নারীবাদীরা যখন তাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন—তখন তারা বুঝেন যে আমাদের দেশে তাদের মুভমেন্ট সফল না হওয়ার কারণ তারা এখানে পপুলিস্ট নন, অর্থাৎ সাধারণ জনগণ তাদের ভালোভাবে নেন না। ফেমিনিস্টদের মাঝেও শ্রেণি বৈষম্য আছে। একজন এলিট ফেমিনিস্ট আর তৃণমূলের ফেমিনিস্টের মাঝেও ফারাক আছে। নারীবাদের ধারণা শুরুতে রাজনৈতিক হলেও (মূলত ভোটাধিকার) বর্তমানে থার্ড ওয়েভ ফেমিনিজম (মতান্তরে, ২০১০ এর পরে ফোর্থ ওয়েভ ফেমিনিজম) এখানে যৌন স্বাধীনতার বিষয়ও যুক্ত হয়েছে, যদিও আগের ওয়েভেও এর খন্ডাংশ ছিলো, তবে এই পর্যায়ে এসে তা বোল্ড হয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি। তো, এর-ই একটা অংশ হিসেবে হয়তো মেন্স, প্যাড ইত্যাদির যত্রতত্র ব্যবহার কিংবা বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে এসব শোভা পাচ্ছে। তবে এখানে মূল কথা হলো সেকেন্ড ওয়েভ পর্যন্ত কেবল শ্বেতাঙ্গ নারীদের নিয়েই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো—যেটা থার্ড ওয়েভে এসে সকল শ্রেণির নারীদের জন্যে ওপেন করা হয়েছে। মানে আগের ওয়েভগুলোতে ক্লাস, রেইস নিয়ে যেসব হেজিটেশান ছিলো—সব এখানে ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়েছে। যদিও সেকেন্ড ওয়েভের একোনমিক এবং প্রফেশনাল সাকসেসের উপর বেইস ধরেই থার্ড ওয়েভের আগমন হয়, কিন্তু বর্তমানেও তা অর্জিত হয় নি বলে তাদের অভিযোগ।
বাংলাদেশে কী হচ্ছে? বাংলাদেশে বামপন্থী এবং নারীবাদীরা মূলত একই কেচিকলে আটকে গিয়েছে। তাদের আল্টিমেইট ডেস্টিনেশান সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা হলেও এদের সাথে জনগণের খুব একটা কানেকশান নেই। এর প্রধানতম কারণ হলো জনগণ মনে করে এরা ইসলামবিদ্বেষী অথবা নাস্তিক গোছের কিছু একটা; বাস্তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক। আরেকটি কারণ হতে পারে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীবাদীরা তেমন সুযোগ করতে পারছে না, কারণ পুরুষরাই তাদের সেই সুযোগ দিচ্ছেন না। এখানে পুরুষ বলতে মোল্লা কিংবা আলেমসমাজকে বুঝানো হচ্ছে না। তাদেরই লেভেলের "এস্কর্ট ক্লাস" পুরুষদের বোঝানো হচ্ছে। স্যালারি ডেভিয়েশান কিংবা লো-স্কিল্ড জবগুলোতে মেয়েদের এন্ট্রিতে পুরুষদের ভূমিকাই বেশি; অন্তত তারা এটিই মনে করছে। সামগ্রিকভাবে, তাদের আন্দোলন আর সফল হচ্ছে না। সুতরাং, “আমার শরীর, আমি যাকে খুশি দেবো” ধরণের গালভরা বুলি শাহবাগ থেকে শুরু হয়ে প্রেসক্লাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাকিদের মধ্যে আর রেজোনেট করছে না।
