ব্যক্তিগতভাবে আমি মানুষটা খুব অলস টাইপ। আমাকে দিয়ে কোনো কাজ আদায় করানো মনে হয় পৃথিবীর জটিলতম কাজগুলোর একটি। তবে নিজের লাভের ব্যাপারটা আমি ভালই বুঝি। লাভ-লোকসান নিয়ে যেখানে টানাটানি সেখানে আলসেমিটা কাটিয়ে উঠাই নিজের জন্য ভাল মনে করি। নিজের লাভের খাতাটা কে-ই বা শূন্যে ভরাতে চায়? তাই তো প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের রাকাতের সংখ্যা কমিয়ে কমিয়ে শুধুমাত্র ফরযে ঠেকাতে চাওয়া এই আমি যখন শুনলাম, প্রতিদিন মাত্র ১২ রাকাত সুন্না সালাতের বিনিময়ে জান্নাতে আমার জন্য একটি করে প্রাসাদ তৈরি হবে[১], ভাবনাটা তখন খুব দ্রুত পালটে ফেললাম। এত্ত বড়, তাও আবার লোকসানের ভীতি ছাড়া রিয়েল এস্টেট বিজনেসের লোভটা কি সামলানো যায়! ইসলামের প্রতি আমার আকর্ষণের অন্যতম কারণের একটি এই লাভের বিষয়টি। আলহামদুলিল্লাহ! আমি এমন একটি পারফেক্ট ধর্মের অনুসারি, যেখানে একটি মুচকি হাসিও[২] আমার লাভের খাতায় লেখা হয়ে যায়।
যারা এই লাভের ব্যাপারে সচেতন তাদের জন্য রামাদানের চেয়ে চমৎকার সময় আর হতেই পারে না! আমার উপর সিয়াম ফরয হয়েছে আজ প্রায় এক যুগ হতে চলল। লজ্জাজনক হোলেও সত্যি, এই ১২টি রামাদানের শুধুমাত্র একটিতেই আমি রামাদানের স্পিরিটের কিছুটা অন্তত অনুধাবন করতে পেরেছি। আমি খুবই দুর্বল চিত্তের। কঠিন কঠিন কথাবার্তা আমি বুঝতে পারি না। “এতগুলো নামায পড়নি! এত রোযা রাখনি! এখন তো সারা জীবন সেজদায় পরে থাকলেও লাভ হবে না”। এ জাতিয় ভয়ঙ্কর কথা আমাকে খুব ছোট করে দেয়। আমি সঙ্কুচিত হতে থাকি। আমার বুকটা আশায় ভরে উঠে যখন আমি কালো অক্ষরে লেখা আমার রবের প্রতিশ্রুতি দেখতে পাই, আমার সমস্ত গুনাহ মাফের প্রতিশ্রুতি[৩]! গুনাহ মাফের জন্য রমাদানের চেয়ে উত্তম সময় আর কি-ই বা হতে পারে[৪]!
