[ক]
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন আমি অমুসলিম পরিবারে বড় হওয়া অমুসলিম এক বালিকা ছিলাম। এক খালাতো বড় বোনের কোমর সমান দিঘল কালো ঘন চুলের প্রশংসা করতেই সাথে সাথে চুলে থুতু দিয়ে খোঁপা করে বেঁধে ফেলল। বলল, এর আগে কেউ একজন তার চুলের প্রশংসা করাতে নজর লেগে নাকি অনেক চুল পড়া শুরু হয়েছিল। একথা শুনে হেসে ফেলেছিলাম আমি। কত কুসংস্কার যে বিশ্বাস করে মানুষ, চুলের প্রশংসা করলে নাকি চুল পড়ে যায়!
এদেশের খ্রিস্টান অথবা হিন্দুদের মাঝেও দেখেছি ছোট বাচ্চাদের কপালের এক কোনে কালো টিপ এঁকে দেয়া হয় নজর যেন না লাগে। কেউ নজর থেকে বাঁচতে থুতু ছিটায়, কেউ আবার এক চোখওয়ালা বিশেষ লকেট গলায় কিংবা হাতে ঝোলায়। এটা শুধু যে খ্রিস্টানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ তা না, দেশে-বিদেশে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব জায়গায় নজর লাগাকে বিশ্বাস করা হয়।
পরবর্তীতে জানলাম ইসলামেও নজর থেকে রক্ষা পেতে বিশেষ কিছু ‘আমল করা হয়। শুধু তাই না, এই বিষয়ে সহীহ হাদিস পাওয়া যায় যেখানে নজরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নির্দেশিত চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করা হয়। এরপর তো আর অবিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না!
- আমার বড় ছেলেটা ছোটবেলায় একদম ধবধবে সাদা নাদুসনুদুস বাচ্চা ছিল। টকটকে লাল জামা পরিয়ে বাইরে বের হলে অপরিচিত লোকজনও ঘুরে ঘুরে তাকাত ওর দিকে। আশেপাশের কেউ গাল টিপে আদর না করে যেত না। আমার মনে আছে, ওকে নিয়ে কোথাও বের হলেই সেই রাতে সারারাত ঘুমাতে পারতো না, কাউকে ঘুমাতে দিতও না। ছটফট করতো আর একটানা কাঁদতো। পরে বেশ কিছু মায়ের কাছ থেকে শুনেছি তাদের বাচ্চাদের সাথেও একই ঘটনা ঘটে।।
- ইসলামে আসার শুরুর দিকে এক বোনের সাথে পরিচয় হয়েছিল। বিয়ের পর তার হাসবেন্ডের সাথে নানান ভঙ্গিমায় ছবি দিত ফেইসবুকে, সাথে রোমান্টিক সব ক্যাপশন। কিছুদিন পরেই শুনি দু’জনের নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে।
- আরেক বোনেরও হাজবেন্ড নিয়ে ভালোবাসাবাসির লেখাগুলো পড়ে অনেকেই তাকে সাবধান করেছিল, পরে শুনেছি ব্যক্তিগত জীবনে তারা মোটেও সুখি নয়।
- মিডিয়ার তারকাদের মাঝে ঘন ঘন ডিভোর্স আর ব্যক্তিগত অশান্তিময় জীবনের পেছনে মূল কারণ হতে পারে এই নজর লাগা।
- ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিও দেখেছিলাম যেখানে এক বছরের ছোট্ট একটা কিউট মেয়েকে তার বাবা নানানভাবে ড্যাড ডাকা শেখাচ্ছে, অথচ বাচ্চাটা বার বার মাম্মা মাম্মা বলছে। আপনারা অনেকেই দেখেছেন হয়তো। ভিডিওটা ভাইরাল হওয়ার পর মেয়েটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সাধারণ সর্দিকাশির চিকিৎসা করাতে গিয়ে ধরা পড়ে সে রেসপিরেটরি ভাইরাসে আক্রান্ত। অল্প দিনের মাঝেই সে মারা যায়।
- রুকিয়া সম্পর্কিত কোন একটা বইতে পড়েছিলাম এক ব্যক্তির নতুন বাসার প্রশংসা করাতে হঠাৎ ছোট ছোট পোকা দিয়ে ভরে যাচ্ছিল পুরো বাড়ি। পরে রুকিয়া করে পানি ছিটানোর পর তা ঠিক হয়েছিল।
আপনি বিজ্ঞানমনস্ক হলে এতক্ষণে মনে হতে পারে এগুলো নজর লাগার কারণে না হয়ে স্বাভাবিকভাবে অন্য কারণেও তো হতে পারে। আমি বলব অন্য কারণগুলোর উৎপত্তি ঘটেছে বরং এই নজর লাগা থেকেই। আমি এটা বলছি না যে জীবনের যে কোন অসুস্থতা, যে কোন দুর্ঘটনার নেপথ্যে বদনজর জড়িত। কিন্তু প্রকাশ্যে সুন্দর কিছুর প্রদর্শন, অতিরিক্ত প্রশংসা, বারাকাতের দুয়া না করা, লোক দেখানো কাজ ইত্যাদির কারণে নজর লাগাটা খুব বেশি স্বাভাবিক।
