প্রবাসী বাংলাদেশীরা বিভিন্ন উপলক্ষে বাঙ্গালি সংস্কৃতিকে বিদেশী ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পরিচিত করানোর জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজিত তেমনি একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করার জন্য আয়োজক যখন আমাকে ফোন করে বলল, “ভাবী, আপনার মেয়েকে গান গাওয়ার জন্য দেন, আমার মেয়েও যাবে”। আমরা ভাবলাম ‘ছোট মানুষ (৫ বছর), অন্য বাচ্চারাও যখন যাচ্ছে, যাক না’। তাছাড়া, আমি জানতে চেয়েছিলাম ‘আয়োজক ভাইয়ের’ কাছে বাচ্চারা কি গান গাইবে? উনি বলেছিলেন, “এসো হে বৈশাখ, আমার সোনার বাংলা, আমরা সবাই রাজা- টাইপের গান”। যাইহোক, রিহারসেলের দিন আমি মেয়েকে যে বাসায় রিহারসেল হবে সেখানে রেখে আসলাম এবং ৫-৬ ঘণ্টা পরে গিয়ে আবার নিয়ে আসলাম। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন হল গান শেখা?” সে বেশ খুশিই মনে হল। ইতিমধ্যে জানতে পারলাম একজন জনপ্রিয় বাংলাদেশী শিল্পীও আসছেন এই অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার জন্য। আমি যদিও তার গানের সাথে পরিচিত ছিলাম না তারপরও আয়োজকদের উৎসাহ ও উদ্দীপনার বহর দেখে বুঝতে পারলাম শিল্পীর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী।
ড্রেস রিহারসেলের কিছুদিন আগের কথা। আমি রিপোর্ট লিখছি আর আমার মেয়ে আমার পাশেই টেবিলে বসে ছবি আঁকছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। আমি হঠাৎ করে খেয়াল করলাম সে আমার অপরিচিত একটা গান গাচ্ছে। আমি বললাম, “মাগো, ভলিউমটা একটু বাড়াও, শুনি”। সে বলল, “মা, গানটা কেমন জানি, অন্য রকম। তুমি যেসব গান গাও সেইরকম না। ‘মিনা’ টাইপের ভাষা”। আমার আগ্রহ তো আরও বেড়ে গেল। তারপর সে আমাকে গানটা গেয়ে শোনাল (যতটুকু সে মনে রাখতে পেরেছে)। গানটা বুঝতে আমার সামান্য কষ্ট হচ্ছিলো (কেন সেটা একটু পর বুঝতে পারবেন), তাই ৩-৪ বার সে গানটা রিপিট করলো। মুল গানটা আপনারা সম্ভবত সবাই জানেন, আমি আমার মেয়ের ভার্সনটা লিখছি, “নানটুঘোটকের কথা শুইন্যা, অল্প বয়সে করলাম বিয়া, মোরগ-বিড়াল বলল সবাই নো টেনশন নো চিন্তা……. আগুনেরই গোলা”। বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে ওঠার পর আমি তাকে প্রশ্ন করলাম,“ তুমি কি মা বুঝতে পেরেছ, এই গানটার অর্থ? তার উত্তরের সারাংশ হল—“না বোঝার কি আছে? এটা তো খুবই সোজা। একটা মেয়েকে নানটুঘোটক নামের একটা এনিম্যাল (ঘটক কি জিনিস সেটা তো সে জানে না, তাই ভেবে নিয়েছে ‘সিন্ধুঘোটকের’ মতো কোন প্রাণী) এবং ‘মোরগ আর বিড়াল’ (মুরুব্বী শব্দ তার কাছে অপরিচিত তাই সে ভেবেছে শব্দটা নিশ্চয়ই ‘মোরগ-বিড়াল’ হবে) মিলে বুদ্ধি দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য। কিন্তু এইটা একেবারেই ভালো বুদ্ধি না, কারন ১) এনিম্যালদের (!) বুদ্ধিতে মানুষের কাজ করা উচিত না, আর ২) যাকে বিয়ে করতে বলেছে সে ফায়ার বলের মতো, তার মানে ‘very dangerous, so, watch out’ ”! গান শুনে যে পরিমাণ বেকুব হয়েছিলাম গানের ব্যাখ্যা শুনে তার চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ বেকুব হলাম!
