কয়েকদিন আগে মাগরিবের পর একটু বের হয়েছি, আচমকা বৃষ্টি। শীতকালে হালকা পাতলা বৃষ্টি হলে তাও কথা ছিল, রীতিমত কুকুর বিড়াল টাইপ বৃষ্টি বলতে যা বোঝাই আরকি। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে একটা দোকানে আশ্রয় নিয়েছি। ভালোই লাগছে, শীত পড়েছে, আবার বৃষ্টিও হচ্ছে, অদ্ভুত সুন্দর। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছি। নানান কাব্য-সাহিত্য মাথার মধ্যে ঘুরছে। দশ মিনিট, বিশ মিনিট, আধ ঘন্টা...... সময় যাচ্ছে, বৃষ্টি থামছে না। একসময় খেয়াল করলাম এত সুন্দর আবহাওয়া, বৃষ্টি এসব আর ভালো লাগছে না, অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি, বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। দেখতে দেখতে এক ঘন্টার বেশি হয়ে গেল, এখনও তুমুল বেগে বৃষ্টি হচ্ছে। এবার বিরক্তি লাগা শুরু করল, কবে বাসায় ফিরতে পারব সেই চিন্তা করছি, সামনে দিয়ে যত রিকশা যাচ্ছে সবাইকে ডাক দিচ্ছি, শেষে এই বৃষ্টির মধ্যে পর্দা ছাড়া এক রিকশায় উঠে কাকভেজা হয়েই বাসায় ফিরেছি, পরিস্থিতি এমন হয়েছে যেন কোনোমতে বাসায় ফিরতে পারলেই বাঁচি।
দুনিয়ার ব্যাপারটা এমনই। এখানে আপনি সুখ-শান্তির একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেও একটা সময় আপনার কাছে একঘেয়ে মনে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইয়ারপোর্টে নেমে এক ভাই বলেছিল, তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল যদি সারাজীবন এখানেই কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু যে-ই না শুনলেন ফ্লাইট লেট কয়েক ঘন্টা, সেই সারাজীবন থাকতে চাওয়ার জায়গাটাও একটা সময় বিরক্তিকর লাগা শুরু করল।
ছোট বাচ্চা দোকানে চকলেটের বাক্স দেখে ভাবে সে যদি দোকানদার হত, তাহলে সারাদিন চকলেট খেতে থাকত। কিন্তু সেই বাচ্চাটাকে চকলেটের ফ্যাক্টরি কিনে দিলেও সে কয়েকদিন পর সেখানে থাকতে চাইবে না। একটা সময় আপনি যা যা চেয়েছিলেন, এখন তাঁর চেয়ে কয়েকগুণ পাওয়ার পরও একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করবেন, আপনার নতুন কিছু চাই, আরও ভালো কিছু, আরও দামি, আরও সুন্দর। কারণ এই দুনিয়ার কোনো কিছু এবসুলিউট পারফেক্ট না। মানুষের মনের যে সুকুন বা প্রশান্তির লিমিট, সেটাকে দুনিয়া দিয়ে শতভাগ সন্তুষ্ট করা সম্ভব না। কারণ মানুষের হৃদয়ের সত্যিকারের প্রশান্তি আল্লাহ্ রেখেছেন অন্য কোথাও, আর সেটা হলো জান্নাত। শুধুমাত্র সেখানে গিয়েই শতভাগ প্রশান্তি অর্জন করা সম্ভব।
এই দুনিয়াতেই অনেক মানুষ দেখবেন যাদের সব আছে, তাদের বিরাট আয়োজন দেখলে মনে হবে দুনিয়াতেই তারা জান্নাত বানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সেই জান্নাতেও এক সময় তাদের একঘেয়ে লাগে। একটা বই পড়েছিলাম অনেক আগে। একজন বিশাল কোটিপতি, ঘর সংসার নেই, শরীরের একটা অংশ অবশ হয়ে গেছে। সে নিজের রুমটাকে এভাবে সাজিয়েছিল যেখানে সুইচ টিপলে যা চায় তা চলে আসে। সে বলত সে নিজের রুমেই জান্নাত বানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু একসময় সে নিজের তৈরি জান্নাতেই হতাশ, বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। নিজের তৈরি জান্নাতে সে নিজেই ক্লান্ত। এবং এটা অন্যতম কারণ যে আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই, কারণ আমরা জান্নাতে প্রাসাদ না বানিয়ে দুনিয়াতে প্রাসাদ বানিয়ে বসে আছি। সত্যিকারের জান্নাতে না গিয়ে, দুনিয়াতে জান্নাত বানানোর ধান্দায় জীবনটা পার করে দিই।
খলিফা সুলায়মান ইবনু আবদুল মালিক একবার এক তাবিয়িন আলেমের সাথে ছিলেন। তিনি আলেমকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই কেন? কেন কেউ মরতে চাইনা?
আলেম উত্তর দিলেন, "ইয়া আমিরুল মুমিনীন! আমরা সবাই দুনিয়াতেই আবাদ করি, আর আখিরাতকে আবাদশূন্য ফেলি রাখি, দুনিয়া বিনির্মাণ করি আর আখিরাতকে করি ধ্বংস। সেজন্যই আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই। কারণ কেউ যা নির্মাণ করেছে সেটা ফেলে যা সে নিজের হাতে ধ্বংস করেছে সেখানে যেতে চায়না।"
যারা আবু দারদার মত জান্নাতে বাগান কিনেছে, যারা উমরের মত জান্নাতে হীরার বাড়ি কিনেছে, তারা সবসময় উদগ্রীব থাকে কবে এই দুনিয়া ছাড়বে, কবে তাদের নির্মিত প্রাসাদে যাবে, কবে আখিরাতে তাদের অর্জিত সম্পদ ভোগ করবে। বিলাল (রাঃ) যখন শেষ সময়ে তখন উনার কষ্ট দেখে উনার স্ত্রী বলে উঠলেন, আহা! কী কষ্ট আপনার! জবাবে বিলাল (রাঃ) বলেছিলেন, কিসের কষ্ট! বরং আজ তো আমার আনন্দ! একটু পরেই আমি আমার রাসূলের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি, আমার সাথীদের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছি। রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
সুতরাং পুরো দুনিয়া আমাদের অধীনে দিয়ে দেওয়া হলেও সত্যিকারের সুখ পেতে হলে আমাদের এমন কোথাও যেতেই হবে যেখানে দুনিয়ার সীমাবদ্ধতাগুলো নেই, দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, মন খারাপ নেই, রোগ বালাই নেই, যেখানে সবকিছু পারফেক্ট, এবসুলিউট পারফেক্ট। আর সেই জায়গা হলো—জান্নাত।
ইমাম আহমাদ (রহঃ) এর ছেলে একদিন জিজ্ঞেস করল, "আমরা শান্তি পাব কবে?" ইমাম আহমাদ জবাব দিলেন,
"জান্নাতে আমাদের প্রথম কদমটি রাখার পর থেকে।"