একজন মুসলিম হিসেবে আমি সব রকম কুসংস্কারমুক্ত। প্রেগ্ন্যান্সিতে কখনোই চন্দ্রগ্রহণ সূর্যগ্রহণ মেনে চলিনি। বাচ্চাদের কপালে কালো টিপ দেয়াটাও শরিয়ত সম্মত নয় বলে দিইনি কখনো। অথচ নজর লাগার ব্যাপারটা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এবং তা থেকে আমার রবের কাছে প্রতিনিয়ত আশ্রয় চাই।
আসুন জেনে নিই এই ব্যাপারে ইসলাম কী বলে।
আরবী শব্দ আল-’আইন এর উর্দু হলো নজর। ইংরেজীতে একে ইভল আই (evil eye) আর বাংলায় বলে বদনজর বা নজর লাগা অথবা চোখ লাগা। সাধারণভাবে বদনজর হলো কোন ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি ভালোলাগার কারণে বার বার তার দিকে হিংসাপূর্ণ দৃষ্টিপাত করা, এবং এই দৃষ্টিপাতের ফলে সেই ব্যক্তি বা বস্তুর কোন ক্ষতি সাধন করা। সুরাহ ফালাক্বের শেষ আয়াতে আমরা এই হিংসাত্মক নজর থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। বদনজর হলো সেই তীরের মতো, যা হিংসুকের অন্তর থেকে নিক্ষেপ করা হয় যাকে হিংসা করা হয় তার উপর। বদনজরের এই তীর কখনো লক্ষ্যভেদ করে, কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয়। [১]
আ’ইশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম বদনজর থেকে বাঁচার জন্য রুকিয়া করতে বলতেন। [২]
রসুলুল্লাহ সা. বলেন, “বদনজর সত্য, তাকদীরকে ছাড়িয়ে যায় এমন কিছু থাকলে তা হলো বদনজর!” [৩]
তিনি (সা.) আরো বলেন, “বদনজর মানুষকে কবর পর্যন্ত আর উটকে রান্নার পাতিল পর্যন্ত পৌছে দেয়!” [৪]
বিশুদ্ধ সনদে আরেকটি হাদীস বর্ণিত আছে যেখানে রাসুল সা. বলেন, “তোমরা বদনজর থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও, কেননা বদনজর সত্য!” [৫]
বদনজর যে শুধু হিংসুকদের হিংসাপূর্ণ দৃষ্টি থেকে হয় তা নয়, কারো কোন কিছু ভালো লাগলে প্রশংসাপূর্ণ দৃষ্টি থেকেও নজর লাগতে পারে। একজন মায়ের নজর তার সন্তানের উপর, এমন কি কারো নিজের উপর নিজের নজরও লাগতে পারে।
বদনজর থেকে বাঁচতে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম আমাদের কিছু ‘আমল শিখিয়ে দিয়েছেন। থুতু ছিটিয়ে, তাবিজ ঝুলিয়ে অথবা কালো টিপ দিয়ে নয় -- মুসলিম হিসেবে আমরা শুধু শরিয়াসম্মত প্রস্তাবিত পন্থাগুলোই মেনে চলব।
কাজেই আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন বদনজর থেকে রক্ষা পেতে আমাদের করণিয় কী।
১. রাসুল সা. বলেন, “নিজের প্রয়োজন পূরণ হওয়া পর্যন্ত তা গোপন রাখার মাধ্যমে সাহায্য লাভ করো। কেননা, প্রতিটি নিয়ামত লাভকারীর সাথেই হিংসুক থাকে!” [৬]
সোশাল মিডিয়ায়, বন্ধুদের আড্ডায় অথবা মহিলাদের গল্পের আসরে -- আল্লাহর দেয়া নিয়ামতের বর্ণনা না করলেই নয়। আমি নিজেও অনেক সময় এই কাজটা করে ফেলি। কখনো আমরা সন্তানদের প্রশংসা, কখনো ব্যবসায় লাভের কথা, কখনো স্বামী/স্ত্রীর ভালো দিকগুলো ফলাও করে অন্যের কাছে বলতে থাকি। ফলে নজর লাগার দ্বারটা নিজেরাই উন্মুক্ত করে রাখি। মুফতি ইসমাইল মেংকের একটা লেকচারে শুনেছিলাম, সোশাল মিডিয়াতে বাচ্চাদের ছবি দেয়া মানে হলো “আসো আমার সন্তানকে তোমার নজর লাগিয়ে যাও” বলা।
কাজেই নজর লাগা থেকে বাঁচতে এই ব্যাপারে সাবধান থাকা জরুরি।
২. “তোমাদের মাঝে কেউ যখন নিজের অথবা অধীনস্থদের অথবা ভাইদের কোন কিছু পছন্দ করে, সে যেন বারাকাহর দুয়া করে নেয়। কারণ বদনজর সত্য।” [৭]
বারাকাহর দুয়া মানে “আল্লাহুম্মাহ বারিক লাহু” অথবা “বারাকাল্লাহু ফিক” বলা, মাশাআল্লাহ নয়। আমরা ভালো কিছু দেখলে সেই জিনিসের বারাকাহ এর দুয়া করব। কারো কাছে দশ হাজার টাকা দেখলে আমরা তার জন্য বিশ হাজারের দুয়া করব। সুন্দর মুখের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়ার দুয়া করব। সুন্দর সম্পর্কগুলো আরো মজবুত করে দিতে আল্লাহর কাছে চাইব। এতে আমাদের নজর অন্যের উপর পড়ার সম্ভাবনা অনেক অনেক কমে যাবে ইনশাআল্লাহ্।
