আকাশে কিছু চিল পাক খাচ্ছে বারবার! ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ।
রহমত মিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দীর্ঘ রাতের ক্লান্তি আর বিষন্নতায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে নেই। চারদিকে কেমন শান্তি শান্তি একটা ভাব। ভয়ংকর ঝড়ের শেষ কিংবা উৎসব শেষের হাহাকারের মতো চারদিক শান্ত। নিথর। সূর্যটা সবে আড়মোড়া ভাঙা শুরু করেছে। গা জুড়ানো বাতাস আর শব্দ বলতে কেবল কলাগাছের ভেলাটার গায়ে আছড়ে পড়া পানি। ছলাৎ ছলাৎ!
ক্লান্ত চোখে বাঁ দিকে দৃষ্টি মেললো রহমত। গুটিসুটি শুয়ে আছে তার আড়াই বছরের ছেলে—সবুজ মিয়া। মুখটা সামান্য হাঁ করা। নিশ্চল কিছুটা। বিদ্যুতের মতো একটা চমক খেলে গেলো রহমতের বুকজুড়ে। বুকের এপাশ থেকে ওপাশে বন্যার স্রোতের মতো ছুঁটে গেল রক্তের গভীর স্রোত। হাত বাড়ালেন ছেলেটার নাকের দিকে। নাহ! দম আছে, এখনও! রহমতের বাবা বলতেন—"গরীবের জান কই মাছর, এরা মরেও না, বাঁসেও না।" ছেলেটার পেট পিঠের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বড়সর মাথাটা আছে বলেই রক্ষে, নাহলে কোনটা পেট আর কোনটা পিঠ আলাদা করা যেত বলে মনে হয় না।
এসময়ের শান্ত-সৌম্য ঘুমটা দেখলে কে বলবে গত রাতেই এ ছেলেটা ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো? কি নিদারুণ অসহায়ত্ব নিয়ে রহমত সারারাত ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে রেখেছিল তা হয়তো কেউ কোনোদিন বুঝতে পারবে না। কেউ কোনোদিন অনুভব করতে পারবে না পিতার বুকে ক্ষুধার্ত সন্তানের ক্রন্দন ঠিক কতটা কম্পনে বুকের গভীরে অনুরণন সৃষ্টি করে; কেউ জানতে পারবে না ঠিক কতবার ছেলেটাকে গলা টিপে ক্ষুধার কারাগার থেকে মুক্তি দেবার বাসনাটা চাপা দিয়েছে রহমত।
কি যেন মনে হতেই ঝট করে মাথাটা তুলে পায়ের দিকে তাকালো রহমত। তার স্ত্রী মাজেদা শুয়ে আছে সেখানে। মুখটা রহমত মিয়ার বেগুনী শার্টে ঢাকা। শার্টের উপর ভ্যান ভ্যান করে কয়েকটা মাছি ঘুরছে চক্রাকারে। কটু একটা গন্ধ ভারী করে তুলছে চারদিক। ক্রমশঃ!
মাজেদা! আহা মাজেদা!
ষোল বছর বয়সে টুকটুকে মেয়েটা ঘরে এসেছিলো রহমতের। মাজেদার পান খাওয়া লাল ঠোঁটটা দেখে আহলাদে ডগমগ রহমত নাম দিয়েছিলো লালী। কিছুটা নাটুকে নাম। কিন্তু গোপনে এই নামে ডেকেই আরাম পেতো রহমত।
ডাক! সে কত রকমের ডাক। লালী ভাত দে। লালী গঞ্জে যাই। লালী ফান দে। লালী ও লালী তর লাগি সুরি আনসি…….
অজান্তেই বিড়বিড় করে লালীকে ডেকে ওঠে রহমত মিয়া। নিথর লালী জবাব দেয় না। দিতে পারে না। বাতাসের বিরোধিতায় মুখের ওপরের শার্টটা বার কয়েক কেঁপে ওঠে। ঈষৎ!
