আমরা হাদিস ও ইতিহাস পড়ার সময় অনেক বার এই দুটি মুদ্রার নাম শুনি। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ এই মুদ্রা সম্পর্কে কিছুই জানে না। আমরা জানি মহরে ফাতেমি হল ৫০০ দিরহাম কিন্তু এই ৫০০ দিরহামের বর্তমান মুল্য কত তা আমরা জানি না। এমনি ভাবে যখন পড়ি, উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু উম্মুল মুনিনিনদের জন্য ১২ হাজার দিরহাম করে ভাতা নির্ধারণ করেছিলেন, বা যাকাতের নিসাব পরিমাণ হল ২০০ দিরহাম বা ২০ দিনার, দিয়তের মূল্য হল ১০ হাজার দিরহাম অথবা ১ হাজার দিনার। অমুক সাহাবী বা তাবীঈ ১ হাজার দিনার দান করলেন। তখন আমরা সেসবের হিসাব মিলাতে পারি না। ইসলামের বেশ কিছু বিধান দিনার দিরহামের সাথে সংযুক্ত যেমন, যাকাত, বিয়ে, হুদুদ, কাফফারা ইত্যাদি। যুগ যুগ ধরে মুসলিমরা সকল প্রকারের ক্রয় বিক্রয়, লেনদেন করার সময় দিনার দিরহামকে প্রধান বিনিময়ের মাধ্যম বলে গন্য করত। কিন্তু আজ তা বিলুপ্ত। দিনার ও দিরহামের নাম কুর’আনেও এসেছে। হাদিসে এসেছে অসংখ্য বার। হাদিসে এসেছে-
“মানবজাতির উপর এমন সময় অবশ্যই আসছে যখন দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ও দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) ছাড়া ব্যবহার করার মত বা উপকারী আর কিছুই থাকবে না।”
আমাদের উপর আল্লাহর অশেষ রহমত যে তিনি অর্থকেন্দ্রিক ইসলামের বিভিন্ন বিধান দিরহাম ও দিনারের হিসাবে আরোপ করেছেন। আল্লাহু আকবর। যদি এটা হারাম কাগুজে মুদ্রায় নির্ধারণ হত তাহলে পুরো নিজাম ভেঙ্গে যেত। ইংসা আল্লাহ আমরা তা আলোচনা করব।
দিরহাম দিনারের ইতিহাস
মানব ইতিহাসের প্রারম্ভ থেকে মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণ ও রূপা ব্যবহার করা হত। বারটার সিস্টেমের সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়ার পরে মানুষ স্বর্ণকে মুদ্রা হিসেবে গ্রহন করে নেই। ৫ হাজার বছর ধরে এই মুদ্রা ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। ফিরাউনের যুগে মিশরেও এই ব্যবস্থা চলত। সকল বড় বড় সাম্রাজ্য নিজেরা স্বীয় স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার বানাত। গ্রীক, রোমান, পারসিয়ান, সাসানিয়ান সহ প্রায় সকল বড় সাম্রাজ্য। যাইহোক, প্রথমে মুসলিমরা পারসিয়ান স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা ব্যবহার করত। উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতের সময়ের মুসলিমরা প্রথম বারের মতন মুদ্রা তৈরি করে। সেটা ছিল সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের আদলে রৌপ্যমুদ্রা বা দিরহাম। তারপরে ৭৫ হিজরি তথা ৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আবদুল মালিক অফিসিয়ালি ভাবে উমার ইবনে খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহুর মান অনুযায়ি দিরহাম প্রস্তুত করান। তিনি পূর্বের মানুষ ও পশুর চিত্র সম্বলিত কয়েন বন্ধ করে আল্লাহর নাম লিখে নতুন মুদ্রার প্রবর্তন ঘটান। এরপরে বিভিন্ন সময়ে এই মুদ্রা গুলোর উন্নয়ন ঘটে, এভাবে একসময় মুদ্রার এক পিঠে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ও ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ এবং অপরপিঠে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামসহ মুদ্রা ছাপানো হয়। ১৯২৪ সালে খিলাফতের ধ্বংসের সাথে সাথে দিনার ও দিরহাম মুদ্রা ব্যবস্থার পতন ঘটে।