৩. সকাল সন্ধ্যা আল-মু’আউওয়াযাতাইন (ফালাক্ব-নাস), সুরাহ ইখলাস, আয়াতুল কুরসি, সুরাহ ফাতিহা পড়তে হবে।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম বদনজর থেকে বাঁচার জন্য কিছু দুয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। হিসনুল মুসলিম অথবা এধরনের কোন অথেনটিক দুয়ার বই থেকে আমরা দুয়াগুলো জেনে নিব এবং সে অনুযায়ী ‘আমল করব ইনশাআল্লাহ্।
বদনজর থেকে রক্ষার জন্য রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিহি ওয়াসসাল্লামের সেখানো একটি প্রসিদ্ধ দুয়া হলো -
“আ’উযুবি কালিমাতিল্লাহি তাম্মাহ মিন কুল্লি শাইত্বনিন ওয়া হাম্মাহ ওয়া মিন কুল্লি ‘আইনিন লাম্মাহ।” [৮]
৪. সাহল ইবনে হুনাইফ রা. কোথাও গোসলের জন্য জামা খুলেছিলেন। আমের ইবনে রবী’আ রা. তাকে দেখে বললেন, এত সুন্দর মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। এত সুন্দর এমনকি কোন যুবতীর শরীরও দেখিনি। সাহল ঐখানেই পড়ে গেলেন, তার জ্বর চলে আসলো আর মারাত্মক জ্বরে তিনি ছটফট করতে লাগলেন।
তাকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নিয়ে গেলে তিনি ঘটনাটি শুনলেন। তিনি আমের ইবনে রবী’আকে ডাকলেন এবং বললেন, “তোমরা কেন তোমাদের ভাইকে নজর দিয়ে হত্যা করছো?”
অতঃপর তাকে বললেন, অযু কর। আমের (রা.) অযু করলেন। অতঃপর সেই অযুর পানি দিয়ে সাহল এর পিঠ ধুয়ে দিলে কিছুক্ষণ পরে তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন। [৯]
কার নজর লেগেছে জানা থাকলে তার ওযুর পানি আক্রান্ত ব্যক্তির পেছন থেকে একবারে ঢেলে দিতে হয়।
নজর লাগা আর যাদুটোনা বা সিহর কিন্তু এক না। জীবনের যে কোন ঘটনা, দুর্ঘটনা, অসুস্থতার কারণকে নজর লাগা বলে চালিয়ে দেয়া যেমন ঠিক নয় -- এসবের কারণ হিসেবে বদনজরকে উপেক্ষা করাও ঠিক নয়।
কারণ…
“বদনজর সত্য”।
Written By: সিহিন্তা শারীফা
[১] যাদ উল মা’আদ
[২] আল-সাহিহাইন
[৩] মুসলিম, আহমাদ, তিরমিযি
[৪] আবু নুয়া’ইম, ইবনে ‘আদি এবং অন্যান্য। আল্-আলবানীর মতে হাসান
[৫] ইবনে মাজাহ
[৬] তাবারানী বাইহাকী
[৭] ইবনে আল-সুন্নি, ‘আমল আল-ইয়াওম ওয়াল-লাইলাহ, পৃ: ১৬৮; আল-হাকিম, ৪/২১৬; আলবানীর মতে সহীহ
[৮] বুখারি
[৯] আল-মুসনাদ ৩/৪৮৬
[খ]
ঘটনা এক. নতুন বিয়ে করেছেন ইকবাল হাসান। স্ত্রীকে নিয়ে খুব আনন্দেই সময় কাটছে তাঁর। নতুন বিবাহিত জীবনের র্যাপারে মোড়ানো ভালোবাসার পেয়ালায় চুমুক, একটু রোমান্টিসিজম, কাব্য আর স্নিগ্ধতার পরশে মাখা বিকেলগুলো দুজনের যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকে আরো জোরালো করছে। এই বাঁধন যেন কোনদিন আলগা হবার নয়, দুজন যেন শুধু দুজনের জন্যই।
মধুচন্দ্রিমা থেকে ফেরার পরই দুজনের সেই সম্পর্কে যেন ফাটল ধরে। ইকবালের ক্রোধ যেন মানসিক ব্যাধিতে রূপ নেয়। সুচয়না শান্ত স্বভাবের মেয়ে ছিলো, সেও মানসিক সমস্যাকে প্রশ্রয় দিতে নারাজ। ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রবল ঝগড়া হতে থাকে। একে অন্যের সাথে আজীবন জুড়ে থাকার সেই সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা রূপ নেয় পরিহাসে। শেষ পর্যন্ত তা বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়।
ইকবাল আর তাঁর স্ত্রী আজও জানেন না কীসে তাঁদের সেই সুন্দর সম্পর্কটাকে এভাবে পরিবর্তন করে দিলো। কেন তাঁরা পরস্পরের কাছে এভাবে রাতারাতি বদলে গেলেন।
ঘটনা দুই. তাহমিনা মা হয়েছেন প্রথমবারের মতো। এক অপার্থিব আনন্দমাখা অনুভূতি ছেয়ে আছে শরীর-মনের প্রতিটি বিন্দুতে। বাচ্চা জন্মের পরপর মোবাইলে তার ছবি তোলার হিড়িক পড়ে গেলো। এরপর যথারীতি ফেসবুকে আপলোড- কেউ মামা হবার আনন্দে, কেউ ফুফু হবার আনন্দে। আর বাচ্চার সাথে একটা সেলফি।