রহমত মিয়ার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ভেলার দীর্ঘ দুলুনি আর দুদিনের না খাওয়া শরীরটায় আর বল নেই। স্বপ্ন ঠিক কেমন হয় রহমত বুঝে উঠতে পারেনি কখনোই। সময়ই পায়নি আসলে। ফজর থেকে মাগরিব কামলা দিয়ে এক গামলা ভাত গিলেই ক্লান্ত শরীরটা জুড়িয়েছে প্রশান্তির ঘুমে। স্বপ্ন দেখার মতো স্বপ্নের সময় হয়নি কখনও। তবে ইদানিং প্রায়ই রহমত স্বপ্ন দেখে। ভাতের স্বপ্ন। রুপালি টিনের থালায় শিউলী ফুলের মতো ভাত। সাদা ভাত। সাদা ভাতের নেশা যে কত তীব্র, কত স্বাদ; তা শুধু সাদা ভাত ওয়ালারা বুঝতে পারে।
ইস ছেলেটার জন্য যদি একটু ভাত পাওয়া যেত!
হাতের উল্টো পিঠটা ছেলের কপালে ছোঁয়ালো রহমত। জ্বরে শরীর পুড়ে একাকার। কিছু একটা করতে হবে রহমতের যেভাবেই হোক।
অসহায় চোখে মাজেদার দিকে তাকায় রহমত।
- হামাক তুই একলা থু গেলি?
নিথর লালী জবাব দেয় না। দিতে পারে না। বাতাসের বিরোধিতায় মুখের ওপরের শার্টটা বার কয়েক কেঁপে ওঠে। ঈষৎ!
পঁয়ত্রিশ বছরে রহমত বন্যা দেখেছে অনেকবার। নদীর এপার ভাঙ্গলে ওপার গড়ে। সাথে ভাঙ্গে-গড়ে রহমতদের ঘর-বাড়ি-ভাগ্য-নিয়তি। এই নিয়তিকে তারা মেনে নিয়েছিল সাবলীল ভাবেই।
কত চর ঘুরেছে রহমত। কত মাটি কেটেছে, দু হাত দিয়ে মাটি নিংড়ে সোনার ফলন ফলিয়েছে এই মাটিতে। কত্ত!
কিন্তু এই মাটি আজ তার সাথে প্রতারণা করছে। এক টুকরো মাটির অভাবে আজ তার লালীকে সে কবর দিতে পারছে না। গত রাতে যখন ভেলাটা নিয়ে রওনা হয়েছিলো রহমত, গ্রামের সবাই হই হই করে উঠেছিল। মৌলবি সাহেব ফতোয়া দিলেন—পানিত ভাসায়ে দে রে রহমত। পানিত ভাসায় দে। রহমতের মন সাড়া দেয়নি কিছুতেই। তার লালীর শরীরটা মাছে খাবে, কে জানে মানুষেও খাবে হয়তো। ক্ষুধা কি জিনিস রহমত তা ভালোই জানে।
এই ক্ষুধাই গতকাল তাকে বাধ্য করেছিল ঘর ছাড়তে। বরুয়ার মানিক খবর এনেছিল ঝুনকারচরে নাকি রিলিফের মাল আসছে। প্যাকেট প্যাকেট খাবার। যে যত পারছে লুফে লুফে গুদাম ভরে নিচ্ছে। দ্বিধাগ্রস্থ রহমতকে আশ্বস্ত করলো মাজেদা।
- ভালা আসি আমি, যান আফনে।
সাঁতরে রওনা হলো রহমত। অবশ্য কষ্ট করে আর ঝুনকারচর পর্যন্ত তাকে যেতে হয়নি। এর আগেই খবর এলো মাজেদা গর্ভের বাচ্চাটাসহ মারা গেছে। অভিমান হয়েছিল রহমতের। খুব! মাজেদা মিথ্যাবাদী। সে ভালো থাকেনি। ভালো ছিলও না। এ পৃথিবী মিথ্যায় ভরা। এক পৃথিবী মিথ্যা সর্বত্র!
অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ভেসে যাচ্ছে রহমত আর সবুজ মিয়ার ভেলা। আল্লাহ পাকের এত বড় পৃথিবীতে হাত খানেক মাটি হবে না লালীর, তা কিছুতেই মানতে পারছে না রহমত। দিগন্তের সবুজ রেখাটা চোখে পড়ছে রহমত মিয়ার। ছেলেটা ওপাশ থেকে চিৎকার করে কেঁদে চলছে একমনে…
চকচকে চোখে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মোছে রহমত!
- সিল্লাইসা না, ব্যাডা! মাডি দেখা যাইতাসে। মাডি…কব্বরের মাডি।