আমার এখন নোট লেখা মোটেও উচিৎ না। কিন্তু অনেকদিন পর ফজরের পর জেগে আছি, মনের মধ্যে কিছু কথা কিলবিলও করছে, তাই লিখেই ফেলি।
আজকে ল্যাব এ অন্য ডিপার্টমেন্ট এর এক বান্ধবী দেখা করতে এসেছিল। সে বেচারি গরম থালা ধরতে গিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল পুড়িয়ে ফেলেছে। আমাকে বলল, এই হাত নিয়ে সে এখন কিচ্ছু করতে পারছে না। চুল বাঁধতে পারেনা, টুথব্রাশ ধরতে পারেনা, লেখার জন্য কলম ধরে তর্জনী আর মধ্যমার মধ্যখানে, বিশেষ কায়দায়। তখন আরেক ল্যাবমেট মনে করিয়ে দিল এই বুড়ো আঙ্গুল প্রাইমেটদের (উন্নত প্রজাতির বানরদের) অনন্য বৈশিষ্ট্য। আর একদম ঘুরিয়ে সামনে আনতে পারা – এটা কেবল মানুষই পারে। আহা! তখন চিন্তা করলাম, ছোট্ট একটা আঙুল, কখনও তাকায়ও দেখিনা, এইটার এত ফাংশন! বুড়ো আঙুলের সবচেয়ে নিচের (তৃতীয়) গিঁটটা অন্য আঙুলের চেয়ে অনেক নিচে, পাঞ্জার কাছাকাছি। এজন্য এটাকে এতখানি সামনে আনা যায়।
এইটুক একটা জিনিসেও আল্লাহ কতখানি স্পেশালিটি দিয়েছে আমাদের! সাথে সাথে আল্লাহকে একটা থ্যাঙ্কু দিতে খুব ইচ্ছে হল। তারপর আমরা জেনেটিক অসুখ নিয়ে এত পড়েছি, ছোট্ট একটুখানি ত্রুটি ছাড়া সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ হওয়াটাই যে কত বড় ব্লেসিং – এই সাবজেক্টে পড়তে না আসলে কখনো জানতাম না। তক্ষুণি সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন থেকে এই বুড়ো আঙ্গুলটা দিয়ে যা করব, সব ভাল কাজ করব। এত চমৎকার এই জিনিসটার জন্য আর কীভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি?
এই চিন্তাটা মনে আসার পর থেকে এত ভাল লাগল, এই যে একটা সুন্দর চিন্তা – শুধু এই চিন্তাটাই বলতে গেলে আমার মনমেজাজ মুহূর্তে বদলে দিল। সব কিছু ভাল্লাগছে, আপনা থেকেই মুখে একটা হাসি ফুটে আছে, আমি নিজেই টের পাচ্ছিলাম, এই ছোট্ট চেঞ্জটা যেন ল্যাবের অন্য মানুষগুলোর মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে। বুড়ো আঙ্গুলের দেনা ত শোধ করতে হবে, কী করি, একটা ব্রাশ আর ট্রে নিয়ে ল্যাবের একটা রুম পরিষ্কার করলাম। চ্যারিটি অব ইফোর্ট। তারপর ল্যাবের ভালর জন্য এমনি এমনি একটা কাজ করছি, এটা মনে করে মনের মধ্যে খুব ভাল ভাল চিন্তা আসা শুরু করল, আর কী কী করা যায় ল্যাবের জন্য। হয়ত এর কোনটাই শেষ পর্যন্ত হবেনা, কিন্তু শেষ কবে এত যত্ন নিয়ে আমার কাজের ক্ষেত্রটার কথা চিন্তা করেছি সেটাও ত মনে করতে পারিনা। অল্প কিছু সময়ের জন্য খুব ভালবাসা ত তৈরি হল জায়গাটার জন্য। সেটাই বা কম কী? পরের দিন কাজ করতে আসলে এই ফিলিংস এর ছিটেফোঁটাও যদি রয়ে যায় তখন অনেক আগ্রহ নিয়ে কাজ করব। এটা ত পুরাই বোনাস।
