এক
অ-নে-ক বছর পর পুরোনো এক বন্ধু নক দিলো।
– দোস্ত, দেখা কর প্লিজ।
– স্কুলে চলে আয় না তুই!
ঠিকানা দিলাম। ক্লাসের ফাঁকে দেখা করেতো তাজ্জব! কত্তোদিন পর! কত্তো চেইঞ্জ! তারপরে শুনলাম ওর ঘটনা।
এক হিন্দু মেয়ের মুসলিম হওয়ার ঘটনা। বাসায় নামাজ পড়তে না পারার কষ্টের ঘটনা। কোনো মুসলিম (!) পরিবার মেয়েটাকে বধু হিসেবে মেনে না নেয়ার ঘটনা। শেষে অনেক যুদ্ধ আর কষ্টের সীমা পেরিয়ে, মেয়েটাকে বিয়ে করে দায়িত্ব নিয়ে তাকে নামাজ আদায় করা আর রোজা পালন করার সুযোগ করে দেয়ার ঘটনা। তাহাজ্জুদ আর ফজরের নামাজে আলসে ঘুমকাতুরে ছেলেটাকে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে তোলা, আর প্রতি সপ্তাহে সুন্নাহ রোজাগুলো রাখার জন্যে উৎসাহ দেয়া, এইসব মজার ঘটনাগুলো শুনছিলাম, আর আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় হতবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ্।
ক্যারিয়ার, টাকা আর সোশ্যাল স্ট্যাটাসের ইঁদুর দৌঁড়ের ভীড়ে কিছু মানুষ এখনো হারিয়ে যায়নি, চোখটাকে খোলার চেষ্টা করছে, বিলিয়ন ডলারের চাইতে দামী ব্রেইনটাকে ব্যবহার করার ট্রাই করছে। এমনকি সবার তিক্ত-রক্তচক্ষুকে পাত্তা না দিয়ে নিজের জীবন আর জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করবার দুঃসাহস পর্যন্ত করে ফেলছে! সত্যকে খুঁজছে, সত্যি সত্যি বুঝার চেষ্টা করছে চোখ-কান-মন খুলে। সত্যকে যখন বুঝে ফেলেছে, জীবনে এপ্লাই করার ট্রাই করছে তখনই বাধে বিপত্তি।
কীরকম?
সত্যকে গ্রহণ করার পরপর নিজের পরিবার-আত্মীয়স্বজনের ঘেন্না-লাত্থি জুটে কপালে, সাথে যে কমিউনিটিটা নিজেকে সত্যের অনুসারী বলে মিথ্যা দাবী করে বেড়ায়, তারা “আল্লাহু আকবার”, “সুবহানাল্লাহ”, আর “চোখে পানি এসে গেলো”, “একটা টিস্যু হপে?” বলে দায়িত্ব এড়াতে মিনমিনিয়ে কেটে পড়ে।
জ্বী হ্যাঁ, আমাদের কথাই বলছি! মাঝেমাঝে অমুক জায়গায়, তমুক দেশের অত্যাচারিতদের নিয়ে একটু মেকি কান্না-কথা, সুযোগ পেলেই জান-প্রাণ দিয়ে হলেও তাদেরকে সাহায্য করে ফাটিয়ে ফেলার কথা বলে আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করে ফেলি। বড্ড আরাম লাগে! আসলে আত্মতুষ্টির আফীমের স্বাদই আলাদা! এক্কেবারে অহমে গিয়ে লাগে কি না!