কিছুদিন পর খুশির জোয়ারকে খানিকটা ম্লান করে তাহমিনার কপালে খাঁজ। কী ব্যাপার? বাচ্চা মায়ের দুধ খায় না একেবারেই। বিষয়টা স্বাভাবিক নয়। ডাক্তাররা নানারকম পরামর্শ দিচ্ছেন। কাজ হচ্ছে না কোনটাতেই। তাহমিনা বুঝতে পারলেন না কী থেকে কী হলো।
২.
ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামের যুগে এসে মানুষের মধ্যে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেখনদারিতার একটা রোগ পেয়ে বসেছে। কী করছে, কী খাচ্ছে, কীভাবে খাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে- সবকিছুই অন্যকে সেলফির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক দিন থেকেই। এমনকি স্বামী স্ত্রী নিজেদের ভালবাসাময় সুন্দর মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করে অন্যদের দর্শনের বস্তু বানিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে।
এই কাজগুলো করার সময় যে ব্যাপারটা আমাদের মাথা থেকে হারিয়ে যায় সেটাই আজকের আলোচনার বিষয়। আর তা হলো- বদনজর বা ইভিল আই।
বদনজর কী?
বদনজর হলো আল্লাহ্র একটি সৃষ্টি। এটি একটি বিশেষ প্রভাব যা একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের ওপরে বিস্তার লাভ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কারো চেহারা অত্যন্ত সুন্দর। কোন একজন লোক তার প্রশংসায় “সত্যিই তুমি কী দারুণ দেখতে!” বলে উঠল। পরদিন দেখা গেলো সুন্দর চেহারার ব্যক্তি কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছে।
বদনজর কি সত্যিই আছে নাকি স্রেফ কুসংস্কার?
বদনজর আছে। অবশ্যই আছে। কুরআনে এর দৃষ্টান্ত আছে, হাদীসে এর বিশদ বর্ণনা আছে। বদনজর বা আল ‘আইনে বিশ্বাস করা তাই আমাদের ঈমানের অংশ। যদিও এটি ঈমানের মৌলিক বিষয় নয়, তবে একে অস্বীকার করলে যে ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাতে সন্দেহ নেই।
কুরআন থেকে দৃষ্টান্তঃ
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সূরা ইউসুফে বলেন,
“তিনি (ইয়াকুব আলাইহিস সালাম) বললেন: হে আমার সন্তানেরা! (শহরে প্রবেশের সময়) তোমরা সবাই একই দরজা দিয়ে প্রবেশ করো না, বরং পৃথক পৃথক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। আল্লাহর কোন বিধান থেকে আমি তোমাদেরকে রক্ষা করতে পারি না, নির্দেশ আল্লাহরই চলে। তাঁরই উপর আমি ভরসা করি, আর ভরসাকারীদের উচিত তাঁর ওপরেই ভরসা করা”। [সুরা ইউসুফ আয়াত ৬৭]
ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু), ইমাম মুজাহিদ (রহ), কাতাদাহ (রহ) সহ প্রথিতযশা মুফাসসিরীন এই আয়াত প্রসঙ্গে বলেন, ইয়াকুব (আলাইহিস সালাম) সন্তানদের ব্যাপারে লোকেদের বদনজর লাগার আশঙ্কা করেছিলেন, কারণ তারা স্বাস্থ্যবান ও সুন্দর চেহারার অধিকারী ছিলো। এজন্য সন্তানদের শহরে প্রবেশের সময় আলাদা আলাদাভাবে প্রবেশ করতে বলেছেন। পাশাপাশি এটাও উল্লেখ করে দিয়েছেন এসব (বদনজর) তো আসলে আল্লাহর তৈরী নিয়ম, এখানে তাঁর (ইয়াকুব আলাইহিস সালাম) কিছু করার নেই, আল্লাহর ওপর ভরসা ছাড়া। [তাফসীর ইবনে কাসীর]
হাদীসের আলোকে বদনজরঃ
আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “বদ নজর সত্য”। [বুখারি: ১০/১১৩]
তিনি আরও বলেছেন, “কোন বস্তু যদি তাক্বদীরকে অতিক্রম করতো তবে তা হতো বদ নজর”। [তিরিমিযী ২০৫৯, আহমাদ ৬/৪৩৮]
তিনি আরও বলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে তাক্বদীরের মৃত্যুর পর সর্বাধিক মৃত্যু হবে বদ নজর লাগার ফলে”। [আত তারিখ, বুখারি]
৩.