যাই হোক। চিন্তার এখানেই শেষ না। এই সুখী সুখী ভাবের, হাসি খুশী আচরণের, সব কিছুর শুরু কিন্তু আমার সেই হাত পোড়ানো বান্ধবীর আমার সাথে দেখা করতে আসা থেকে। তখন আমি চিন্তা করলাম, শুধু এই উদ্দেশ্যহীন মোলাকাতটা কত বড় পরিবর্তন এনে দিল, সে ত জানলও না। অনেক সময় শুধু আপনার উপস্থিতিই কত বড় কিছু করে ফেলতে পারে আপনি টেরও পাবেন না। হয়ত শুধু আপনার আন্তরিক ‘কেমন আছ’ কারো অনেক অস্থিরতা দূর করে দিতে পারে। ছোট্ট একটা হাসি হয়ত কার মনের অনেক মেঘের ইতি টানতে পারে। এজন্য নিজেকে গুটিয়ে না রেখে মানুষের কাছে মেলে ধরাটা খুব ইম্পরট্যান্ট। রাসুলুল্লাহ (স) নাকি প্রতিদিন কমপক্ষে দুইবার আবু বকর (রা) এর বাসায় দেখা করতে যেতেন।
আমার আজকে খুউউব ভাল লেগেছে। আমি অনেক মুখচোরা। আগ বাড়িয়ে যোগাযোগ করা আমার একেবারেই ধাতে সয়না। আজকের ঘটনা আমার চিন্তাগুলি বদলে দিচ্ছে। আমার এতদিনের ফিলসফি ছিল কথা বললে ভাল কথা বলব, আর না হলে এভয়েড করব। কিন্তু আমার এক কাজিন হঠাৎ এই শুক্রবার থেকে মসজিদ এ যাওয়া শুরু করেছে। আমার বোন, আমি এর আগে কয়েকবার চেষ্টা করেছি, রাজি করাতে পারিনি। আমার ভাবতে খুব ইচ্ছা করে আল্লাহ আমার বোনের মাধ্যমে ওকে মসজিদ এ যেতে আগ্রহী করে তুলেছে। কিন্তু ওদের মধ্যে যে সম্পর্ক, তার মধ্যে স্পষ্ট ইসলাম সম্পর্কে কথা বোধহয় ওরা কমই বলে। হয়ত আমাদের দেখে দেখেই ওর ইচ্ছা হয়েছে।
এইজন্যই এখন মনে হয়, আমরা যে কত শত ভাবে দাওয়াহ দিতে পারি, এত রকমের সম্ভাবনার কথা ত আমরা চিন্তাও করিনা। একদিন এক জুম্মার খুৎবায় একটা কথা বারবার বলছিল, ‘মুবারাকা আইনামা কুনত্’। Be a blessing wherever you go. তারপর উনি বেশ কিছু উদাহরণ দিলেন কীভাবে ‘মুবারাকা আইনামা কুনত্’ হওয়া যায়। ক্যাম্পাসে প্লাস্টিক ক্যান, ট্রাশ দেখলে ডাস্টবিনে ফেলে দাও। কাউকে ভারি কিছু নিয়ে হাঁটতে দেখলে সাহায্য অফার কর, কোন প্রোগ্রামে ভলান্টিয়ার হও, প্রতিবেশীর সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে তোল। এত এত উদাহরণ দিয়েছিল, মনে হচ্ছিল, দুচ্ছাই! কিছু করছিনা কেন এখনও? আমাদের মধ্যে এই ‘মুবারাকা আইনামা কুনত্’ এত জনপ্রিয় হয়ে গেছে, ছোট্ট কোন ভাল কাজ করলেও একজন আরেকজনকে বলি, আমি ‘মুবারাকা আইনামা কুনত্’ হইসি!
দেশের বাইরে ‘মুবারাকা আইনামা কুনত্’ হওয়ার একটা ভাল ইন্সপিরেশন আছে, তারা পোশাক আশাকে মুসলিমদের চট করে আলাদা করতে পারে। তখন একজন মুসলিম হিসেবে দাওয়াহ দিচ্ছি – এই ইচ্ছাটাই খুব উৎসাহ দেয়। দেশে কাজ করার ক্ষেত্র অনেক বেশি, কিন্তু আপনি যে ইসলামে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজটা করছেন – এ মেসেজটা যেতে একটু সময় লাগবে। তারপরেও, আল্লাহ বলেছেন, ‘বারাকাহ’ হও সবখানে (মুবারাকা আইনামা কুনত্) ভাল কাজ করার দায়িত্ব আপনার, ফল দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর।
রেফারেন্স: সূরা মারইয়াম, আয়াত ৩১