এই ঘটনার পর আমি নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী বাচ্চারা কি ধরনের গান গায়, শোনে, পছন্দ করে এবং তাদের অভিভাবকরা তাদেরকে কোন ধরনের গানকে তাদের বয়স উপযোগী মনে করেন, সেটা জানার এক ধরনের আগ্রহবোধ করলাম। কারন, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন বাচ্চারা ছড়া গান, দেশাত্তবোধক গান, ভক্তিমুলক গান, উদ্দীপনামূলক গনসঙ্গীত, শিশুসুলভ নজরুলগীতি ও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। যেহেতু আমার টিভিতে বাংলা চ্যানেল নাই আর আমি আলহামদুলিল্লাহ এইসব থেকে নিজেকে অনেকদিন দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছি, তাই এইক্ষেত্রে ইউটিউব আমার একমাত্র ভরসা। সেখানে গিয়ে আবিস্কার করলাম ‘ক্ষুদে গানরাজ’ নামে একটি অনুষ্ঠানের। মাত্র দুধ দাঁত পড়েছে, সব দাঁত এখনও উঠে নাই, এমন বয়সী বাচ্চাদের এই অনুষ্ঠানে গাওয়া কিছু গানের নমুনা দেখুন : ‘খাইরুন লো তোর লম্বা মাথার কেশ’ , ‘আমি কুলহারা কলঙ্কিনী, আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী’, ‘কার লাগিয়া গাঁথ রে সখি বকুল ফুলের মালা’, ‘নতুন প্রেমে মন মজাইয়া করেছি কি মস্ত ভুল’, ইত্যাদি। এছাড়াও ‘শিশুতোষ’ কিছু বাংলা মিউজিক ভিডিও পেলাম যেখানে ছোট ছোট বাচ্চারা জুটি বেঁধে গান গাচ্ছে, “ও বানিয়া বন্ধুরে …..মরিয়া গিয়াছে পিয়ার সোয়ামি….”। গানের ভাষা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম! আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে এই বাচ্চাগুলো কি এই গানগুলির মর্মার্থ বোঝে, নাকি আমার মেয়ের মত না বুঝেই গান গাইছে? ধরে নিচ্ছি, তারা বোঝে না কারন এই বয়সে তাদের বোঝার কথাও না। কিন্তু এইসব অনুষ্ঠানের বিচারক ও অরগানাইজাররা (যারা আমাদের দেশের নামীদামী সব শিল্পী ও সেলিব্রেটি) এবং সবার উপরে তাদের বাবা-মায়েরা কোন রুচিতে এই ধরনের কুরুচিপূর্ণ, অশালীন গান গাইতে বাচ্চাদের অনুমুতি দেয় বা উৎসাহিত করে? প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় ও বয়স আছে, এই কথাটা কি এরা জানেনা? দর্শকের সারিতে অভিভাবকদের দেখে আমি মরমে মরে গেলাম, কারন, অধিকাংশ মায়েদের মাথায় ঘোমটা আর কিছু বাবাদের মুখে দাড়ি! সুবাহান’আল্লাহ!!
Robert Browning লেখা The Pied Piper of Hamelin (হ্যামিলনের বংশীবাদক) নামে একটি গল্প পড়েছিলাম। এই কল্পকাহিনীমূলক গল্পের সেটি জার্মানির একটি গ্রাম (হ্যামিলন), যেখানে ইঁদুরের যন্ত্রণায় সবাই ব্যতিব্যস্ত। হ্যামিলনের মেয়র ঘোষণা করলো, ‘যে এই গ্রাম ইঁদুরমুক্ত করবে তাকে অনেক পুরস্কার দেয়া হবে’। একদিন সকালে এক অদ্ভুত পোশাকপরা বাঁশিওয়ালার আবির্ভাব হল। সে তার বাঁশীর সুরে মুগ্ধ করে সব ইঁদুর নিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী নদীতে ডুবিয়ে মারল। যখন সে তার পুরস্কার নিতে মেয়রের অফিসে আসলো তখন মেয়র ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা তাকে পুরস্কার তো দিলই না, বরং তাকে নিয়ে হাসি-তামাসা করলো। বাঁশিওয়ালা তাঁদের কথার কোন উত্তর না দিয়ে উঠে চলে গেল। সবাই ভাবল, ‘আপদ গেল, অনেক টাকা বেঁচে গেল’। বাঁশিওয়ালা এইবার গ্রামের কেন্দ্রতে গিয়ে আবার বাঁশীতে ফুঁ দিলো। কিন্তু এইবার তার সুরের টানে সম্মোহিত হয়ে বেরিয়ে এলো গ্রামের সকল শিশু! বাঁশিওয়ালা হাটতে শুরু করলো, তার পেছনে পেছনে সব বাচ্চা। একসময় তারা গ্রামের শেষ প্রান্তের একটি পাহাড়ের গুহায় ঢুকে গেল এবং গুহার দরজা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল। বাঁশিওয়ালার সাথে সাথে গ্রামের প্রতিটি বাচ্চাও হারিয়ে গেল, শুধু রয়ে গেল বাবা-মায়েদের সন্তান হারানোর আর্তনাদ ও বুকভাঙ্গা হাহাকার।
সেই বাঁশিওয়ালা আবার ফিরে এসেছে! অন্য রূপে, অন্য আঙ্গিকে। তার হাতে এখন মিডিয়া ও কালচারের মনভুলানো বাঁশি। অভিভাবকদের অজ্ঞতা, ব্যাক্তিগত অক্ষমতা, লোভ (অর্থ, খ্যাতি, ‘নিরাপদ’ ভবিষ্যৎ) এর কারনে তাঁদের সন্তানদের সুন্দর ও নিষ্পাপ শৈশব এই সব বাঁশিওয়ালারা ছিনিয়ে নিচ্ছে। আজ এইসব বাঁশিওয়ালাদের হাত ধরে কিছু কিছু অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের মিডিয়ার রংচঙে মোড়কে পেঁচিয়ে পণ্য বানাচ্ছে। একটা সমাজে বসবাস করলে সেখানকার কুৎসিত জিনিসগুলো থেকে বেঁচে থাকা ও নিজ সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখা খুব কষ্টকর হয়ে যায়। আমরা সবাই মিলে যদি এখনো সচেতন না হই এবং সক্রিয়ভাবে এইসব বাঁশিওয়ালার কবল থেকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচাতে ব্যর্থ হই তাহলে সেই দিন খুব দূরে নয় যেদিন হ্যামিলনের মতো আমাদের দেশের বাবা-মায়েরা শুধু সন্তান হারানোর আর্তনাদ ও বুকভাঙ্গা হাহাকার নিয়ে বাকি জীবন কাটাবে। হে আল্লাহ্, আপনি আমাদের সকলকে হেদায়েত দান করুন।
Fatwa of IslamQA.info on Music: https://islamqa.info/en/answers/5000/ruling-on-music-singing-and-dancing