পাশেই যে অজস্র মানুষ সাহায্য না পেয়ে অমানবিক জীবনে ডুবে হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে যে জান-প্রাণ দিয়ে কাজ করা যায়, সেটা এড়িয়ে যাই এই-সেই অজুহাতে। বেরিয়ে আসে আমার-আপনার ভালোমানুষির আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা ভন্ডামীর বীভৎস কুৎসিত চেহারাটা।
তবে, আনন্দের কথা এটাই যে এখনো কিছু “মানুষ” আছে, সত্যের সত্য অনুসারী আছে, ফলে, মানবিকতা আছে। এখনো কিছু মানুষ আছে, যারা জানে দুনিয়ার জীবনটা ফুরিয়ে যাচ্ছে, অনন্তের জীবন শুরু হতে যাচ্ছে, যার জন্যে কাজ করতে হবে। আর সেটা শুরু করতে হবে এখনই। এক্ষুণি।
আমি যেনো হাতেগোণা সেইসব দুই-একজন সত্য-মানুষের একজন হই। পুরোটা জীবনতো নষ্ট আর খারাপ ছিলাম, অধিকাংশের কাছে বেশ ভালো আর পারফেক্ট ছিলাম, সেখান থেকে যেনো সত্যে ফিরে আসি। অধিকাংশের ভীড়ে, সামাজিক অসুস্থতার জোয়ারের একজন বলে যেনো আমাকে গণনা না করা হয়। আমি যেনো নিজের ভুল স্বীকার করে সত্যে, সত্যকাজে ফিরে আসি।
এক্ষুণি।
দুই
ডাক শুনেই ঘুরলাম।
– আরে, কী অবস্থা?
ছোট্টবেলার বন্ধু। খেলার সাথী। বই পড়ার সাথী। অনেক কথার পরে বিয়ের কথা শুরু হলো।
– ওনার আগে বিয়ে হইসিলো। যট্টুক জেনেছি দ্বীনি মহিলা। একটা ছোট বাচ্চা আছে সেই ঘরের। পিতাহীন বাবুটার বাবা হবো, একজন মুসলিমাহর আর তার সন্তানের দায়িত্ব নিবো ইন শা আল্লাহ।
আনন্দে তাজ্জব হয়ে গেলাম। কিন্তু উদ্বেগটা এড়াতে পারলাম না। নষ্ট সমাজকে ভুলি কী করে? ভালো কাজে চরম প্রতিবন্ধকতা তো এই সমাজের কাছের মানুষেরাই দিবে।
– তোর আব্বু? আম্মু কী বলে? ফ্যামিলির সাপোর্ট?
– ছোট ভাই-বোনেরা শুনে অসম্ভব খুশি। বলতেসে, আমার জীবনের এটাই সবচাইতে বেস্ট ডিসিশান। আব্বু আম্মু মানতে পারতেসেন না। স্বাভাবিক। সমাজ কী বলবে? ছ্যাঃ ছ্যাঃ করবে যে!
– অলরেডি নিশ্চয়ই অনেক কথা শুনসিস?
– শুনবো না? আমি নাকি নষ্ট হয়ে গেসি! এতো পড়াশোনা করে শেষে গুয়ের মধ্যে নামসি! দূষিত রক্তের দায়িত্ব নিতেসি! অপবিত্রা নীচু জাতের মানুষদের সাথে সম্পর্ক করতেসি! হাহাহা...
– ওয়াও! আমরা সবাই তাহলে উঁচু জাত আর পবিত্র! আমাদের রক্ত শুদ্ধ রক্ত! ওয়াহ! মুসলিমদের মাঝেও জাতপাত আর হিটলারপণা! ভোল্ডেমর্টের মাডব্লাড-পিওর ব্লাডের খেলা তাইলে আমাদের ঘরেও ঢুকসে! ভালোতো! জানা ছিলো না!
– একটা হিন্দু মেয়ে কনভার্টেড হয়ে ইসলামে আসছিলো, বুঝছিস? আমাদের তাকবীর আর অভিনন্দন দেয়ার মাইনষের অভাব ছিলো না। বিয়ে করতে চাইসিলাম। ফ্যামিলি মানলোই না। “হিন্দু ছিলো আগে? ওয়াক থুঃ! আর মেয়ে পাইলি না? দুনিয়ায় মাইয়ার অভাব পড়সে? ছিহ! তোর এত্তো অধঃপতন!” মেয়েটা শেষে হিন্দু একটা ছেলেকেই বিয়ে করতে বাধ্য হয় পরিবার-সমাজের চাপে। এর দায় কে নিবে? একটা পুরুষ নাই মুসলিমদের মধ্যে। আমি-তুই সব ভেড়ার দল। একটা মেয়ে কতোটা সংগ্রাম করে ইসলামকে চিনলো, গ্রহণ করলো, আর আমরা এমনই চুলের উম্মাহ হইসি যে সেই মেয়ের পাশে দাঁড়ালাম না, দায়িত্ব নিলাম না! সামাজিক প্রভুরা যে চটে যাবেন! আসল প্রভুকে বেইল দেয়ার টাইম কই? আল্লাহু আকবার তো বলি কথায় কথায়! কাজের বেলায় “সমাজই সর্বশ্রেষ্ঠ”!