নারীবাদের একটা ঝাপটা আমাদের মুসলিম কমিউনিটিতেও চলে এসেছে। এখানে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু অবশ্য শ্বাশুড়ি এবং ননদ + স্বামী। থার্ড ওয়েভ ফেমিনিজম + হিন্দি সিরিয়াল + হাদিসের নিজেই তাহকিক করা; সব মিলিয়ে মিক্সচার হলো এই মুসলিম সমাজের নারীবাদ তথা ফেমিনিজম। এখানে, কেবল “হক” কে ভিত্তি ধরে “আমার যতটুকু কাজ কেবল ততটুকুই করবো”—এমন একটি স্বার্থবাদী প্রজন্ম গড়ে উঠছে। ফলে, একজন স্ত্রী বলছেন বাসায় কোনো কাজে তিনি বাধ্য নন। এই ব্যাপারটা লজিক্যাল হলেও “ইহসান” করে বাড়ির কাজে সাহায্য করার চল আস্তে আস্তে অনেক পরিবারে উঠে যাচ্ছে। হ্যাঁ! এখানে তথাকথিত দ্বীনি পরিবারের কথাই বলা হচ্ছে। বদমেজাজী স্বামী + অসৎ শ্বাশুড়ির কম্বো সব ফ্যামিলিতেই বাধ্যতামূলক এপ্লাই করার ফল হচ্ছে এটি, যদিও সর্বক্ষেত্রে তা সঠিক নয়। একজন স্ত্রীর উপর সবচেয়ে বেশি হক তাঁর স্বামীর, অন্যদিকে একজন সন্তানের প্রতি তাঁর সবচেয়ে বেশি হক তাঁর মায়ের। অর্থাৎ, এখানে শুরুটা হচ্ছে মা থাকে। হায়ারার্কি ফলো করলে “মা” কে উপরে রাখা লাগছেই। মাঝে স্বামী (পুত্রসন্তান) এবং এর পরে আসছে স্ত্রী। এই একই রুলিং আজকের স্ত্রী যখন একদিন শ্বাশুড়ি হবে সেক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
এখানে বুঝতে হবে, মায়ের হক বেশি বলে তিনি কোনো শরীয়ত বিরোধী কাজের আহ্বান করলেও তাতে সাড়া দিতে হবে এমনটি কিন্তু নয়। বরং, মায়ের দেখভাল করে স্ত্রীকেও গুরুত্ব দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সাম্য মানে হলো এখানে একের জন্যে অন্যের হক মেরে দেওয়ার প্রবণতা থাকা যাবে না। আপনার মা আপনাকে শিরক করতে বললেও তাঁকে বুঝাতে হবে শান্তভাবে, মায়ের উপরেও আল্লাহর হক আছে। সেই আল্লাহ শিরকের গুনাহ ক্ষমা করবেন না। এখানে দেখুন, মায়ের আগে আল্লাহকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে, এখানে মাকে আপনি ছেড়ে চলে যাবেন অন্য কোথাও। এখানে প্লেইস, টাইম এন্ড রিজনিং বুঝা লাগবে।
আমাদের সাহাবীদের অনেকের মা ছিলো, স্ত্রীও ছিলো। তাঁদের জীবনাচরণ দেখলেই তা পরিষ্কার হবে। একথা আগেও বলেছি, আবারও বলছি অনেক ছেলেই আছে যারা মাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে স্ত্রীর অস্তিত্ব এক প্রকার অস্বীকার করে এবং ভাইস ভার্সা। উভয় ধরণের প্রান্তিকতাই এই সমাজে আছে। যেহেতু মায়েরা ফেইসবুক ব্যবহার করছেন না, সেহেতু স্ত্রীদের ডার্ক সাইডগুলো আমরা দেখতে পাই না ফেইসবুকের পোস্টে। পরের প্রজন্মের বর্তমান সময়ের মেয়েরা যখন শ্বাশুড়ি হবেন, তখন হয়তো ফেইসবুকেও বউ-শ্বাশুড়ির একটি ভার্চুয়াল ওয়্যার হতে পারে (আল্লাহ হিফাজত করুন)।
একপেশে কোনো দিকেই কথা বলা উচিৎ নয়। যেমন আমি একজন পুরুষ হয়ে যেহেতু কথাগুলো লিখছি, খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেক মেয়ে (স্ত্রী) এই কথা ধরে নেবেন যে, এখানে তাদের বিপক্ষে কথা বলা হচ্ছে। এবং অনেক ছেলে (স্বামী) ধরে নেবেন যে, এখানে তাদের পক্ষে সাফাই গাইতে এখানে এসেছি। তবে সলিড কথা হলো, আপনাদের কারো মনোরঞ্জনে এখানে কথা বলা হচ্ছে না। একজন পুরুষ হিসেবে আপনাকে যেমন মায়ের মর্যাদাও দিতে হবে, স্ত্রীর হকও আদায় করা লাগবে। একজন নারী হিসেবে এটাও আপনাকে মনে রাখা লাগবে যে, আপনি একটি সংসারে এসেছেন। সুতরাং, অফিসের “জব রেস্পনসিবিলিটির” মতো এই কাজ আপনার না, এই কাজ তোমার—এভাবে বিভাজন না করে ইহসান করুন। জীবন সহজ হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুন।