সেদিন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম—আমি আমার এই জীবনে তিনটা দশক দেখে ফেলেছি—৮০, ৯০ এবং ২০০০। প্রায় তিনটা ভিন্ন ভিন্ন দশক, ভিন্ন ভিন্ন সময়। যতই মনে মনে নিজেকে ৯০ দশকের সেই অস্থির কিশোরটা হিসেবে কল্পনা করি না কেন আর মাত্র অল্প ক’টা দিন পরেই একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ হিসেবে সবাই আমাকে কৃত্রিম/অকৃত্রিম সম্মান প্রদর্শন করবে। নামের শেষে যুক্ত হবে ভদ্দরনকি—‘সাহেব’ খেতাব।

জীবনের এতগুলো বছর কীভাবে চলে গেল সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে বাকিটা সময়ও যে এভাবেই জাস্ট ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে যাবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত। আমি নিজেকে নাম দিয়েছিলাম "মৈনিক কিশোর"। মনে মনে কিশোর যে সেই— মৈনিক কিশোর! আমার ভেতরের দুরন্ত কিশোরটাকে কী প্রাণপণ প্রচেষ্টায় এখনও প্রতিদিন সকালে অফিসের চেয়ারটাতে বেঁধে রাখতে হয় সে খবর আমি ছাড়া পৃথিবীর ৭ বিলিয়ন মানুষের কারও কাছেই নেই। কী ভয়ংকর সাধ জাগে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মতো করে এখনও হঠাৎই সবকিছু ছেঁড়েছুড়ে অজানা এক লঞ্চের ডেকে চড়ে বসতে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি কিসসু জানি না! স্রেফ যাওয়ার জন্যই যাওয়া।

বড় হচ্ছি, বুড়ো হচ্ছি। মেয়েটা ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠে তার অস্তিত্বের জানান দেয়। আর আমার দুশ্চিন্তার কপালে প্রতিদিন যুক্ত হয় নতুন আরেকটা চিন্তার ভাঁজ। নিজেকে ক্রমশঃ একটা একটা করে চাদরে মুড়িয়ে আড়াল করছি প্রাণপণ। সবার সাথে তাল মেলানোর চেষ্টায় নিজেকেই ভরে ফেলছি অন্য একটা কিছুতে। হয়ে যাচ্ছি অন্য মানুষ। আমার আমিকে খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। একেকটা মুখোশ, একেকটা চাদরে আমি ঢাকা, আবৃত পুরোদস্তুর!

মগজের পরতে পরতে নিত্যনতুন স্মৃতি; একটার ওপর একটা, তার ওপর আরেকটা। পরত জমেই যাচ্ছে এক এক করে। অথচ আমি ঠিক আগের মতই হাহাকার করি বিকেল বেলা হইহই করে ক্রিকেট খেলতে যাব বলে। লোডশেডিংয়ের রাতে পাটি পেতে ছাদের রেলিঙয়ে পা তুলে আকাশ দেখবো বলে। নতুনের প্রতি আমার ভয় চিরকালীন। ভালোবাসি পুরাতন। সবকিছু। নতুন স্মৃতিগুলোর প্রতি তাই একবুক ঘেন্না নিয়ে বেঁচে আছি। ভীষণ ঘেন্না! ভয়ানক ঘেন্না! আমার প্রতিটা নতুন স্মৃতির পরতে পরতে জমে আছে অনুভূতির দৈন্যতা, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ আর মানুষের মিথ্যে অভিনয়ের যন্ত্রণা।

একটা সময় ছিল, স্কুল থেকে ফেরা মাত্রই কোনমতে শার্টটা খুলে জুতো জোড়া শূণ্যে ছুঁড়ে ফেলে; কিশোর-রবিন-মুসায় বুঁদ হয়ে যাওয়া। তাদের সাথে বসে এক একটা রহস্য, এক একটা অ্যাডভেঞ্চারের মায়াজালে হারিয়ে যেতাম নিমিষেই। এক বৈঠকে একটা আস্ত বই গিলে ফেলে হাত কঁচলাতে কঁচলাতে মা’র কাছে যাওয়া—“আম্মু, এই মাসে আর একটা বই কিনবো কেবল। ব্যস! আর নাহ! এই শেষ। সামনে পরীক্ষার মাস তো, আর পড়তে পারবো না।”

আর এখন মনোসংযোগ ব্যাপারটা খুঁজতে টেলিস্কোপ, মাইক্রোস্কোপ উভয়েরই প্রয়োজনই পড়ে আমার। প্রমাণ? নতুন কেনা পাওয়লো কোয়েলহোর বইটাতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পঞ্চম পৃষ্ঠায় রাখা আমার বুকমার্কটা। চোখের সামনে বই খুলে নির্মম পৃথিবীটার প্রতিটা ভাঁজ থেকে নিজেকে মুক্ত করার ফন্দি আঁটতে থাকি প্রতিটা দিন, তীব্র ঘৃণা, তুলনামূলক পাওয়া না-পাওয়ার চিন্তায় ডুবে যেতে থাকি ক্রমশঃ ঝাপসা চোখে এখন স্বীকার করতেও বাঁধে না—আমার অন্তরজুড়ে বিষ, কালো কুঁচকুঁচে বিষ।

বড় হতে হতে জীবনটাই কবে শেষ হয়ে যাবে, জানিনা। আমার মনে হতে থাকে সেই বাল্যজীবনকে ঘিরে থাকি। বেঁধে রাখি। শুভ্র, লোভ- ঘৃণাহীনা কিশোর বয়সটাতেই আটকে থাকি। আমি আমার এই আজন্ম সাধের যৌবনকে ঘৃণা করি। এই যৌবন আমায় অমানুষ করে তুলেছে। নিজেকে দেখতে চাই সেই অতি সরল হাফ প্যান্ট আর ঢলঢলা টি-শার্ট পড়া ছেলেটার জায়গায়। ঝিম ধরা দুপুরে কাঁঠাল গাছের লাঠি হাতে যে নিজেকে টিপু সুলতান হিসেবে ঘোষণা দিত, বিকেল বেলার ক্রিকেট আর এক টাকার পাইপ আইস্ক্রিমেই ছিল যার এক পৃথিবী সুখ; পুরোনো বাল্বকে পরম মমতায় যে জমিয়ে রাখতো লাল রঙা হাওয়াই মিঠাই খাবে বলে।

যে জীবন সলজ্জ সরলতার, যে জীবন অকৃত্রিম আবেগের; সে জীবনে দেখতে চাই নিজেকে। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্তে………..