বদনজর কেন লাগে?
বদনজরের কারণ সম্পর্কে ইসলামের মনীষীরা বিভিন্ন প্রকারের মত দিয়েছেন। সর্বজনগৃহীত মত এই যে, বদনজর মূলত আত্মার প্রভাবে হয়ে থাকে।
ইবনুল কায়্যিম (রহ) বলেন,
‘আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের দেহ ও আত্মাকে বিভিন্ন প্রকারের ক্ষমতা ও প্রাকৃতিক ক্রিয়াশীলতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আর এদের ভেতর অপরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও দিয়েছেন। বদনজর আত্মার প্রভাবে হয়ে থাকে। যেহেতু আত্মার সাথে চোখের সম্পর্ক খুবই গভীর তাই একে চোখ লাগা বলা হয়। কিন্তু চোখের নিজস্ব কোন প্রভাব নেই বরং প্রতিক্রিয়া কেবল আত্মার মাধ্যমে হয়ে থাকে।
বদনজর কেবল দৃষ্টির দ্বারা হয় না বরং কখনও অন্ধ ব্যক্তির বদ নজরও লেগে যেতে পারে। আর তা এভাবে যে, তার সামনে কারো প্রশংসা বর্ণনা করা হয় আর তা শ্রবণ করে অন্ধ ব্যক্তির আত্মা প্রশংসিত ব্যক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এটা একটা বিষাক্ত তীরের ন্যায় যা বদ নজরকারী ব্যক্তির আত্মা তাকে বের করে অন্য ব্যক্তির পর আঘাত হানে। এর একটি দৃষ্টান্ত এমন যে, কোন আক্রমণকারী এরকম এক ব্যক্তিকে আক্রমণ করে যার গায়ে যদি সুরক্ষিত পোশাক থাকে তবে আঘাতে তার শরীর আহত হবে না। তেমনি যদি দু’আ পড়ে যদি সে সুরক্ষিত থাকে তবে আক্রান্ত হবে না’। [যাদুল মা’আদ ১/১৬৫]
বদনজর কি কেবল মন্দ স্বভাবের লোকেদের দ্বারা লাগে নাকি নেককার লোকেদের দ্বারাও লাগতে পারে?
আবু উমামা ইবনে সাহাল ইবনে হুনাইফ থেকে বর্ণিত, তাঁর পিতা সাহাল ইবনে হুনাইফ একবার মদীনার খাইবার উপত্যকায় গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যখন তিনি জামা খুললেন তখন আমির ইবনে রাবীয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) দৃষ্টি সাহালের শরীরের দিকে পড়ে এবং তিনি বলে ওঠেন, “আজকের মতো এমন (সুন্দর) ত্বক কারো দেখি নি, এমন কি অন্দর মহলের নারীদেরও নয়”। একথা বলার সাথে সাথে সাহাল বেহুঁশ হয়ে পড়েন এবং প্রচণ্ড রোগে আক্রান্ত হয়ে যান।
লোকেরা রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বিষয়টি জানালে তিনি প্রশ্ন করেন তারা কাউকে সন্দেহ করে কি না। তখন লোকেরা আমির ইবনে রাবীয়া (রা) এর কথাটা বলে। আল্লাহ্র রাসূল তাঁকে ডেকে পাঠান এবং রাগান্বিত হয়ে বলেন- “কেন তোমাদের মধ্যে কেউ নিজের ভাইকে হত্যা করে? তুমি কেন তার জন্য বরকতের দু’আ কর নি? এখন তার জন্য গোসল কর”।
অতঃপর আমির (রা) নিজের হাত, মুখমণ্ডল, দু পা, দু হাঁটু, কনুই ও লুঙ্গীর অভ্যন্তরীণ অংশ একটি পাত্রে ধৌত করলেন। এরপর সেই পানি সাহাল ইবনে হুনাইফের পিঠে ঢেলে দেওয়া হলো। এতে তিনি আরোগ্য লাভ করলেন।
[ইমাম আহমাদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন; আলবানী (রহ) এর মতে সহীহ]
এই ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, নজর কেবল বদকার লোকের দ্বারা হবে এমন কোন কথা নেই, নেককার লোকের মাধ্যমেও হতে পারে। আমির ইবনে রাবীয়া (রা) ছিলেন একজন বদরী সাহাবী, অথচ তাঁর দ্বারাও সাহালের নজর লেগেছিল। সুতরাং আমার আপনার যেকোন ব্যক্তির নজরের মাধ্যমে অন্য কারো ক্ষতি হতে পারে।
জ্বিনের বদনজরও লাগতে পারেঃ
আবু সাঈদ খুদরী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ জ্বিনের বদনজর থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ্র নিকট আশ্রয় চাইতেন এবং এরপর মানুষের বদনজর থেকেও আশ্রয় চাইতেন। এরপর যখন সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস নাজিল হলো তখন থেকে অন্য দু’আ ছেড়ে এ সূরাদ্বয় দিয়ে দু’আ করতেন।
[তিরমিযী চিকিৎসা অধ্যায়, ২০৫৯, ইবনে মাযাহ ৩৫১১, সহীহ]
৪.
