গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের জীবনটা বেশ পানসে টাইপ। বাসা, ল্যাব, ল্যাব, বাসা – এই করে করেই আড়াই বছর কাটিয়ে দিলাম। আন্ডারগ্র্যাডরা দেখি কত রকমের ক্লাব করে, কমনস্ এ নাচ প্র্যাক্টিস করে – আর ফ্রি মুভি, সোশ্যাল আওয়ার – এসব ত চলছেই। অনার্স পড়াকালে আমারও কতকিছুতে উৎসাহ ছিল, এখন কেবল চশমা এঁটে ভারিক্কি চেহারা করে ল্যাবে গিয়ে ডেস্কে বসে থাকি। ছুটির দিনগুলোতেও ভারি আলিস্যি, ঝিমিয়ে ঘুমিয়ে আর virtual socializing করে করেই দেখি দুই দিন পার হয়ে গেছে।
আমাদের মতই আলস্যপ্রিয়, উদ্যমহীন, ভাবুক শ্রেণীর আরও কিছু গ্র্যাড স্টুডেন্ট এর পরিচয় হয়েছে এই দু’বছরে। দেশীয় স্টাইলের আড্ডার নেশা ঢুকিয়ে দিয়েছি ওদের মধ্যেও। মনে যত কথা আসে, ভাঙা ইংরেজিতে তার অর্ধেকও প্রকাশ করতে পারিনা, তাতে কী হয়েছে? আন্তরিকতা আর হৃদ্যতার বোধ করি ভাষা প্রয়োজন হয়না। কারও একজনের পরীক্ষা ভাল হলে বা প্রেজেন্টেশন/প্রজেক্ট শেষ হলে মহানন্দে রান্না করে সবাইকে আমন্ত্রণ জানায় খেয়ে যাবার জন্য। প্রতি সপ্তাহেই এই মুখগুলো দেখি, মাঝে মধ্যে মনেও হয়, এত কী কথা বলব? সেদিনই ত দেখা হল!
কিন্তু মজা হচ্ছে এদের সাথে কথা বলার টপিক কখনও ফুরায় না। পৃথিবীর যাবতীয় নিয়মকানুনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন। রাজনীতি নিয়ে আমাদের তর্ক, সাদার সাথে শুভ্রতা আর কালোর সাথে কেন মন্দকে মেলানো হবে তাই নিয়ে আপত্তি। আফ্রিকান আমেরিকানরা কতটা নির্যাতিত হয়েছে (এখনও হচ্ছে) এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞজনের মতামত ইত্যাদি ইত্যাদি। দর্শন হচ্ছে প্রত্যেকের প্রিয় বিষয়বস্তু। আমরা কীভাবে বিভিন্ন ঘটনাকে দেখি, কীভাবে সিদ্ধান্ত নেই, কোনটা শিক্ষণীয়, কোনটা মিডিয়ার প্রভাব – এসব নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ পর্যালোচনা চলছেই।
আরেকটা অতিপ্রিয় বিষয় হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিত্ব কীভাবে গড়ে ওঠে, সম্পর্কগুলোর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে ঘাত প্রতিঘাতে নতুন রূপ নেয়, সম্পর্কের প্রতি দায়িত্বশীলতা gender ও culture ভেদে কতটুকু ভিন্ন হয়, আদর্শ ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ পরিবার কেমন হওয়া উচিৎ এসব। বলা বাহুল্য, এধরণের চিন্তাভাবনার অফুরন্ত খোরাক আছে ধর্মে। তাই ঘুরে ফিরে আমাদের তর্কে বারবারই আসে ধর্ম। যেহেতু সবাই মুসলিম, অল্প বিস্তর প্রত্যেকেরই আগ্রহ আছে ইসলামকে জানার, আর অন্য ধর্মগুলো নিয়ে জ্ঞানের পরিধি ভয়ঙ্কর রকমের কম, তাই ইসলামকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা হয় প্রায়ই।
একটা সময় আমরা খেয়াল করলাম আমাদের আলোচনাগুলো, প্রশ্নগুলো একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ আমরা কুরআন ভাল জানিনা, হাদীস গল্পের মত পড়েছিলাম কোন এক কালে, সীরাহ (রাসুলুল্লাহ (স) এর জীবনী) সম্পর্কে ত অতল অন্ধকারে। আমাদের আড্ডায় চিন্তা করার মত অসাধারণ মাথা আছে অনেক, কিন্তু জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে হিরা কাটার ছুরি দিয়ে ঘাঁটছি কাদামাটি। এর মধ্যে তারিক রামাদানের লেকচার শুনতে Johns Hopkins এ গেলাম, উনি বারবার জোর দিয়ে বললেন, মুসলিমদের তার মূল রেফারেন্সে আসতে হবে। কুরআন ও হাদীস বুঝতে হবে, কিন্তু একই সাথে intellectual humilityর চর্চাও করতে হবে। সব শুনে মনে হল ইসলামকে বিভিন্ন আঙ্গিকে বুঝতে চাওয়ার আমাদের এই প্রয়াসটা ঠিকই আছে, কিন্তু রেফারেন্স অংশটুকু অনুপস্থিত।
