জুবাইদার চোখের সামনেই ওরা মেয়েটাকে...।

ছোট্ট ফাতিমা। মাত্র ১২ বছর বয়স।

চোখের পানি তো কবেই ফুরিয়ে গেছে। সেদিন বুঝি রক্ত অশ্রু বইছিলো চোখ থেকে।

চিৎকার করে ছেড়ে দিতে বলছিল কলিজার টুকরাটাকে। পেটের মধ্যে ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করলো কেউ।

ওরা ফাতিমাদের ঘরের ভিতরে রেখেই আগুন ধরিয়ে দিলো। হাতড়ে হাতড়ে, বুকে ভর দিয়ে ফাতিমার কাছে পৌছাল জুবা, আংগুল দিয়ে ইশারা করল কলেমা পড়ার। কথা বের হচ্ছিলোনা। বাধ্য সন্তান ফাতিমা। ওর জিহ্বা নাড়াতে দেখেই মনটা কেমন স্থির হয়ে গেলো জুবার। দেখা হবে সোনামনি। খুব শীঘ্রই।

ভাবতে ভাবতেই চোখ বুঁজে জুবাইদা।


অনেক অনেক দিন পর।

চোখ খুলেই উসমানকে দেখে একটু চমকে গেল জুবাইদা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ হয়ে।

– ফাতিমা কই? ফাতিমা? এক ঝটকায় বসেই প্রশ্ন।

আশ্বস্ত করার ভংগিতে হেসে উপরে ইশারা করলো উসমান। উপরে তাকাতেই ফাতিমার স্বচ্ছ প্রাসাদ চোখে পরলো।

উত্তর পেয়েই আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিল। শক্ত চটের বদলে পাখির পালকের নরম বিছানার স্পর্শ পেতেই আবার চমকে গেল। অভ্যস্ত হতে পারেনি আজও। পারবেই বা কীভাবে? কখনো দেখেনি আগে, শুনেওনি।

এই যে উসমান তাকে নতুন বউয়ের মত ট্রীট করে, ভালোবাসে এটাতেও চমকে চমকে ওঠে। পুরানো, বুড়ি বউকে নিয়ে কেউ এমন করে নাকি। উসমানকে বললেই আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

– কোথায় বুড়ি?

নিজের চেহারা দেখেও চমকে যায় সে। “এটা আমি? কীভাবে সম্ভব?”

উসমানকেও চিনতে পারেনা। কঠোর পরিশ্রম আর দারিদ্র্য যে চিহ্ন ফেলেছিল চেহারায়, সব গায়েব। যতবার তাকায় ওর দিকে, বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম করে হৃদপিণ্ডটা। পেটের ভিতর প্রজাপতি নেচে বেড়ায়। যেন বিয়ের পরের দিনগুলো। সেই তারুণ্য, সেই ভালোবাসা আবার ফিরে এসেছে। আরো রঙিন হয়ে।

– জুবি?
– হুম? চোখ না খুলেই উত্তর দেয় জুবাইদা।
– বের হচ্ছি। বিকেলে তৈরি হয়ে থেকো। বেড়াতে নিয়ে যাবো।

“বেড়াতে নিয়ে যাবো” জুবার প্রিয় বাক্য। উত্তর না দিয়ে হেসেই সম্মতি জানায় সে।


পানিতে কিসের ঘ্রাণ? মিষ্টি চাপা একটা স্মেল। হেয়ার স্পা নিতে নিতে ভাবছিল জুবা।

– এটা কি নরমাল পানি? কিছু মিশিয়েছো?
– মেশক মিশ্রিত ম্যাম। উত্তর দেয় অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটা। বয়স কত হবে? খুব কম।
– ভালো লাগছে না আপনার? অন্য ফ্লেভার দিবো?
– না না, খুব ভালো লাগছে আলহামদুলিল্লাহ।
– আলহামদুলিল্লাহ।
– চুল হয়ে গেছে। পেডিকিউর করে দেই?
– দাও।

চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ঘুম? আরামে? স্বস্তিতে?


ফাতিমার বাসা থেকে বের হতে হতেই বিকেল হয়ে গেলো। তিতির পাখির বারবিকিউ আর মিষ্টি ঝাঝালো পানীয় ছিল লাঞ্চে। ডেজার্টে নাম না জানা বাহারী শত ফল। ছোটবেলা থেকেই ফাতিমার গার্ডেনিং এর শখ। গরীবের ঘরে কোন শখই লালন করতে পারেনি। এখন সব শখই মিটিয়ে নিচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ। ফাতিমার শখের বাগান থেকেই আজকের সব ডেজার্ট এসেছে। খাওয়া, গল্প, হাসি তামাশায় সময় খুব সুন্দরভাবে কেটে গেল। এমন দারুণ অবসর আগে স্বপ্নেই সম্ভব ছিল ওদের জন্য।


গাড়িতে উঠতেই জুবার মনে হল, উসমানের জন্য অপেক্ষা না করে ওর কাছেই সরাসরি চলে গেলে কেমন হয়? জানাই তো আছে এসময় ওকে কোথায় পাওয়া যাবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। মাউথপিসে ইন্সট্রাকশন দিয়ে দিতেই ইউটার্ন নিয়ে নিলো গাড়ি।


দরজা নক করতেই রুমাইসা খুলে দিলো। এই মেয়েটা, এত্ত সুন্দর। মনে মনে ভাবে জুবা। বড় বড় চোখ, ঘন কালো চোখের পাপড়ি, ঠোঁটে গালে গোলাপী আভা। আর পোশাক এত রুচিশীল, যতবার দেখে মনে মনে তারিফ করে। মা শা আল্লাহ। দরজা খুলতেই রুমাইসার গায়ের ঘ্রাণ নাকে আসে। কিসের ঘ্রাণ এটা? কোন ফুলের?

মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুমাইসার দিকে। রুমাইসার দৃষ্টিতেও মুগ্ধতা। যখনই আসে তখনই এই দৃষ্টি দেখে জুবাইদা। জানে, সে রুমাইসার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। কিন্তু কোন অহংকার বা জেলাসী কাজ করেনা হৃদয়ে। কাজ করার কথাও না এখানে।

জুবা জানে, পাখির পালকের বিছানা, মেশকের পানির মত রুমাইসাও গিফট, ব্লেসিং ।

– উসমান রেডি?
– জি অল্মোস্ট। একটু বসুন। নাকি ভিতরের বেডরুমে যেয়ে বসতে পছন্দ করবেন?
– এখানেই বসি।
– আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে। ড্রেসটা কই থেকে নিলেন? খুব রুচিশীল হয়েছে মা শা আল্লাহ। একটু দাঁড়ান।

ছুটে যেয়ে একটা কারুকার্যময় একটা কাঁচের বোতল নিয়ে ফিরে আসে রুমাইসা।

– এটা আপনার জন্য।
– কী এটা?
– গতবার জিজ্ঞেস করেছিলেন সুগন্ধির কথা। এটা ইউজ করে দেখুন।

হাসি মুখে বলে রুমাইসা। চোখের দৃষ্টিতে জুবাইদাকে খুশি করার কাতরতা।

– ওহ জাযাকিল্লাহ খায়ের রুমাইসা। হাউ সুইট অফ ইউ।

কথা বলতে বলতেই উসমান বের হয়ে আসলো। তাকে দেখেই বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম করে উঠলো জুবার। এত সুন্দর মানুষ হয়? ছোটবেলায় মা রাজপুত্রের গল্প বলতো। এ যেন সেই রূপকথার রাজপুত্র।

জুবাইদাকে দেখেই ছেলেমানুষের মত খুশি হয়ে ওঠে।

– জুবি, তুমিই চলে এসছো!! এহহে শিমাঘটা রেখে আসলাম রুমে। বলে ওঠে পরক্ষণেই।
– আমি নিয়ে আসছি।

বলেই ভিতরে ছুটে যায় রুমাইসা। ফিরে এসে উসমানের মাথায় শিমাঘ পরিয়ে দেয়। গায়ে সুগন্ধি দিয়ে দেয়।

দুনিয়ায় এই দৃশ্য দেখলে নির্ঘাত খুনাখুনি বাধিয়ে দিতো জুবা। কিন্তু আজ তার বরং মজা লাগলো।

এমন ডাকসাইটে সুন্দরী, তার স্বামীকে সাজিয়ে দিচ্ছে, যেন জুবার চোখে তাকে সুন্দর লাগে। মজা তো।

নিজের মনেই ফিক করে হেসে ফেলে জুবা।

আর উসমান?

জুবা আসার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও জুবার উপর থেকে চোখ সরাতে পারেনি মুগ্ধতায়। রুমাইসার উপস্থিতি যেন মাথাতেই নেই তার। দুনিয়াতে এই হুর নিয়ে জুবাকে কত খেপিয়েছে। আর আজ তার চোখে সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত তার নিজের পুরানো স্ত্রী।


বাসা থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল জুবা। উসমান মানা করে। হাত ধরে সামনে নিয়ে আসে কিছুদূর।

একি! উসমানের বাসার সামনের বাগানটা যে বিশাল মরুভূমি হয়ে গেছে। আর সেখানে ধবধবে সাদা ঘোড়া দাঁড়িয়ে।

বুক ধুকপুক করছে জুবার। উসমানের মনে আছে?

উসমান ঘোড়ার কাছে যেয়ে হাটু গেড়ে বসে বলে,

জুবি, তুমি না উম্মুল মুমিনীন সাফিয়ার মত ঘোড়ায় উঠতে চাইতে? এই সুন্নাহটা দুনিয়াতে করতে পারি নি। আজ করবো। এসো ঘোড়ায় ওঠো, সাবধানে।

চোখে পানি চলে এসেছে জুবার। উসমানের হাটুতে ভর দিয়ে ঘোড়ায় ওঠে সে। তার প্রিয় স্বপ্ন আজ সত্যি হলো।


অবশেষে?
অবশেষে তারা সুখে শান্তিতে ঘর করতে লাগলো।
অনন্তকাল।


রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহিস সালাম উটের পাশে হাটু বাড়িয়ে বসতেন। উম্মুল মুমিনীন সাফিয়্যাহ তাঁর হাটুতে ভর দিয়ে উটের পিটে চড়তেন।

বুখারী ও মুসলিম