বড়াপু বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে এসেছে দুদিন হলো, ছোটু দাঁড়িয়ে দেখছে, আপুটা সকাল থেকে বড় বাচ্চাটাকে খাওয়ানো নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, একবার এটা রান্না করছে, আরেকবার ওটা কিনে আনছে, কিছুতেই খাবেনা। ছোটটা একটু পর পর কান্নাকাটির এপিসোড চালিয়ে যাচ্ছে। মায়ের চোখে ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই, বাকিরা দেখতে দেখতেও ক্লান্ত।
ছোটু সন্তানসম্ভবা, বাচ্চা মানুষ করার অভ্যেস এখনো হয়নি। প্রেগন্যান্সির বয়স তিন মাস পেরিয়ে চার মাসে পড়লো। ভেবেছিলো, মায়ের মত ওরও পেটের বাচ্চা নিয়ে তেমন কষ্ট হবেনা। কিন্তু সে হিসেব মেলেনি, দুটো মাস প্রতিটা দিন গুণে গুণে পার করেছে, কষ্টের দিন আর শেষ হয়না! কিছু সিম্পটম কাটছে, আবার নতুন কিছু শুরু হচ্ছে, ‘একটার পর একটা কষ্ট!’ অসীম ধৈর্যের প্রতীক এই বড়াপুটার দিকে তাকিয়ে আজকাল ও একটা কথাই ভাবছে,
“প্রতিটি নি’আমত কতখানি মূল্য দিয়ে কিনতে হয়! ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া খুব কঠিন, আর পায়ের নিচে জান্নাত ধারণ করার মূল্য একটু বেশিই কঠিন! তার জন্য অনেকটা পথ বাকি….”
মেজো বোনটা চুপচাপ, শান্ত স্বভাবের। একবার বড়াপুর বাচ্চাটাকে থামায়, আরেকবার মায়ের কাজে গিয়ে হেল্প করে। সবসময় বেশ হাসিখুশি, দেখে বোঝাই যাবেনা ভেতরে কতখানি কষ্ট। ছোটু যখন কাল মাঝরাতে পেট ব্যথায় ঘুম ভেঙে ওয়াশরুমে যাচ্ছিলো, মেজোর রুমের ডিমলাইটের আলো আর ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনেই বুঝতে পেরেছিলো, আপু তাহাজ্জুদের সিজদায় কাঁদছে। মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। মেজোর অনেক শখ ছিলো—অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চার মা হবে—কেউ হাফেজ হবে, কেউ আলেম, কেউ মুজাহিদ, মুজতাহিদ… কত স্বপ্ন তার! কে জানে, কী এক অজানা কারণে আজ পাঁচ বছর হলো ওর বাচ্চাকাচ্চা হয়না। আর দশটা শ্বশুরবাড়ির মত ওকে বেশি কথা শুনতে না হলেও এর ওর কান কথা তো না শুনে পারা যায়না, তাই মায়ের কাছেই বেশি থাকা পড়ে। কারও বাচ্চা দেখলেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই অনুভূতিটা লুকিয়ে রাখতে পারে ও।
“আচ্ছা, সবরের কষ্টটা কার বেশি? ছোটুর না মেজোর? না বড়াপুর?”
মাঝরাত্তিরের ঘুমঘুম চোখে হিসেব মেলানো পারেনি সে; আসলে আল্লাহ কাউকে নি’আমত দিয়ে পরীক্ষা করেন, কাউকে না দিয়ে, পরীক্ষার কাঠিন্য নির্ণয়ের মাপকাঠি মানুষের কাছে নেই, তবে তারতম্য অনুযায়ী ফলাফল প্রদানের আশ্বাসটুকু পূর্ণমাত্রায় আছে রাব্বে করীমের কাছে, বিশ্বাসীর জন্য এটুকুই প্রশান্তির।
ভাবনার ছেদ পড়ে গিয়েছিলো বড়াপুর ছোট ছেলে মুস’আবের কান্নার শব্দে। সুবহানাল্লাহ! আপু পারেও, ও হলে মনে হয় ফেলেটেলে চলে যেতো কোথাও। বাথরুম সেরে আর ঘুমের বিছানায় মন টানেনি। রাত তখন সোয়া তিনটে, ও অসুস্থ হলেও এখনো বাচ্চাটা দুনিয়ায় আসেনি, সারারাত কেউ ওকে জ্বালায়না, কিংবা মেজোর মত নি’আমত বঞ্চিতও ওকে করেননি আল্লাহ, জায়নামাজের জমিন তো ওর জন্যই, চোখে যখন পানি চলেই এসেছে, সঠিক জায়গায় ফেললেই হয়,
“ইয়া আল্লাহ! আমার ধৈর্য বাড়িয়ে দিন, আমার উপর আপনার পরীক্ষা সহজ করুন যাতে ধৈর্য হারিয়ে না ফেলি। মেজো আপুকে একটা সৎকর্মশীল সন্তান দান করুন…..”