ঐ দিনই লেকচারের পর আমরা একটা রেস্টুরেন্ট এ খেতে গিয়েছিলাম, ওখানে বসে ঠিক করলাম, প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় আমরা কারও বাসায় একত্রিত হব, শুধুমাত্র কুরআন, হাদীস এবং সীরাহ নিয়ে methodically জ্ঞান অর্জন করতে। কীভাবে methodically জ্ঞান অর্জন করা যায়? আমাদের ৮-৯ জনের মধ্যে ৩ জন প্রতি সপ্তাহে ৩টা পার্ট আলোচনা করবে। কুরআন ৩০ মিনিট, হাদীস ৫-১০ মিনিট, সীরাহ ২০ মিনিট। মাগরিবের পর শুরু হবে, খাওয়া দাওয়া হবে, আলোচনার যে কোন অংশে যে কেউ প্রশ্ন এবং তর্ক বিতর্ক শুরু করতে পারে। তবে একজন (আমাদের মধ্যে ওরই পড়াশুনা সবচেয়ে বেশি) খেয়াল রাখবে আলোচনা যেন বেশি অফট্র্যাক হয়ে না যায়, বা অতি উত্তপ্ত হয়ে না যায়।
গত ছয় সাত মাস ধরে অনিয়মিত ভাবে এই স্টাডি সার্কেল চলে আসছে।
আমাদের মধ্যে কেউই স্কলার না হওয়ায়, আর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায়, ধর্ম নিয়ে যত রকমের বিব্রতকর প্রশ্ন আছে সবই উঠে আসে। আমরা যে যেটুকু জানি, বুঝি শেয়ার করি, অথবা পরে খুঁজে পেলে কমন মেইল করে জানিয়ে দেই। শুক্রবার ছাড়াও অন্যান্য সময় ওদের সাথে আড্ডা হলে এই রেফারেন্সগুলো চলেই আসে। আমাদের প্রত্যেকেই অনেক অল্প আয়াসে ৯-১০ গুণ বেশি শিখে ফেলছি। আমার সবচেয়ে ভাল লাগে রাসুলুল্লাহ (স) এর জীবনী অংশটুকু, এ বিষয়ে জানি তুলনামূলকভাবে অনেক কম, তাই সবই শিখছি, আর মুসলিম, নন-মুসলিম বিভিন্ন লেখকের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা পড়তে পড়তে মনে হয় আমি যেন ঐ পরিবেশেই আছি, এমন ঘটনা আমারও চারপাশে ঘটছে, আমিও রাসুলুল্লাহ (স) এর মত সবচেয়ে অশান্ত সময়ে শান্ত আছি, মানুষের বিদ্রুপের উত্তর দিচ্ছি দু’আর মাধ্যমে। যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে নামাজে মনসংযোগ করে ভুলে যাচ্ছি চারপাশের আর সব প্রতিকূলতা। শুনতে গল্পের মত, তার উপর আছে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় – সব কিছুরই সংমিশ্রণ, তাই এ সময় সবার মুখে প্রশ্নের ফুলঝুরি ফোটে, সবাই চেষ্টা করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করা যায় এমন উদাহরণ মনের লাইব্রেরিতে তুলে রাখতে।
আল্লাহর দ্বীন জানার উদ্দেশ্যে যারা একত্রিত হয় ফেরেশতারা নাকি তাদের উপর রহমতের ডানা বিছিয়ে দেন, তাদের উপর ‘সুকুন’ নাযিল হয় (সুকুনের মানে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না, মুভিতে যেমন দেখায় চারপাশে সব স্লো মোশনে চলছে, সবকিছু সুন্দর, নায়কের মুখে স্মিত হাসি … ঐ ধরণের শান্তি, স্থিরতা, কৃতজ্ঞতার মিশ্র রূপ হচ্ছে ‘সুকুন’; দেশে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মাঝে কৃষ্ণচুড়ায় লাল হয়ে থাকা পথের উপর খালি পায়ে হাঁটলে মনটা যেমন হালকা.. হয়ে যায়, সুকুন তেমনই।) অন্যদের কথা জানিনা, আমি প্রায়ই এরকম ‘সুকুন’ স্টেট এ থাকি। শরীরটা এত.. হালকা লাগে, হাত পা কোন কিছুর ওজন টের পাইনা। মনের মধ্যে কে যেন বলতে থাকে, সবকিছু এত সুন্দর কেন? এত সুন্দর কেন? আলহামদুলিল্লাহ…, আলহামদুলিল্লাহ … সত্যি! ঐ সময়টায় আমি যদি মরেও যাই, মনে হয় কেবল চোখটুকু বন্ধ করা ছাড়া আর কোন কিছু করতে হবেনা।
আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করি আমার এই বন্ধুদের জন্য। ওদের সাথে থেকে আমি এত কিছু শিখেছি… আসলে আল্লাহর অনেকগুলি রহমতের মধ্যে এটাও একটা, আমার বন্ধুরা প্রত্যেকের মন এত এত সুন্দর – ওদের সাথে যত সময় কাটাই ততই শিখি। এখন আফসোস হয়, কেন দেশে থাকতে বন্ধুরা মিলে এমন স্টাডি সার্কেল করলাম না! আমি ত চাই আমার প্রিয় মানুষগুলোর প্রত্যেকের উপর ফেরেশতারা রহমতের ডানা বিছিয়ে রাখুক, সবসময়।