প্রায়ই ভাবি রমাদানের স্পিরিট ধরতে আমার এত সময় লেগে গেল কেন। একটু একটু করে পাজলটা মিলাই প্রতিনিয়ত। এই অসাধারণ মাসটির কথা আমি জেনেছি, হয় খুব সাদামাটা ভাষায় কিংবা কঠিন কোনো সংজ্ঞায়। হয়ত শুনেছি রোযার মাস, সবার সাথে আমাকেও রোজা রাখতে হবে। কিংবা শুনেছি তাকওয়া অর্জনের মাস; সেটি অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। যখন প্রশ্ন করেছি, এই “তাকওয়া” জিনিশটা কি, এক শব্দে উত্তর দেয়া হয়েছে “আল্লাহ-ভীরুতা”। ভেবেছি, আল্লাহকেতো এমনিই ভয় পাই। কবরে কি হবে সে ভয়ে তো প্রাণ ওষ্ঠাগত! তবে নতুন করে ভয় পেতে হবে কেন? শেষমেশ ধরে নিয়েছি এটা নির্ঘাত খুব কঠিন কন্সেপ্ট হবে, আমার বোধবুদ্ধির বাইরে। যেহেতু আমি বুঝবই না, তাই ব্যাপারটি নিয়ে অহেতুক ঘাঁটাঘাঁটি করতে যাইনি আর।
আমাকে কেউ কখনো বলে দেয়নি এই মাসটিকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। শারীরিক কসরতের মত উপবাশের ব্যাপারটাই শিখেছি শুধু। রোযা রেখেছি কমবেশি সবটাই, নামাযও হয়েছে সময়মত; উপলব্ধির কোটাটুকু একেবারেই শূন্য রেখে। আলহামদুলিল্লাহ, গতবারের রামাদানটি কেটেছে একেবারেই অন্যরকম। প্রথমবারের মত এই মহিমান্বিত মাসটি সম্পর্কে জানার একটি তীব্র আকাঙ্খা অনুভব করলাম। এক্ষেত্রে একজন বর্ষীয়ান ব্লগারের দুটো লেখা আমাকে খুব ইন্সপায়ার করেছে। একটি লেখা থেকে জানতে পেরেছি, “রমজান … অনেক কিছু কুড়িয়ে নেয়ার সময়। একটা কাজের জন্য যখন বহুগুণ প্রতিদান পাওয়া যায়, আবশ্যিক কাজের জন্য সত্তর গুণ প্রতিদান, ঐচ্ছিক কাজের জন্য আবশ্যিক কাজের প্রতিদান, তখন "কুড়িয়ে" নেয়ার সময়ই বটে!” প্রতিদানের লোভেই হয়তোবা, এই মাসটিকে কাজে লাগানোর ভূত আমার মাথায় ঢুকে গেল। রামাদান শুরু হবার আগেই প্রথমবারের মতো আমার রামাদান স্ট্র্যাটেজি তৈরি করে ফেললাম। ওই দুটো লেখা তো অবশ্যই, সাথে আই লাভ আল্লাহ ব্লগ, মুসলিম ম্যাটারস, আরও কিছু ওয়েবসাইট এবং ওয়েবিনার আমাকে খুব সহায়তা করেছে এক্ষেত্রে।
নিজের মত করে রামাদান চেকলিস্ট তৈরি করলাম। পরিকল্পনা আঁটলাম এই মাসটিতে পুরো কুরআন অর্থসহ একবার পড়ে শেষ করবো। আল্লাহকে জানার জন্য আল্লাহ্র নেইমস অ্যান্ড অ্যাট্রিবিউটসের কোনো তুলনা হয় না। তাই গাইডেডওয়েজ.কম থেকে অর্থ এবং কুরআন হাদিসের রেফারেন্স সহ আল্লাহ্র ৯৯টি নামের সফটওয়্যারটি নিয়ে নিলাম মোবাইলে। বেছে বেছে কুরআনের অসাধারণ কিছু দুয়া ঠিক করলাম মুখস্থ করব বলে। আমার প্রোগ্রেসের ট্র্যাক রাখার জন্য এবং অভিজ্ঞতাগুলো লিখে রাখার জন্য ছোট্ট একটা রামাদান ডায়েরী বানালাম। দৈনন্দিন দু’আর এবং রামাদানের ফিকি বিষয়ের উপর চিকন সাইজের ছোট্ট দুটি পুস্তিকা জোগাড় করলাম। জোগাড় করলাম আরও টুকিটাকি কিছু জিনিশ। আমার খুব কাছের কিছু বন্ধুর সাথে এর বেশ অনেকটাই শেয়ার করলাম। এতে আমার লাভ হল, ওদের স্ট্রাগল দখে আমার নিজের ভেতর সার্বক্ষণিক একটা প্রচেষ্টা জিইয়ে রাখা।
