একবার ক্লাসে স্যার আমাদের হিউম্যান বডি কিভাবে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তার ম্যাকানিজম পড়াচ্ছিলেন।
স্যার পড়ান বেশ মজা করে, রিয়েল লাইফের মজার মজার সব উদাহরণ টেনে এনে। হিউমান বডির এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে তিনি দেখালেন একটা রাষ্ট্রের প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে। শুরু থেকে বললে রাষ্ট্রের সীমান্তে প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে কাঁটাতার দেওয়া থাকে, এরপর বর্ডার গার্ড আছে, ভেতরে আছে পুলিশ, স্থলে সেনাবাহিনী, জলে নৌবাহিনী এরকম আর অনেক কিছু।
স্যার একের পর এক দেখাচ্ছিলেন রাষ্ট্রের এই সৈন্যবাহিনীর মত মানুষের শরীরেও যে স্তরে স্তরে বিভিন্ন প্রতিরোধ সেল রয়েছে যারা আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সীমান্তের কাঁটাতারের মত মানুষের শরীরে বাইরে আছে চামড়া, শুধু তাই নয় এখানেও অনেক সেল কাজ করে যারা বিভিন্নভাবে ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসকে মেরে ফেলে। এক ধরনের সেল আছে যারা বিষাক্ত পদার্থ ছুড়ে মারে, আরেক ধরনের সেল এক ধরনের পদার্থ ব্যাকটেরিয়ার গায়ে লাগিয়ে দেয় ফলে ব্যাকটেরিয়া আর নড়াচড়া করতে পারে না, স্ট্যাচুর মত স্থির হয়ে যায়। এরপর ম্যাক্রোফেজ বলে একটা বিষয় আছে যারা ব্যাকটেরিয়াগুলোকে গিলে ফেলে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো যখন সে ব্যাকটেরিয়া গিলে বেশি সুবিধা করতে পারেনা তখন সে শরীরের অন্যান্য জায়গার প্রতিরোধ ব্যবস্থায় নিয়োজিত সেলগুলোকে সংকেত পাঠায়, ঠিক সেনাবাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট চেয়ে বার্তা পাঠানোর মত।
রিইনফোর্সমেন্ট আসার বাহন হলো রক্ত। রক্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সেল ঐ স্থানে পৌঁছে যায়। এমনকি এক ধরনের সেল আছে যারা বাইরে থেকে আসা সেলের ঐ জায়গায় ল্যান্ড করার জন্য স্থানটাকে প্রশস্ত করে দেয়। এর মধ্যে আবার B cell এন্টিবডি তৈরী করে। স্যার বুঝাচ্ছিলেন এন্টিবডি হলো অনেকটা সৈন্যদের মিসাইল নিক্ষেপের মতো। এটা অনেকটা ওয়াই আকৃতির এবং এই মিসাইল একটার পর একটা নিক্ষেপ হতেই থাকে। এনটিবডির এই ওয়াই আকৃতির হাতল গিয়ে ব্যাকটেরিয়াকে আঘাত করে আর সেই সুযোগে ম্যাক্রোফেজ করে ঐ ব্যাকটেরিয়াকে গিলে ফেলে। এভাবে সমস্ত আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া যখন মারা যায় তখন এক ধরনের সেল আছে যারা শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে আসা রিনফোর্সমেন্ট সেলকে আবার আগের জায়গার ফিরে যেতে সংকেত দেয়। একেবারে মিলিটারি সিস্টেম।
স্যার একেকটা স্তর আলোচনা করছিলেন আর আমি বারবার মনে মনে তাকবীর দিচ্ছিলাম। আল্লাহু আকবর। মানুষের শরীরে প্রায় একশো ট্রিলিয়ন সেল আছে যার এক শতাংশ সেল প্রতিরোধ ব্যবস্থায় অংশ নেই। স্যার বলছিলেন রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে তো একটা দেশকে নিরাপত্তা দিতে টাকা দিতে হয়, কিন্তু মানব শরীরের এই ট্রিলিয়ন সৈন্যবাহিনীকে কোনো টাকা দিতে হয় না। আল্লাহ আমাদের শরীরে ফ্রিতেই এদের দিয়ে দিয়েছেন।
ক্লাসে আমার পাশের বন্ধুকে বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করছিলাম এত কিছুর পরও মানুষ কিভাবে আল্লাহকে অস্বীকার করে, কি করে বলে এসব এমনি এমনি হয়েছে!! একবার এক ডাক্তার ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। উনাকে শাহাদা পাঠ করানো ইমাম জিজ্ঞেস করেছিলেন কী কারণে উনি ইসলাম গ্রহণ করছেন, উত্তরে সেই ডাক্তার বলেছিলেন, আমার শরীরের প্রতিটি সেল সাক্ষ্য দিচ্ছে ইসলাম সত্য।
একবার একজন আলেম বলছিলেন আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হওয়ার জন্য এত কিছু করার দরকার নেই, আমাদের নিজেদের শরীরের দিকে তাকালেই আমাদের সিজদায় লুটিয়ে পড়া উচিত। এক বৃদ্ধ একবার কানের সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তার বলল কানে অপারেশান করাতে হবে। অপারেশন শেষে বৃদ্ধের কাছে বিল পাঠিয়ে দেওয়া হল। বিল দেখে বৃদ্ধ কান্না শুরু করে দিল। ডাক্তারের এটা দেখে মায়া লাগল, তাই সে বলল বিল কমিয়ে দিতে সে সাহায্য করবে। বৃদ্ধ উত্তরে বলল, আমি বিল দেখে কান্না করছি না। আমি কান্না করছি কারণ সারাজীবন আমি সুস্থ ছিলাম, এই কান দিয়ে শুনে গেছি। কিন্তু আমার আল্লাহ আমাকে কোনদিন এর জন্য বিল পাঠাননি।
অথচ আমাদের কতো অভিযোগ, কতো আক্ষেপ, কতো অতৃপ্তি। আল্লাহ আমাদের যা দিয়েছেন সেটাই তো আমাদের কল্পনারও বাইরে। সারা জীবন ধরেই তো এই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় সম্ভব নয়।
"অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?" [আর-রহমান]
"যে সকল বস্তু তোমরা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকেই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী, অকৃতজ্ঞ।" [সূরা ইবরাহীমঃ ৩৪]
"তারা আল্লাহর অনুগ্রহ চিনে, এরপর অস্বীকার করে এবং তাদের অধিকাংশই অকৃতজ্ঞ।" [সূরা নাহলঃ ৮৩]
"যখন সমুদ্রে তোমাদের উপর বিপদ আসে, তখন শুধু আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা আহ্বান করে থাক তাদেরকে তোমরা বিস্মৃত হয়ে যাও। অতঃপর তিনি যখন তোমাদেরকে স্থলে ভিড়িয়ে উদ্ধার করে নেন, তখন তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও। মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।" [আল ইসরাঃ ৬৭]
"এবং আমি তা তাদের মধ্যে বিভিন্নভাবে বিতরণ করি, যাতে তারা স্মরণ করে। কিন্তু অধিকাংশ লোক অকৃতজ্ঞতা ছাড়া কিছুই করে না।" [আল ফুরকানঃ ৫০]
"মানুষ ধ্বংস হোক, সে কত অকৃতজ্ঞ!" [আবাসাঃ ১৭]
"নিশ্চয় মানুষ তার পালনকর্তার প্রতি অকৃতজ্ঞ।" [আল আদিয়াতঃ ৬]