– ইয়া আল্লাহ! এই মানুষগুলা হাশরের মাঠে যখন আমাদেরকে দেখিয়ে দিবে, দায়িত্বহীনতা ধরিয়ে দিবে, তখন কই যাবো? দায়িত্ব এড়িয়ে, কার পূজা করতেসি আসলে? আরামের পূজা, নিজের খায়েশ আর সমাজের পূজা। এই আমাদের ইসলাম!
– আরে, আমরা ছেলেরা বিয়া করি বেড পার্টনারের জন্যে। চামড়া, চর্বি, গোশত খুঁজি। আর মাইয়ারা খুঁজে মোটা সার্টিফিকেটের ফাইল আর পুষ্ট ব্যাংকের ব্যালান্সশীট। মেয়ের বাপেরা যেনো কসাই! তাদের দোকানে ঝুলানো গোস্ত-চর্বির দলাগুলো কেবলই এটিএম মেশিনেরা কিনে নিতে পারে। মানুষে মানুষে আর বন্ধন হয় নাকি? দ্বীন-চরিত্র দেখে হাতে হাত রাখার ক্যালকুলেশান সত্যিই কয়জনে করে বলতো? হাত-পা, পেট-মাথা, কামতো ওই গরু-ছাগল আর কুত্তা-শুয়োরেরও আছে। ওইগুলো দিয়ে কি মানুষ হওয়া যায় ভাই?
– সেটাই। বিয়ার কথা শুনলেই মানুষের রিয়েকশান আর কথা দেখে ভড়কে যাই। বিয়ে আর বিছানা যেনো একই ব্যাপার। দায়িত্বের ভয় নাই, বন্ধনের কথা নাই, স্রষ্টার যোগ নাই। খালি টাকা, চামড়া, বিছানা আর খানার গল্প। শুনে মনে হয় বিয়ে মানেই সমাজের চোখে একটা পতিতালয় কেন্দ্রিক হোটেলের নাম!
– হোটেল নাতো কী আর! আব্বু আম্মু মানবেন না। আলাদা হয়ে যেতে হচ্ছে। আব্বুম্মুর কারণেই যারা আত্মীয় তারাও সেই কারণে অলরেডি আলাদা হয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ। আত্মার বন্ধনে যে ক’জন আত্মীয়, তাদের সাথে তথাকথিত রক্তের কোন বাঁধনই নাই। এই হাতেগোণা ক’জনই পাশে আছে।
– তো আব্বুম্মুকে দেখবে কে?
– আরে আমি আছি না? আমাকে উনারা ফেলে দিলেও আমি ফেলবো নাকি? আমিতো ভালোবাসি উনাদেরকে। আল্লাহকে ভালোবাসি। সন্তান আল্লাহর দেয়া আমানাত। সন্তানের ৬৬% অধিকারই আমাদের বাপ মায়েরা জানেন না, দিবেন কীভাবে? ডাউনলোড করে একটা বাচ্চা নামানো সোজা, ব্যাপক আনন্দের, কিন্তু সেই বাচ্চাটা যে একটা স্বাধীন সৃষ্টি, একটা বিশাল দায়িত্ব, একটা কঠিনতম আমানাত, সেটা যদি বাপ মায়েরা জানতো, বুঝতো, তাইলে ভয়ে কইলজা শুকায়ে যাইতো। সন্তানের উপরে অন্যায় আর ইসলাম বিরোধী সব ডিসিশান চাপায়ে দিয়ে দাস-দাসীর মতো ট্রীট করার দুঃসাহস দেখাতে পারতো না কেউ। আমার হক্ব আমার বাপ মা না দিয়ে আমার সাথে যে অন্যায় উনারা করসেন, কষ্ট দিসেন, সেই একই অন্যায় উনাদের অধিকার নষ্ট করে আমি দিবো না ইন শা আল্লাহ।
– সেটাই। উনারা লাথি দিলেও পাশে থাকিস। দেখাশোনা করিস ভাই। উনাদের মতো আচরণ করিস না উনাদের সাথে।
– অবশ্যই করবো। কারো ক্ষতি আমি করবো না ইন শা আল্লাহ। উনারা আমাকে এইটুকু আনসেন, আদর-স্নেহে বড় করসেন, একটা ভুলের কারণে তো আর সব মিথ্যা হয়ে যায় না রে! আমার ক্ষতিগুলোর জন্যে, আমাকে বলা অসভ্য, নোংরা কথাগুলোর জন্যে আমার দয়াময় যেনো উনাদেরকে ক্ষমা করে দেন এইজন্যেই কান্না করি, ক্ষমা চাই। একসাথে পুরো ফ্যামিলি হারানোর ব্যথা যে কী? ও আল্লাহ!