এরই মধ্যে তাকওয়ার সবচেয়ে সুন্দর, সহজ, গুরুত্বপূর্ণ এবং মনোমুগ্ধকর অর্থটি জানলাম। জানলাম, তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহ্ এবং আমার মধ্যকার সম্পর্ক রক্ষাকারী রক্ষাকবচ। এই অর্থটির অনেক গুণের একটি হচ্ছে, এটি আল্লাহ্ এবং আল্লাহ্র বান্দার সম্পর্কের গুরুত্বটা খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরে; সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সম্পর্কটি উন্নয়নের একটি ইচ্ছা রেখে যায় হ্রিদয়ের খুব গভীরে। আলহামদুলিল্লাহ; এবারতো আমার মত যারা তাকওয়ার অর্থ নিয়ে হিমসিম খায় তাদের জন্য আমার প্রিয় বোন ফারিয়া আলম একটি সিরিজ-ই লিখছে।
সে রোযায় চাকরি থেকে ছুটি পেয়েছিলাম যদিও বা, ভার্সিটির ক্লাস চলছিলো পুরোদমে। শিডিউল ক্লাসের পাশাপাশি এক্সট্রা ক্লাস, পরীক্ষার প্রস্তুতি এসবও ছিল। এই মহাব্যস্ত সময়ে আমি আরও একবার নিয়্যাতের ক্ষমতা উপলব্ধি করলাম। চমৎকার এই সময়গুলো কেটে গেল খুউব খুউব খুব দ্রুত! শেষের দিকে আমার প্রিয় মুনা আপুর “তুমি এসেছিলে…” লেখাটি পড়ে ভেতরটা একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে উঠলো! এই সময়টা হেলায় নষ্ট করার এত হৃদয়বিদারক বর্ণনা আগে চোখে পড়েনি কখনো। “তোমার উপস্থিতির যে আনন্দ, তার চেয়ে তোমার বিদায়বেলার উতসবের আনন্দটা অনেক বেশি”, শুধু এই কথাটুকুই কি চোখদুটো ভিজিয়ে দেয় না!
নড়েচড়ে বসলাম যখন ফেইসবুকে দুএকজনের স্ট্যাটাস দেখলাম, “ঈদ তাদের জন্য নয় যারা নতুন জামাকাপড় পরে। ঈদ তাদের জন্য যারা প্রতিফল দিবসকে ভয় করে”[৫]। ছোট্ট এই কথাটির ওজন যে কি পরিমাণ কি বলবো! ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। মাথায় অন্তহীন লুপের মতো ঘুরতে লাগলো, “ঈদ কি তবে আমার জন্য নয়! ঈদ কি তবে আমার জন্য নয়!” সেবার অন্তত আমি অভাগাদের দলে পড়তে চাইনি যারা রামাদান পেলো কিন্তু গুনাহগুলি ক্ষমা করিয়ে নিতে পারলো না[৬]।
আমার অ্যাচিভমেন্ট সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ-ই অবগত। তবে, ঈদের পর নিজের অসংখ্য ত্রুটিগুলো নিজের চোখেই কি প্রকটভাবেই না ধরা পড়লো! পুরো কুরআন অর্থসহ পড়ে শেষ করার কথা ছিল যেখানে, সেখানে ২৬,২৭ জুযে আসতে না আসতেই সময় শেষ হয়ে গেল। ৯৯টি নামের ক’টা ঠিকঠাক অর্থসহ শেখা হয়েছে সেসব লজ্জাস্কর ইতিহাস নাইবা বললাম। খুব করে বুঝলাম আল্লাহ্ কেন বলেছেন “লা’আল্লাকুম তাত্তাকূন”[৭]। আফসোস হল নুমান আলী খানের ভিডিওটি আরো আগে দেখিনি বলে।
সাহাবারা নাকি ছ’মাস আগে থেকে রামাদানের প্রস্তুতি নিতেন। এই বিষয়টি আমাকে কি যে ইন্সপায়ার করেছিলো! এই ইন্সপিরেশনগুলো সব যায় কই? এই ছয় মাস আমার বেলায় এসে ছয় দিনে না ঠেকে এবার! অসাধারণ দিনগুলি আবারো আসছে। আমার এবারের স্ট্র্যাটেজি একটু অন্যরকম। বেসিক লেভেল থেকে একটু হাইয়ার লেভেলে আরোহণ বলে কথা!
