কয়েক বছর আগের কথা। আমার মেয়েকে নিয়ে যেখানেই যাই, সে
শুধু চাবির রিং কিনতে চায়! প্যারিস, হল্যান্ড, কোলন, লুক্সেমবার্গ,
সুইজারল্যান্ড –– সুভ্যেনির শপে ঢুকলেই হল, চাবির রিং। প্রথমদিকে বেশি
পাত্তা দেই নাই, যখন দেখি যে ৭-৮ টা চাবির রিং হয়ে গেছে অথচ কোন চাবি নাই,
তখন ভাবলাম ঘটনা কি? অনেকভাবে জিজ্ঞেস করে যা জানতে পারলাম তা হল, তার এক
বান্ধবী চাবির রিং জমায় এবং তার প্রায় ১০০ টার উপরে চাবির রিং আছে,
সেইটা দেখে ‘অনুপ্রানিত’ হয়ে তিনিও চাবির রিং জমানো শুরু করেছেন! মাবুদ
এলাহি!!
আমি তাকে তখন বললাম, “আচ্ছা মা, চাবির রিঙের কাজ কি?” সে বলল, “চাবি রাখা”। “তোমার তো একটাও চাবি নাই, এতোগুলি রিং দিয়ে তুমি কি করবে?” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিজ্ঞের মত বলল, “চাবি লাগবে না, আমি শুধু রিং জমাবো, সারাহ এর মত”। আমি চিন্তা করলাম, এই লাইনে গেলে তো হবে না, ভিন্ন রাস্তা ধরতে হবে। তার আবার কয়েনকে নোট বানানোর অভ্যাস আছে! ঈদের সালামী, পকেট মানি ইত্যাদি অতি আগ্রহ নিয়ে জমায় (আমার কাছেই রাখে, দরকার হলে নাকি চাইবে! আল্লাহই জানে কি করবে!?)। তখন তারা স্কুলে মাত্র গুন ভাগ শিখছে। আমি তাকে কয়েকটা অংক করতে দিলাম। ১) একটা চাবির রিঙের দাম যদি ৪.৭৫ ইউরো হয় তাহলে ১০৭ টা চাবির রিং কিনতে কত ইউরো লাগবে? ২) ১ লিটার দুধের দাম যদি ০.৭৯ সেন্ট/ ১ কেজি বাসমতী চালের দাম ১.৩৫ ইউরো/ ১ কেজি চিনির দাম ০.৯৫ সেন্ট হয় তাহলে, …… ইউরো দিয়ে কত লিটার দুধ/চাল/ চিনি কেনা যাবে? আল্লাহর অশেষ রহমত, অংকগুলি শেষ করার পর সে নিজে থেকেই বলল, “মা, সারাহ শুধু শুধুই এতোগুলি ইউরো নষ্ট করেছে, চাবির রিং গুলি তো কয়েকদিন পর নষ্ট হয়ে যাবে কিন্তু এই ইউরোগুলি যদি আফ্রিকার (এর কিছুদিন আগে তাদের স্কুল থেকে তারা যে যা পারে [কাপড়, খেলনা, বই, টাকা, পিসি ইত্যাদি] কঙ্গোতে পাঠিয়েছে) বাচ্চাদেরকে পাঠিয়ে দিত, তাহলে তারা কত খুশি হতো আর আল্লাহ তাকে কত প্লাস পয়েন্ট দিতো, আর বেহেস্তের বাগানে তাকে সুন্দর একটা ট্রি-হাউজ হয়ত বানিয়ে দিতো! তাইনা, মা?” সুবাহান’আল্লাহ! আমি তাকে এটাই বুঝাতে চেয়েছিলাম!! চাবির রিং কেনা এর পর থেকে এমনি বন্ধ হয়ে গেল, আলহামদুলিল্লাহ!!!
বাচ্চাদের সাথে কথা বলার একটা খুব দরকারি বিষয় হচ্ছে জিনিশপত্র কেনাকাটার ক্ষেত্রে সংযম। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমাদের বাসার নিয়ম ছিল পেন্সিল যদি ছোট হয়ে যায় তাহলে সেটা এনে আম্মাকে দেখালে নতুন পেন্সিল দেয়া হবে, তার আগে না ! বাংলাদেশের টাকায় যেমন লেখা থাকে “চাহিবামাত্র বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে”, বর্তমান সময়ে বাবা-মা আর বাচ্চার সম্পর্ক যেন অনেকটা এমন হয়ে গেছে। আমরা বাচ্চাদের দরকারি-অদরকারি (মুখ দিয়ে বের করলেই হল) সব জিনিসই কিনে দেই। ছোট বাচ্চা (এমনকি বড় বাচ্চাও) যা কিছু তার কাছে ভাল লাগবে তাই চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অভিভাবক হিসাবে এটা আমাদের দায়িত্ব যে, একটা বাচ্চা কিছু চাইলে প্রথমে তার সাথে আলাপ করা দরকার এটা দিয়ে সে কি করবে, সে এটা কেন চাইছে, যে জিনিষটা চাইছে তার উপকারীতা ও অপকারিতাগুলো কি কি, জিনিসটি আদৌ তার প্রয়োজন আছে কিনা এবং এই টাকায় সে আর কি কি করতে পারে ? এর মাধ্যমে সন্তানের সাথে যেমন অভিভাবকের কমিউনিকেসন বাড়বে, তেমনি তারা শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসবে। যদি সময় নিয়ে সুন্দরভাবে তাদেরকে বোঝানো যায় তাহলে ওরা স্বার্থপর হবার পরিবর্তে চাহিদা এবং প্রয়োজন এর মধ্যে তফাত করতে শিখবে, অন্যের প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের ওপর অগ্রাধিকার দিতে শিখবে। চোখের বা মনের ক্ষুধার চেয়ে যে পেটের ক্ষুধা মেটানো বেশি প্রয়োজন সেটি তারা উপলব্ধি করতে পারবে, ইনশাল্লাহ।