– টেনশান নিস না ভাই। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়্যাতে এইটুকু এগিয়েছিস সেই আল্লাহই উনাদের অন্তরে সৌন্দর্য ঢেলে দিবেন দেখিস। উনারাই সসম্মানে তোদের মর্যাদা দিবেন দেখিস। আর না দিলেও ক্ষতি কী? তুইতো আর কারো হক্ব নষ্ট করছিস না। উনাদের সম্মতি নিয়ে পারিবারিকভাবে আগানোর সবটুকু ট্রাই করেছিস, উনাদের সম্মান দিতে চেয়েছিস, উম্মাহর জন্যে একটিভ কিছু করতে চেয়েছিস। ধৈর্য ধর একটু ভাই! এইতো আর ক’টা দিন। তারপরেই এই লাইফ ফুরায়ে যাবে। উম্মাহর জন্যে মেকী কান্নার অভাব নাই, কাজের মানুষের অভাব। অমুক দেশের তমুক নারী-শিশুর জন্যে আমরা কান্দি, ফেইসবুকে পোস্টাই, আর জান্নাতের স্বপ্নে ঠ্যাং নাচাই, হাসি। ওইদিকে আমারই ঘরের পাশে কতো অসহায় নারী-শিশু, তাদের পাশে দাঁড়ানোর হেডাম নাই। দায়িত্ব নেয়ার চিন্তা নাই। সবাই শুধু শিশুহীন সুন্দরী যোনি-চর্বির জ্যামিতি, ছয় ডিজিটের ভারী বেতন আর দালান খুঁজে। এই ভন্ডামী-মুনাফিক্বী আর অসভ্য-অশালীনতা কি অন্তর্যামী দেখেন না? বুঝেন না? উনি কি এমনিই ছেড়ে দিবেন? উনি কি সবারই পরীক্ষা নিচ্ছেন না? উনার সন্তুষ্টি বুঝি এতোই সস্তা যে ভন্ডামো-নোংরামোর সন্ত্রাস দিয়ে তা আদায় করে ফেলা যাবে? তুই ভাবিস না। তুই আজ একা। তোর কেউ নাই জানি। কিন্তু তোর আল্লাহ আছে। আমি আছি তোর পাশে। ভাবিস নারে ভাই। সাহাবীদের কথা ভাব, তাবি’ঈদের কথা ভাব, তাদের ত্যাগের কথা ভাব। পুরো সমাজ তাদেরকে বের করে দিয়েছিলো। আমাদের রাসুলের (সা) কথা ভাব, যিনি খাদিজাকে (রা) বিয়ে করেছিলেন। যে খাদিজার (রা) আগের ঘরের সন্তান ছিলো, যে খাদিজা (রা) পরবর্তীতে চারজন অনুসরণীয়া জান্নাতী মহিলাদের একজন হয়েছিলেন। দু’য়া করিস আমিও যেনো এমন বিয়েই করতে পারি, যে বিয়েতে ভন্ডামী থাকবে না, সামাজিকতার নামে নোংরামো থাকবে না। থাকবে দায়িত্ব, থাকবে শ্রদ্ধা জড়ানো শুদ্ধতম ভালোবাসা আর থাকবে আল্লাহ-সচেতনতা।
দুই দশমিক পাঁচ
ছেলেটা বিয়ের পর প্রথম এক বছর অনেক ঝড় ঝাপটা পাড়ি দেয়। পুরো সময়টাতে আল্লাহ ছাড়া তার পাশে আর কেউ ছিলো না। সেও কাউকে পাশে চায়নি। সে জানতো, অভিভাবক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। কষ্টগুলোকে প্রার্থনাসহ জগতের বাইরে পাঠিয়ে দিতে তার জায়নামাজই যথেষ্ট ছিলো। যথাসময়ে সেই প্রার্থনার উত্তর এলো।
