর্ণ হয়ে গেছে মানুষে-মানুষে। সকলে বুঝে নিয়েছে যার-যার প্রাপ্য হিস্যা। তিল ধারণের ঠাঁই নেই সেখানে। বিষবেদনায় নীল হয়ে ফিরে এলো সে।

– ‘আয় মালিক, তোমার জান্নাত তো ভরে গেছে মানুষে। সকলে বুঝে নিয়েছে নিজ-নিজ ঘরবাড়ি; সেখানে আমার জায়গা কোথায়?’ বেদনার্ত অনুনয় ঝরে পড়ল কণ্ঠে।

– ‘তুমি যাও, গিয়ে ঢোকো আগে’, জবাব দিলেন প্রভু।

আশা-নিরাশায় দুলে-দুলে জান্নাতের চৌকাঠে পৌঁছল লোকটি। এবং, এবারও মনে হলো—জান্নাত পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। সেখানে তার জন্য কোনো জায়গা নেই। ফিরে এলো ব্যর্থ মনোরথে

– ‘ইয়া রব, তোমার জান্নাত মানুষে পূর্ণ হয়ে গেছে।’

– ‘তুমি যাও, গিয়ে ঢোকো আগে’, একই আদেশের পুনর্পাঠ করলেন জগধিপতি। ‘তোমার জন্য লিখে দিচ্ছি এক পৃথিবী এবং অনুরূপ আরও দশ জান্নাত’, যোগ করলেন সাথে।

লোকটি বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রব্বে কারিম তার সাথে ঠাট্টা করছেন। প্রভু যখন ভৃত্যকে নিয়ে ঠাট্টা করেন, তখন এই ভৃত্যের আর সহায় কোথায়? নির্মম ঠাট্টায় নিশ্চল হয়ে গেল, বিহ্বলতায় মুষড়ে পড়ল লোকটি। ব্যথাতুর হৃদয়ে আরজ করল—‘আপনি তো প্রভু জগধিপতি; তবু এই অসহায় আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন?’

গল্পটি এতদূর বলে ইবনে মাসউদ দন্ত বিকশিত করে হেসে ফেললেন।

– ‘কেউ বলো তো, কেন হাসলাম?’ উপস্থিত শ্রোতা ও ছাত্রদেরকে উদ্দেশ্যে করে জিজ্ঞেস করলেন সাহাবি।
– ‘আপনিই বলুন কেন হেসেছেন।’ একে-অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে জানতে চাইল উপস্থিত শ্রোতাগণ।
– ‘হেসেছি; কারণ, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই গল্প বলতে গিয়ে দন্ত বিকশিত করে হেসে ফেলেছেন’, জবাব দিলেন নবিজির জ্ঞানবর সহচর।
– ‘হাসছেন কেন ইয়া রাসুলাল্লাহ’? উপস্থিত লোকেরা জিজ্ঞেস করেছিল।
– ‘কারণ, লোকটির বলার ধরনে স্বয়ং প্রভু হেসে ফেলেছেন’, নবিজি উত্তর দেন। ‘হেসে বলেছেন, আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না বান্দা, তবে আমি যা-ইচ্ছা, করতে পারি’, কথা পূর্ণ করেন নবিজি।

২.

জান্নাতে প্রবেশের পূর্বে লোকটির আরেকটি কাজ বাকি রয়ে গেছে; তার আমলনামার হিসেব।

মহান বিচারাধিপতির সামনে সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটি। একে-একে খোলা হবে আমলনামা। প্রথমে খোলা হলো সগিরা গোনাহের নথি। পেশ করা হলো লোকটির সামনে—‘তুমি অমুক-অমুক দিন অমুক-অমুক গোনাহটি করেছিলে, তমুক দিন তমুক গোনাহটি; তাই নয় কি?’ অস্বীকার করবার কোনো জো নেই। মনে-মনে লোকটি সন্ত্রস্ত—এই বুঝি কবিরা গোনাহের নথি খোলা হলো। সন্ত্রস্ত মনেই আস্তে করে স্বীকৃতি জানাল—‘হ্যাঁ, করেছিলাম।’ রব্বে কারিমের নির্দেশে বন্ধ করে দেওয়া হলো বিচারের কাজ। বললেন— ‘যাও, প্রতিটি পাপকে পুণ্য দিয়ে বদলে দেওয়া হলো।’ আনন্দের আতিশয্যে ভেতরের সন্ত্রস্ততার কথা বলেই ফেলল লোকটি—‘ইয়া রব, অমুক-অমুক পাপ করেছিলাম, সেসব তো দেখলাম না!’ ভবিতব্য বর্ণনা করে লোকটির কথায় দন্ত বিকশিত করে হেসে ফেললেন নবিজি। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

দীর্ঘকাল জাহান্নামের শাস্তি ভোগের পর লোকটি মুক্তি পেয়েছে। কারণ, তার হৃদয়ে ছিল ইমানের ক্ষীণতম ছোঁয়া—মিসকালা হাব্বাতিম মিন খারদালিম মিনাল ইমান।

# মিসকালা হাব্বাতিম মিন খারদালিম মিনাল ইমান

(দ্র.-১ : পুরো গল্পটি সহিহ মুসলিমের কয়েকটি হাদিসকে উপজীব্য করে লেখা। জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে নেওয়া সর্বশেষ ব্যক্তির বর্ণনা নিয়ে স্বতন্ত্র অধ্যায় ও বেশকিছু অভিন্ন হাদিস রয়েছে সহিহ বুখারি ও মুসলিমে। বেশ কয়েকটি হাদিস উভয় কিতাবের বর্ণনায় হুবহু অভিন্ন। গল্পটি লেখার আগে উভয় কিতাবের হাদিসগুলো পড়লেও লেখার সময় সামনে রেখেছি সহিহ মুসলিমের কয়েকটি হাদিসকে। একাধিক বর্ণনায় উক্ত ব্যক্তির একাধিক অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। সবগুলোকে একসাথে মিলিয়ে একটি গল্প তৈরি করেছি। তবে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, কথোপকথনগুলোতে সরলতা আনলেও হাদিসের কথোপকথনের মৌলিকতা রক্ষা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।

দ্র.-২ : জাহান্নাম থেকে সর্বদা পানাহ চাওয়া জরুরি। উপরোক্ত হাদিসের ঘটনাটি সর্বশেষ জান্নাতে গমনকারী ব্যক্তির সাথে খাস। বর্ণনার আঙ্গিক দেখে কখনো যেন এই দুআ কেউ না করেন—আল্লাহ আমাকে শেষ ব্যক্তি বানান। বরং এই দুআ করা জরুরি—আল্লাহ যেন আমাকে হিসেবের মুআমালা ছাড়াই জান্নাত দান করেন।)