বদনজরের লক্ষণ কী কী?
কোন ক্ষতির ব্যাপারে তা বদনজরের প্রভাবেই হয়েছে কি না তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে কিছু আলামত দেখে আন্দাজ করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা অভিজ্ঞতা থেকে কিছু সাধারণ আলামতের কথা বলেছেন, যার মধ্যে আছে- শরীরে জ্বর থাকা, কিন্তু থার্মোমিটারে না উঠা; প্রায়সময়ই কাজে মন না বসা, নামায যিকর ক্লাসে মন না বসা; প্রায়শই শরীর দুর্বল থাকা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব লাগা; অহেতুক মেজাজ বিগড়ে থাকা; বিভিন্ন সব অসুখ লেগে থাকা যা দীর্ঘদিন চিকিৎসাতেও ভালো হয় না (সর্দিকাশি, মাথাব্যথা ইত্যাদি); আপনি যে কাজে অভিজ্ঞ সেটা করতে গেলেই অসুস্থ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
এখানে উল্লেখ্য, শারীরিক-মানসিক যেকোন সমস্যাকেই বদনজরের প্রভাব মনে করা যাবে না। বরং অন্যান্য কারণ অনুসন্ধান করে, চিকিৎসা করিয়ে ফল না পেলে সেক্ষেত্রে রুকইয়ার আশ্রয় নেওয়া উত্তম।
বদনজর লাগলে কী করণীয়?
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, আমার এই লেখাটি কোনওরকম রুকইয়া (কুরআন-সুন্নাহ সমর্থিত পন্থায় ঝাড়ফুঁক) বিষয়ে নয়। বদনজরের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টিই লেখাটির উদ্দেশ্য। তাছাড়া রুকইয়ার ব্যাপারে আমার নিজের জ্ঞানও একেবারেই সামান্য। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বদনজরের চিকিৎসা বিষয়ে বিশেষ আলোচনা এখানে থাকছে না। কেবল প্রাথমিক দুয়েকটি কথা বলছি।
বদনজরের একটি চিকিৎসা পদ্ধতি হচ্ছে, কার নজর লেগেছে সেটা যদি জানা যায় তবে ঐ ব্যক্তির গোসল করা পানি সংগ্রহ করে রোগীর পিঠে ঢেলে দেওয়া। এর ফলে আল্লাহ্র ইচ্ছায় রোগী আরোগ্য লাভ করবে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “নজর লাগা সত্য, যদি কোন কিছু তাক্বদীরকে অতিক্রম করতো তবে তা হতো বদ নজর। অতএব, তোমাদের মধ্যে কাউকে যখন (এর জন্য) গোসল করতে বলা হবে তখন সে যেন গোসল করে”। [মুসলিম ৫/৩২]
এর বাইরে অনেকরকম দু’আ ও আমল আছে যেগুলো দ্বারা বদনজরের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। বদনজরের রুকইয়া সম্পর্কে জানতে নির্ভরযোগ্য রাক্বীর (যিনি রুকইয়া করেন) শরণাপন্ন হতে হবে। এক্ষেত্রে ফেসবুকে রুকইয়া সাপোর্ট গ্রুপ বেশ ভালো কাজ করছে আমরা যতদূর জানি। এছাড়া বদনজরের চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু ধারণা পাবেন এখানে
৫.
এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা- বদনজর থেকে বেঁচে থাকার জন্য কী করণীয়?