এখন সেই ছেলেটাকে তার বাবা-মা অসম্ভব ভালোবাসে। না, সে এর মাঝে বাবা-মায়ের সাথে কোন খারাপ আচরণ করেনি। সবসময় সে তার বাবা-মায়ের যত্ন নেয়ার চেষ্টা করেছে। অবাক করা ব্যাপার এটাই যে ছেলেটার স্ত্রীকেও বাবা-মা অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছে, এমনকি সেই বাচ্চাটাকেও। তাদেরকে না দেখলে উনাদের চোখে আজ পানি চলে আসে। এর চাইতে সুন্দর উত্তর রাব্বের পক্ষ থেকে আর কিই বা হতে পারে?
তিন
প্রথম বিয়েতে স্বামীর মুখই দেখেননি, আর দ্বিতীয়টায় আর্মি অফিসার আর শাশুড়ির অকথ্য নির্যাতনে প্রায়ই বাপের বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হতেন তিনি। ওই পক্ষের যৌতুক আর উপহার নামক খাজনার প্রতি মহাচাহিদার ফিরিস্তি না বলাই উত্তম। শেষবার যখন বাবার বাসায় আসেন তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। সন্তান জন্ম দেয়ার পর তারা একবার ফোনে খোঁজ নিয়েছিলেন। কন্যাসন্তান হয়েছে শুনে আর কথা বাড়াননি। লোকটির অনিয়ম আর অনৈতিক জীবনযাপনের বিরুদ্ধে স্ত্রীপক্ষ আদালতে যায়, খুঁটিনাটি সহ প্রমাণিত হওয়ায় ভালো পজিশানে থাকা এই আর্মি অফিসারকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই ডিভোর্সে গড়ায় ব্যাপারটা।
এরপর আত্মীয় স্বজনের অপরূপ সুন্দর চেহারা আর সামাজিক সন্ত্রাসের যাঁতাকলের পেষণ কাকে বলে তার উদাহরণসহ সংজ্ঞা আরো একবার মুখস্থ করা হলো উনার। স্বাভাবিকভাবেই নারীবাদ জন্ম নিলো ভিতরে। নিজের মেয়েকে একাই বড় করবার জিদ নিয়ে যুদ্ধে নামলেন। এই যুদ্ধ পাঁচ বছর চললো। সমাজের আজাইরা সব নিয়মকানুনকে পাত্তা না দিতে শিখে গেলেন দাঁতে দাঁত চেপে। পাঁচ বছর পর হঠাৎ করেই পরিচয় হলো সত্যের সাথে। ইসলামকে বুঝলেন। ভিতর থেকে।
সমস্যাটা হলো ইসলামের সাথে পরিচয় হবার পর। মারাত্মক মেধাবী এই নারী নারীবাদের অসারতা টের পেলেন এবং মেনে নিলেন। আত্মসমর্পণে নুইয়ে দেয়া মাথা ও হৃদয়ে অনুভব করলেন সমাজ যেটাকে রিপ্রেজেন্ট করে সেটা ইসলাম না। ইসলাম তাঁকে জানালো অত্যাচারের বিপরীতে দাঁড়ানোটা তার দায়িত্ব ছিলো। তিনি কোন অন্যায়তো করেনইনি বরং তার সাথেই অন্যায় হয়েছে, তিনিই এবিউজড হয়েছেন বারবার, যার গোঁড়ায় আছে সামাজিক সন্ত্রাসীদের পালন করতে থাকা বানোয়াট সামাজিক ধর্ম—ট্রেডিশান। প্রেম নামক জিনার সম্পর্ক এই সমাজে ঠিক ঠিক চলে, মাথা উঁচিয়েই চলে, অথচ অত্যাচারিত হতে হতে খুন হয়ে গেলেও এই সমাজে ইসলাম অনুমোদিত তালাক্ব দেয়া যাবে না! আজিবতো! তালাক্বপ্রাপ্তা হলে তুমি অস্পৃশ্যা, আর সেই তালাক্বপ্রাপ্তার সন্তান থাকলেতো একদম শেষ! এরপর ঘৃণা আর অত্যাচারের ষোলকলা পূর্ণ করাটা একনিষ্ঠ সমাজ পূজারী আত্মীয় স্বজনদের ধর্মীয় দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে যায়। সমাজের বাদবাকি অংশের কথা নাহয় হিসেবেই গুণলাম না।
