মিলি সবে আড়মোড়া দিয়ে ঘুম ভাঙছে। হাতড়াতে হাতড়াতে বালিশের নিচে থেকে ফোনটা খুঁজে পেল। স্ক্রীনে টাইম দেখলো সকাল ৮ টা বেজে ২০ মিনিট। অস্ফুটে বলে উঠলো, "ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন!" আজকেও ফজর মিস হয়ে গেলো! ধুর সকাল সকাল মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। এক লাফে বিছানা থেকে উঠে গেল। মারিয়াম আপুকে একটা মেসেজ দিয়ে রাখলো, "সালাম আপু! ইম্পরট্যান্ট কথা আছে। আজকে ক্যান্টিনে থেকো।"
ক্যাম্পাসে ঢুকে লেকচারের সবগুলি পর্ব গুটিয়ে মিলির চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে মারিয়াম আপুকে। ঐ যে নিকাবের ফাঁকে নূরের মতো চোখ দুইটি দেখা যাচ্ছে।
: "কিরে ছোট? কি নাকি জরুরি কথা বলবি?" আপু জিজ্ঞেস করল মিলিকে.
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মিলি আপুকে বললো, "আপু আজকে আবারো ফজর মিস! আমি অনেক চেষ্টা করছি ভালো হতে কিন্তু বার বার পা ফসকে পড়ে যাচ্ছি।"
: "আচ্ছা বলতো, গত রাতে ঘুমিয়েছিস কখন?"
: "ইয়ে মানে, ঘুমাতে ঘুমাতে তো রাত দেড়টা বেজেছে।" আমতা আমতা করে বলল মিলি।
: "ওরে দুষ্টু! ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠতে পারার সবচেয়ে বড় ওপেন সিক্রেট হচ্ছে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাওয়া। দেড়টায় ঘুমিয়ে সাড়ে পাঁচটায় উঠতে কষ্ট হবে না তো কি হবে?"
: "আপু জানো! যেদিন আগে ঘুমাই, সেদিনও তো উঠতে পারিনা।" একটু থেমে মিলি বললো, "আচ্ছা আপু, একজন আত্মশুদ্ধিতে ব্যস্ত থাকা মুসলিমের জীবন কেমন হবে?"
মারিয়াম আপু চারটা আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন,
"চারটা কম, একটা বেশি! ঘুম, খাওয়া, কথা বলা এবং সোশাল ইন্টারেকশন - এই চারটা জিনিস হবে কম! আল্লাহর যিকর করা হবে বেশি! ইমাম তাইমিয়াহ(রাঃ) এর কথা। অথচ দেখ! আমরা এই চারটা জিনিসই সবচেয়ে বেশি করি আর আল্লাহর যিকর করি সবচেয়ে কম।"
: "যিকর মানে কি সারাক্ষণ তাসবীহ গোণা?"
: নারে! শুধু রোবটের মতো কিছু কথা রিপিট করার নাম যিকর না! যিকর হচ্ছে প্রতিটা কথার ভিতরের অর্থ বুঝে সেটা মুখে বলা এবং মুখ যেটা বলছে সেটার সাথে অন্তরকে একই লাইনে নিয়ে আসা। মাইন্ডফুল ভাবে প্রতিটা কাজে আল্লাহকে স্মরণ করা। যেমন ধর, হঠাৎ বাইরে বৃষ্টি শুরু হলো। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, "ধুর! কি ঝামেলা বৃষ্টি শুরু হল! এখন ভিজে ভিজে বাসায় ফিরতে হবে!" আর তুই সেই একই বৃষ্টি দেখে বললি, "সুবহানাল্লাহ বৃষ্টি হচ্ছে! এর মানে আল্লাহর রহমত পৃথিবীতে বর্ষিত হচ্ছে! রসূল(সাঃ) বলেছেন, এই সময় দুয়া কবুল হয়!" এটা ভেবেই তুই একটা দুয়া করে ফেললি! তুই মাইন্ডফুল ভাবে আল্লাহর যিকর করলি আর আমি করলাম ঘোড়ার ডিম!"
দুইজনেই হেসে উঠলো। আপু বলতে থাকলেন,
: "আলা বি যিকবিল্লাহি তাতমাইননুল কুলুব - "জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়" (কুরআন ১৩:২৪)। আমরা ঠিকমত আল্লাহর যিকর করি না - তাই আমাদের অন্তরও শান্তি পায়না!"
ইশ কি সুন্দর করে মারিয়াম আপু তিলাওয়াত করেন! মিলি শুধাল,
: "আপু কিভাবে সুন্দরভাবে যিকর করবো?"
: "চিন্তা করে করে যিকরের কথাগুলি বলবি। যেমন ধর, তুই দশবার আস্তাগফিরুল্লাহ বলছিস - প্রতিবার বলার সময় একটা একটা করে ভুলের কথা স্মরণ করবি যেটার জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছিস। উদাহরণ: "আস্তাগফিরুল্লাহ ইয়া রব, আমি ফজর মিস করেছি মাফ করে দিন!", "আস্তাগফিরুল্লাহ হে আল্লাহ! আমি বাসা থেকে বের হবার আগে আম্মুর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি!", "আস্তাগফিরুল্লাহ ইয়া রব, ক্লাসে বসে নানাজনের গীবত করেছি!" "আস্তাগফিরুল্লাহ আল্লাহ! আমার দুর্বল মুহর্তে আমি আপনার জায়গায় নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছি" ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি দশবার "আলহামদুলিল্লাহ" বলিস, দশটা নিয়ামতের কথা চিন্তা করবি যেটার জন্যে আল্লাহর কাছে তুই কৃতজ্ঞ! তেমনি "সুবহানাল্লাহ" যতবার বলবি আল্লাহর একেকটা নিদর্শনের কথা চিন্তা করবি - "সুবহানাল্লাহ আল্লাহ! শুধু আপনার পক্ষেই বৃষ্টি পাঠানো সম্ভব!", অথবা "আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ! আপনার রহমতে আমি পেট ভরে খেতে পারছি! এটাই তো মাইন্ডফুল যিকর যেটা অন্তরকে শান্ত করে। ভাঙ্গা রেকর্ডারের মতন অর্থ না জানা কিছু শব্দ জপলেই যিকর হয়না। আত্মশুদ্ধিতে ব্যস্ত মুসলিম যিকর করবে অন্তর দিয়ে, আত্মা দিয়ে। সেই যিকর অন্তরকে সর্বাবস্থায় শান্তিতে পূর্ণ রাখবে। কি বুঝাতে পারছি কিছু তোকে?"
মিলি হা করে মারিয়াম আপুর কথা শুনছে। কিভাবে এতো সুন্দর করে কথা বলে একটা মানুষ?
17/02/2020, 12:03