প্রবাদে আছে-Prevention is better than cure. অর্থাৎ রোগের প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধ উত্তম। বদনজর যদি লেগেই যায় তবে অবশ্যই রুকইয়া করতে হবে, কিন্তু লাগার আগেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা সর্বোত্তম। আমরা এ ব্যাপারে কিছু করণীয় আলোচনা করছি।
প্রথমত, আল্লাহ্র সৃষ্ট যেকোন অনিষ্ট এবং শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করা, হারাম থেকে বেঁচে থাকা এবং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ও তাঁর পবিত্র কালাম কুরআন মাজীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। বিশেষত, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সলাত আদায় এবং নাপাকী থেকে বেঁচে থাকা। যারা এ কাজগুলো করে থাকেন তাঁদের ওপর এমনিতেই জ্বিন, জাদু এবং বদনজরের প্রভাব অনেক কম হয়ে থাকে।
দ্বিতীয়ত, দু’আ ও যিকর। পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সলাতের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ, রাতে ঘুমাবার আগে আয়াতুল কুরসী ও সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পাঠ এবং সকাল সন্ধ্যার নির্ধারিত বিশেষ যিকর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো আল্লাহ্র সৃষ্টির অকল্যাণ থেকে নানাভাবে প্রটেকশন দেয়।
এ ব্যাপারে দুটো গুরুত্বপূর্ণ হাদীস উল্লেখ করছি-
(ক) উসমান বিন আফফান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার করে এই দু’আ পড়বে, কোন জিনিস তার ক্ষতি করতে পারবে না -
অর্থ: আমি শুরু করছি সেই আল্লাহ্র নামে যার নামের সাথে আসমান ও জমিনের কোন জিনিস ক্ষতিসাধন করতে পারে না, তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাত। [তিরমিযী ৩৩৮৮, ইবনু মাজাহ ৩৮৬৯, আলবানী (রহ) এর মতে হাসান]
(খ) আব্দুল্লাহ ইবনে খুবাইব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “একদা রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বললেন, ‘সকাল-সন্ধ্যায় ক্বুল হুওয়াল লাহু আহাদ (সূরা ইখলাস), ক্বুল আঊযু বিরাব্বিল ফালাক্ব (সূরা ফালাক্ব) ও ক্বুল আঊযু বিরাব্বিন নাস (সূরা নাস) তিনবার করে পড়। তাহলে প্রতিটি ক্ষতিকর জিনিস থেকে নিরাপত্তার জন্য তা যথেষ্ট হবে’।” [তিরমিযী ৩৫৭৫, আবু দাঊদ ৫০৮২, হাসান]
সকাল সন্ধ্যা এবং দিনের অন্যান্য সময়ে যিকর ও আমলসমূহ জানতে হিসনুল মুসলিম, আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ) রচিত ‘রাহে বেলায়াত’ এবং ইমাম নববী (রহ) এর বিশ্ববিখ্যাত হাদীস সংকলন ‘রিয়াদুস সালেহীন’এর যিকর অধ্যায়টি পড়তে বিশেষভাবে অনুরোধ করা যাচ্ছে। বই তিনটির ডাউনলোড লিঙ্ক লেখার শেষে দেওয়া হয়েছে।
তৃতীয়ত, আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে সতর্কতা অবলম্বন। এ ব্যাপারে সুন্নাহর আলোকে কতিপয় পরামর্শ উল্লেখ করা যাচ্ছে-
(i) আল্লাহ্র ইচ্ছায় ভালো কিছু লাভ করলে তা অতিরিক্ত প্রচার না করা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “নিজের প্রয়োজন পূরণ হওয়া পর্যন্ত সেটা গোপন রাখার মাধ্যমে সাহায্য লাভ করো। কেননা, প্রতিটা নিয়ামত লাভকারীর সাথেই হিংসুক থাকে।” (তাবারানী)
আল্লাহ্ আমাদের যে নিয়ামতগুলো দিয়ে থাকেন, সেগুলোর ব্যাপারে তাঁর শুকরিয়া আদায় করা এবং মানুষের কাছে সেগুলো প্রচার করা থেকে বিরত থাকা। যেমন অহেতুক নিজের, নিজের সম্পদ, সন্তান, পরিবারের ব্যাপারে অন্যের কাছে প্রশংসা করা। ছেলেদের জন্য নিজের স্ত্রীর এবং মেয়েদের জন্য নিজের স্বামীর গুণকীর্তন অন্যদের সামনে করা। এগুলো বর্জন করা জরুরি।
(ii) নিজেদের ব্যক্তিগত অ্যাচিভমেন্টগুলো নিয়ে পাবলিকলি বেশি কথা না বলা। যেমন- ব্যবসায় অত টাকা লাভ হয়েছে, চাকরিতে বেতন বেড়েছে ইত্যাদি।
(iii) নিজের বা নিজের পরিবারের ভালো সংবাদ বলতে হলে তার মধ্যে যেন আল্লাহ্র যিকর থাকে সেদিকে খেয়াল করা। যেমন- “আলহামদুলিল্লাহ, পরীক্ষায় অনেক ভালো করেছি” কিংবা “আল্লাহ্র রহমতে এবছর ব্যবসায় লস হয় নি” ইত্যাদি।
এখন অন্য কেউ যদি আপনার কিছুর প্রশংসা করে, তাহলে উনি যিকর না করলে আপনার উচিত হবে যিকর করা। উদাহরণস্বরূপ কেউ বললো- ‘ভাই আপনার ছেলেটা তো অনেক কিউট!’ আপনি বলুন- “আলহামদুলিল্লাহ্”। মনে মনে বলুন- ‘আল্লাহ্র কাছে বদনজর থেকে আশ্রয় চাচ্ছি’।
(iv) নিজের ছবি, ব্যক্তিগত মুহূর্ত, আনন্দের সময় ইত্যাদি ছবি তুলে বা পোস্ট করে ফেসবুকে আপলোড করার অভ্যাস ত্যাগ করা। ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামের মতো পাবলিক জগতে এগুলোকে হাইলাইট না করা। এ পয়েন্টটাতেই সম্ভবত আমরা সবচেয়ে পিছিয়ে আছি।
বিশেষত, স্বামী-স্ত্রীর আনন্দময় মুহূর্ত, বাচ্চাদের ছবি এসব পাবলিকলি পোস্ট করলে ক্ষতির ঝুঁকি থাকে সবচেয়ে বেশি। কেবল বদনজরই না, এসব ছবির মাধ্যমে শত্রুতাবশত Black magic করার অনেকগুলো ঘটনা বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে। এরপরও যদি আমরা সতর্ক না হই তবে কী করার থাকতে পারে!