অথচ নারীর ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান মোটেও এমন নয়। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর তাঁর সাহাবীরা তাদের সারাজীবনে নারীমর্যাদার অজস্র উদাহরণ প্রতিষ্ঠিত করে গেলেও তার প্রচলন আর চর্চার জীবনমুখী শিক্ষা এই তের পার্বনের অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশে ঠাঁই পায় না। সত্যশিক্ষা মেলে না। জীবনের বাঁকে বাঁকে অত্যাচারিতাদের তাই নারীবাদের সংকীর্ণতার নোংরা কানাগলিতে মুক্তির চাবি খুঁজে মরতে হয়। ইসলামের খোলস লেগে থাকে কেবল পোশাক আর বাহ্যিকতায়। আচার-অর্চনায়। টাকার লোভ আর ফাঁদে। প্রাণহীন। ভালোবাসাহীন। মৃত, গলিত হয়ে। হৃদয়ে, কাজে ইসলামকে, এর ভালোবাসাময় বার্তাকে লালন করবে, করতে চায়, এমন প্রাণীদেরকে প্র্যাক্টিক্যালি সংখ্যালঘু বলা হয়। তবুও আলহামদুলিল্লাহ। অন্তত জানাতো হলো ইসলামকে!
নিজের সত্তাকে সঁপে দেয়া হলো অবশেষে।
সত্যে।
পাঁচ বছর পর হেরে গেলেন। মোহাম্মদ তোয়াহা আকবর নামের আরেকটা লোকের সাথে বিয়ে হলো। সেই বিয়ে নিয়ে সামাজিক জীবেরা মহাভারতের কুরুক্ষেত্র দ্বিতীয়বার মঞ্চস্থ করলেন। কে জানে এবারে উনার কপালে কী জুটেছে? সময়ই বলে দেবে।
মানুষগুলোর জন্যে দুয়া করি, ঘৃণা না। আপনার-আমার ঘেন্নায় তাদের কিচ্ছুটা ক্ষতি হয় না, হবে না। ক্ষতিটা আপনার। আমার। নিজের মা-বোনের ক্ষতিতে, মানুষের কষ্টে, উম্মাহর অপমানে যদি কান্নার বদলে ঘেন্না আসে, অপমান করবার জন্যে খোঁড়াযুক্তির স্পৃহা আর অসুরতা ভর করে হৃদয়ে, তখন সেই হৃদয়টা কি মানুষের নাকি অন্য কারো সেই প্রশ্নটা নিজেকে একবার করা যেতেই পারে।
ভালো থাকুক আমার মায়েরা। বোনেরা। পরিবার নিয়ে হোক কিংবা একা। বিশ্বাস করুন পুরো সমাজ আপনাকে ঘেন্না করলেও আপনার স্রষ্টা, আপনার প্রতিপালক আপনাকে কক্ষণো ফেলে দেবেন না। তাঁর দিকে ফিরে আসুন সন্তুষ্ট হয়ে। ইসলাম আপনারই সম্পদ, সামাজিক সন্ত্রাসের না।
নিজের সম্পদকে জানুন। ফিরিয়ে নিন জীবনে। পূর্ণভাবে।
আর আমার মতো আপনার এইসব অথর্ব মেরুদন্ডহীন মুসলিম ভাইদের মাফ করে দিন। মন থেকে।
প্লিজ।
Wednesday, June 6, 2018
2:19 AM