গ্রামের বাড়ি যাবার জন্য ছোটবেলায় আমার একটা লুকোনো লোভ ছিলো। জোনাক-লন্ঠন তৈরির লোভ। রাত হলেই সেজ চাচাকে সাথে নিয়ে স্কুল মাঠের পেছনের বাঁশ ঝাড়টাতে চলে যেতাম।

ইলেকট্রিসিটির কেরামতিহীন অজ পাড়া গাঁ-টার ঘুটঘুটে আঁধার উপেক্ষা করে শত শত সবুজ জোনাকি জ্বলছে বাঁশঝাড়ের এখানে-ওখানে-সবখানে। আমি তীব্র উত্তেজনায় হরলিক্সের কৌটা হাতে করে ছুটছি। খপ করে ২-৩ টা করে জোনাকি ধরে ফেলছি, আর পাচার করে দিচ্ছি হরলিক্সের বয়ামে। সেজ চাচা তাড়াহুড়ো করে বয়ামের মুখ লাগিয়ে ফেলছেন। ১৫-২০ মিনিটের প্রচেষ্টায় আমরা মোটামুটি মানের একটা সবুজ জোনাক-লন্ঠন তৈরি করে ফেলতাম। ফেরার সময় চিন্তিত মুখে সেজ চাচার বাণী চিরন্তনী—"জুনি হোক ধইললে হেডে বিষ করে, কইলে ত হুনবা না। কাইলগা বেয়াইন্না বুঝবা।"

"হোক পেটে বিষ। তাও ধরবো।" ঠোঁট উল্টাতাম আমি।

মশারি টানিয়ে বাবা-মায়ের সাথে শুয়ে পড়া। টেবলের উপর জোনাক-লন্ঠন। প্রবল ভয় আর মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে জোনাক-লন্ঠন দেখার সুবিধার্থে বিছানার এক পাশে শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ সারারাত জোনাকির খেলা দেখা হবে। আমার জোনাক লন্ঠন। আমার খুব নিজের কিছু সবুজ তারা।

রাত বাড়ে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ে একটা সময়। কেবল আমি ঘুমাই না। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকতে থাকে বিশ্রীভাবে। সরসর শব্দে কিছু একটা চলে যায় ঘরের ওপাশ দিয়ে। টিনের ওপর টূপ-টাপ শব্দে দু'একটা পাতা ঝড়ে পড়ে হঠাৎ হঠাৎ। নিস্তব্ধ রাতটাতে আমি টানটান চোখে তীব্র অনুভূতি নিয়ে লেপের ভেতর থেকে মাথা বের করে শুয়ে থাকি। উত্তেজনায় মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলি। যেন বেশি শ্বাস-প্রশ্বাস জোনাকিরা সহ্য করবে না। এক ভয়াবহ অপার্থিব সৌন্দর্য আমার সামনে। চোখ-অসহ্য করা সৌন্দর্য।

তীব্র ভালো লাগা এবং তীব্র অপরাধবোধ এক সাথে বাসা বাঁধে আমার ভেতর। ভালো লাগার কারণ—আমার জানা পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর বস্তুটা এ মুহূর্তে ঠিক আমার থেকে এক হাত দূরত্বে বসে আছে। আর অপরাধবোধের কারণ—এ জোনাকিগুলো আগামীকাল ভোর হতে হতেই সবাই মারা যাবে। আমার সৌন্দর্যের ক্ষুধা এরা মিটিয়েছে তাদের একজীবন দিয়ে। কত শতবার যে আমি বিড়বিড় করে সরি বলেছি সেকথা হয়তো জোনাকিরা কোনোদিন জানবেও না।

আমি সেদিন হেরে গিয়েছিলাম আমার স্বার্থপরতার কাছে। তাদের মুক্তির চাইতে আমার সৌন্দর্যপ্রীতিটাই আমার কাছে মহৎ ঠাওর হয়েছিল।

প্রতিবছর ঈদ আসে। হইহই করে গ্রামে যাওয়ার প্ল্যান হয়; আমার এখন আর তেমন একটা যাওয়া হয় না। যদি ভুল করে কখনো-সখনো চলেও যাই; রাতের বেলা আমি অতি সূক্ষ্ম অস্বস্তিতে ভুগতে থাকি। অপরাধীর চোখে এদিক-ওদিক তাকাই; কেন যেন আর আগের মতো এখন আর জোনাকি খুঁজে পাওয়া যায় না। গেলেও একটা কি দুটো। এদিক-ওদিক, ছাড়া-ছাড়া; এখানে- ওখানে। আমি প্রবল বিষণ্ণতায় গলা পর্যন্ত ডুবে থাকি। নিজেকে অপরাধী ভাবি। ভী-ষ-ণ!

হে জোনাকি… হে সুন্দর…. এই অসুন্দরের পৃথিবীতে তুমি সত্যিই বেমানান…. খুব বেশি বেমানান…