প্রতিবার রামাদান এলে বাংলা-আরবি-ফারসি মেশানো একটি স্লোগান খুব শোনা যায় চারিদিকে- “আহলান সাহলান মাহে রমজান”। খুব লক্ষ্য করি এই অভিবাদনটুকু কিভাবে শুধুমাত্র পার্থিব এবং বৈষয়িক ব্যাপারের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। এই উষ্ণ অভ্যর্থনা তো হবার কথা ছিল আমাদের মনের ভিতর! রামাদান অবশ্যই নিদারুন স্ট্রাগলের মাস, যার পরিনতি ঈদের ফেস্টিভিটিতে। তবে এই ফেস্টিভিটিতো সাধারণ এন্টারটেইনমেন্টনির্ভর নয়। এ তো অনন্যসাধারণ। এ তো শুধুই তাকওয়া অর্জনের, গুনাহ ক্ষমার,অনেক অনেকগুণ সাওয়াব অর্জনের প্রতিযোগিতার ফেস্টিভিটি!
পরিশিষ্ট
১) Umm Habibah bint Abu Sufyan (radi Allahu anha) narrated that the Messenger of Allah (sal Allahu alaihi wa sallam) said: “Whoever prays twelve rakat during the day and night will have a house built for him in Paradise: four rakat before Zuhr and two after it, two rakat after Maghrib, two rakat after Isha, and two rakat before Fajr.” (Hasan Sahih hadith) [Tirmidhi]
২) Narated By ‘Aisha RA : I never saw the Prophet PBUH laughing to an extent that one could see his palate, but he always used to smile only. [Sahih Al Bukhari – Book of Good Manners And Form (Al-Adab) Volume
008, Book 073, Hadith Number 114]
৩) Allah says: “Say: O my Servants who have transgressed against their souls! Despair not of the Mercy of Allah: for Allah forgives all sins: for He is Oft-Forgiving, Most Merciful.” [Sûrah al-Zumar: 53]
৪) ‘Aa’ishah said: "I said, ‘O Messenger of Allah, if I know which night is Laylat al-Qadr, what should I say on that night?’ He said, ‘Say: Allahumma innaka ‘afuwwun tuhibb al-‘afwa fa’affu ‘anni (O Allah, You are forgiving and You love forgiveness, so forgive me)." (Hadith – al-Tirmidhi)
৫) Islam teaches Muslims how to celebrate the Eid. Even though fasting is not permitted on the Eid days, yet, the major part of the celebration is not eating or drinking – rather, it is a prayer that brings Muslims together to remember Allah’s bounties and celebrate His Glory and Greatness. That is where the saying of Umar Ibn Abdul Aziz comes from, which explains the real concept of Eid in Islam:
(ليس العيد لمن لبس الجديد إنما العيد لمن خاف يوم الوعيد)
“Eid is not for those who have worn beautiful new dresses, but the real Eid however is for those who fear the promised Day [i.e. Qeyamah
and therefore have been mindful of their duties and responsibilities]”
৬) Ka’b Ibne ‘Ujrah radhiyallahu anhu relates that the Rasoolullah sallallahu alayhi wasallam said, "Come near the pulpit," and we came near the pulpit. When he ascended the first step of the pulpit, he said, "Aameen." When he ascended the second step, he said, "Aameen." When he ascended the third step, he said, "Aameen." When he descended, we said, "O Prophet of Allah sallallahu alayhi wasallam,we have heard from you today something which we never heard before." He said, "When I ascended the first step, Jibra’eel appeared before me and said, ‘Woe to him who found the blessed month of Ramadhaan and let it pass by without gaining forgiveness.’ Upon that I said: Aameen. When I ascended the second step, he said, ‘Woe to him before whom your name is mentioned and he does not read durood (Salaat) on you.’ I replied: Aameen. When 1ascended the third step he said, ‘Woe to him in whose presence his parents or either one of them attains old age, and (through failure to serve them ) he is not allowed to enter Paradise.’ I said: Aameen." [Bukhaari]
৭. Yaa Ayyuhal-ladhina amanu kutiba alaykumus siyamu kama kutiba alal-ladhina min qablikum la ‘allakum tattaqun.
O you who securely believe! Fasting is prescribed for you just as it was prescribed for those who came before you, in order that you might (lead yourselves) to Taqwa (Qur’an 2:183). Notice that Allah did not guarantee Taqwa. Allah said, ‘you might attain taqwa’. The opposite of which is you might not attain Taqwa. So it implies that effort (fasting correctly) is very important.