ছোটবেলা থেকেই জীবন ও জগত নিয়ে এই চিন্তেভাবনার জন্যই ছোটু একটু বেখেয়ালি প্রকৃতির। এরই মধ্যে মা খাবার জন্য ডেকে গেছেন, খেয়ালই করেনি। মনে পড়তেই মায়ের রুমে ছুট। ওদের মা আরেক দিলদরদি মানুষ। বাবা মারা যাওয়ার পর দু'মেয়ে নিয়েই তার সংসার, বড় মেয়েটা দূরে থাকলেও মাকে দেখতে সুযোগ পেলেই ছুটে আসে। সংসারের দেখভাল করার পাশাপাশি মা একটু সময় সুযোগ পেলেই কারো একটি উপকার করছেন, তো কাউকে দুটো ভালো কথা বলছেন, পাড়ার আন্টিদের কোরআন পড়া শেখাচ্ছেন, কারও মেয়ের বিয়ের ঘটকালি করছেন; এ পাড়ায় তার খাতিরের লোকের তাই অভাব নেই। এই মুহূর্তে মা’র পাশে মেজোর সমবয়সী এক মেয়ে বসে আছে মনমরা হয়ে। সাথেই তার ষাটোর্ধ মা, কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন,
“আপা জানেন? মেয়েটার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে, ভালো ছেলে পাওয়া যাচ্ছেনা। প্রস্তাব যা-ও আসে, কীভাবে কীভাবে যেন শেষপর্যন্ত না হয়ে যায়। এত ভালো একটা মেয়ে, এত ভালো রেজাল্ট, অথচ ওর চিন্তায় আমার, ওর বাবার ঘুম হয়না রাতে….”
ছোটু আর নিতে পারেনা, বমিভাবটা দমকে আসে, এক টুকরো আদা খেতে হবে এক্ষণই, নয়তো বমি হয়ে যাবে। রান্নাঘরের দিকে দৌড় দেয়। আদার টুকরো মুখে নিয়ে বমিভাবটা কমে আসে আর মাথায় অবিবাহিত মেয়েটির চিন্তা-কল্পনা খেলে যায়,
“আহা! এ বাড়ির মেয়েরা কত সূকুনের মাঝে আছে, প্রত্যেকের একটা শেল্টার আছে, সমাজে পরিচয় দেয়ার মত, মনের কথা বলবার মত একটা স্বামী আছে, অথচ আমার বিয়েটাই হচ্ছেনা। আচ্ছা, আমার জন্য কি আদৌ কোন পাত্র বরাদ্দ আছে? আচ্ছা, বিয়েটা যদি না-ই হয়, কী হবে তাহলে? লোকে কী বলবে? বাবার প্রেশারটা তো বেড়েই চলছে দিনদিন….”
হয়তো তারপর মেয়েটা কেঁদে ফেলে, আবার হাত তুলে কান্নাটা আল্লাহর কাছেই সপে দেয়: রব্বানা হাবলানা- মিন আযওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যা-তিনা ক্বুররাতা আ’য়ুনিন…. ছোটুর জীবনেও এমন পরীক্ষার ছোটখাটো অভিজ্ঞতা আছে, বিয়ের আগের সময়টায় বোধহয় প্রত্যেক মেয়েকেই কমবেশি পরীক্ষা দিতে হয়। ঐ ঘাটের পানি কিছুটা খেয়েছে তাই কিছুটা হলেও আজকের মেয়েটার কষ্ট অনুভব করতে পারছে, যদিও ওর সেই পরীক্ষার তুলনায় এই মেয়েটির পরীক্ষা অনেক বেশিই কঠিন।
আচ্ছা, মেয়েটা কি এই দু’আগুলো জানে? ও কি গিয়ে শিখিয়ে দিয়ে আসবে? ও কি আপুটার পাশে গিয়ে শক্ত করে হাত ধরে বলবে—
“আপু, তাওয়াক্কাল ‘আলাল্লাহ! কে আছে আল্লাহ ছাড়া যিনি অসহায়ের ডাকে সাড়া দেন? আর রহমান তাঁর বান্দাহদের যেসব পরীক্ষা নেন, তার প্রত্যেকটির বিনিময় তিনি গুণে গুণে দেবেন, বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন, তিনি যে ভুলে যাননা।”
এইতো সেদিন ছোটু নিজেই যখন অসুস্থ হয়ে অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিলো, ওর হাজব্যান্ড মাথায় হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছিলো আর মনে করিয়ে দিয়েছিলো,
“হাশরের ময়দানে মানুষ আফসোস করবে, তাদেরকে যদি আরও কঠিন পরীক্ষা দুনিয়ায় নেয়া হতো, এমনকি গায়ের চামড়াও তুলে নেয়া হতো!”
অসহ্য ও কঠিন পরীক্ষার বিনিময় যে বড্ড সুমিষ্ট সেদিন….
“ছোটু, ভাতটা তুলে আপুদের নিয়ে খেতে বস। আমি একটু তোর আন্টির সাথে কথা বলে আসি।”
মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়। খাবারের কথায় পেট গুলিয়ে ওঠে, এ বেলা খেতে পারবে তো? মুখের রুচিটা এখনো পুরো ফিরে আসেনি। তবুও ওকে পারতে হবে, ইনশাআল্লাহ—ও যে এখন একা নয়, নিজের মাঝেই ধারণ করে চলা আরেকটি সত্তা, আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলার আরেকটি নিয়ামতের আমানতদার সে।
– জ্বি, আম্মু, আসছিইই…..