চতুর্থত, অন্যরা যাতে আমার নজর লাগা থেকে বেঁচে যায় সেজন্য করণীয়-
এ ব্যাপারে বায়হাকী শরীফের হাদিস উল্লেখযোগ্য, আনাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন- "কোনো পছন্দনীয় বস্তু দেখার পর যদি কেউ বলে, مَا شَاء اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّه (আল্লাহ যা চেয়েছেন তা হয়েছে, আল্লাহ ছাড়া কারো ক্ষমতা নেই) তাহলে কোনো (বদনজর ইত্যাদি) বস্তু সেটার ক্ষতি করতে পারবে না।"
অন্যের ভালো জিনিসের প্রশংসা করার সময় আল্লাহ্র যিকর রাখতে হবে। যেমন কারো ফুটফুটে সন্তান দেখে “ওয়াও! দারুণ!” জাতীয় কথা না বলে এভাবে বলা- “মাশা আল্লাহ্! আপনার সন্তানের হায়াতে আল্লাহ্ বারাকাহ দান করুন”।
সুন্দর বা মনোমুগ্ধকর কিছু দেখলে “কী সুন্দর!/হেব্বি!/অসাম!” জাতীয় এক্সপ্রেশান না দিয়ে আমরা আল্লাহ্র কাছে সেই জিনিসের বরকতের জন্য দু’আ করব। এতে করে আর নজর লাগার ভয় থাকবে না।
সোজা কথা আমাদের বর্ণনা ও প্রশংসাগুলো যেন আল্লাহমুখী হয়।
৬.
লেখার শুরুতে যে দুটো ঘটনার কথা বর্ণিত হয়েছে, সেখানে চরিত্রগুলো কাল্পনিক, কিন্তু গল্পগুলো বাস্তব ঘটনার আলোকে লিখিত। ইকবাল হাসান হানিমুনে গিয়ে স্ত্রীর সাথে তাঁর ভালোবাসাময় মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করে ফেসবুকে আপলোড করেছিলেন, নিজেদের আনন্দময় সময়ের কথা প্রচার করেছিলেন। তাহমিনার শিশুর ছবি ফেসবুকের পাবলিক জগতে ছড়িয়ে পড়ে। কতলোক সেগুলো দেখেছে, হিসেব আছে!
আমাদের অনেকের জীবনের অনেক সমস্যা, ছোটো থেকে শুরু করে বড়, জীবনকে একেবারে বিষিয়ে তোলার মতো অবস্থা সৃষ্টিকারী অনেককিছুই হয় যার পেছনে আমরা কোন কারণ বা যুক্তি দাঁড় করাতে পারি না। ঠিক কী কারণে আমরা এমন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, ভেবে কূলকিনারা পাই না। খুঁজলে দেখা যাবে এসবের অনেককিছুই স্রেফ নজর লাগার মাধ্যমে শুরু হয়েছে। আর নজর লাগার সব রাস্তা খুলে রেখে আমরাই নিজেদের বিপদকে নিজেদের জীবনে টেনে আনছি।
এজন্য ভাই ও বোনেরা, একটু সতর্ক হোন। নিজের ভালো নিজে না বুঝলে আর কে বোঝাবে বলুন! তাই একান্ত অনুরোধ, অহেতুক নিজের ও নিজের আপনজনদের ছবি, ব্যক্তিগত বিষয়াদি ফেসবুকের মতো পাবলিক জগতে শেয়ার করবেন না। কথাবার্তায় আল্লাহ্র যিকর বেশি বেশি করুন। তাঁর হুকুমের মধ্যে জীবন পরিচালনার চেষ্টা করুন।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর সৃষ্টির সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে আমাদের বেঁচে থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন।
Written By: মুহাম্মাদ জুবায়ের