দিরহাম পরিচিতি
দিরহাম হল রৌপ্যমুদ্রা। সাধারণত ৩ গ্রাম রূপা দিয়ে ১ দিরহাম তৈরি করা হয়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্যে রূপার পরিমানে হেরফের হয়েছিল তাই আমরা একাধিক মান পাই। উসমানি খিলাফতে ১ দিরহাম ৩.২০৭ গ্রাম রূপা দিয়ে তৈরি করা হত। দিরহামের মান নির্ধারণে ইমামদের মতভেদ রয়েছে, হানাফিদের মত ৩.১২৫ আর অন্য ইমামদের মতে ২.৯৬, এছাড়াও অনেকের মতে ২.৯৭৫ হল সঠিক মান। যাইহোক আমরা ধরব,
১ দিরহাম = ৩ গ্রাম রূপা
১ গ্রাম রূপার বর্তমান বাজার মূল্য হল ৪৬.২৬ টাকা। (আন্তর্জাতিক বাজারে রুপার মূল্য ১ গ্রাম= ৪৬.২৬ টাকা, কিন্তু দেশীয় বাজারে ১ গ্রাম= ৯০ টাকা, আমরা এখানে আন্তর্জাতিক মূল্যে হিসেব করব) তাহলে,
১ দিরহাম = ১৩৯ টাকা
যাকাতের নেসাব ২০০ দিরহাম হল ২৭,৮০০ টাকা
মহরে ফাতেমি ৫০০ দিরহাম = ৬৮০০০ টাকা
সর্ব নিম্ন বিয়ের মহর হল ১০ দিরহাম যার বর্তমান বাজার মূল্য হল ১৩৯০ টাকা।
শাফেয়ী মাজহাবে সর্বনিম্ন মহর হল ৩০ দিরহাম অর্থাৎ ৪১৭০ টাকা।
দিয়তের মূল্য হল ১০ হাজার দিরহাম= ১৩,৯০,০০০ টাকা।
একই ভাবে ১০০০ দিরহাম এর মূল্য হল ১,৩৯,০০০ টাকা।
হাদিস ও ইতিহাস থেকে দিরহামের কিছু উদাহরণ
আম্মাজান হযরত জায়নাব রাযিয়াল্লাহু আনহা তার বাৎসরিক ভাতার ১২ হাজার দিরহামের প্রায় সব দান করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি ১২ হাজার দিরহাম = ১৬,৬৮,০০০ টাকা দান করেছিলেন। খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা'র ভাতিজা যায়েদ বিন হারেসা রাযিয়াল্লাহু আনহু'কে ৪০০ দিরহামে কিনেছিলেন অর্থাৎ ৫৫,৬০০ টাকায়। সাধারণত তখন দাস দাসীর মূল্য ছিল প্রায় ৫০০ দিরহাম অর্থাৎ ৭০ হাজার টাকা।
ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “ইসলাম গ্রহনের সময় হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু’র নিকট ৪০ হাজার দিরহাম বা ৫৫৬০০০০ টাকা ছিলো। (দিরহামের আজকের বাজার মূল্য ১৩৯ টাকা হিসেবে) আর হিজরতের সময় ৫ হাজারের বেশি ছিল না। বাকি সব দিরহাম তিনি ইসলামের সাহায্যে এবং মুসলমান গোলাম কিনে আযাদ করার পেছনে ব্যয় করেছেন।” (ইবনে সাইদ সূত্রে তারিখুল খুলাফায় বর্ণিত) অর্থাৎ হিজরতের পূর্বে তিনি প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা ইসলামের জন্য ব্যয় করেন।
রুমা কূপ মদিনার সুপেয় পানি সরবরাহের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল। উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু তা ৩৫ হাজার দিরহামের বিনিময়ে অর্থাৎ ৪৮ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে ৫০ হাজার দিরহাম অর্থাৎ প্রায় ৭০ লক্ষ টাকার কর্জ নিয়েছিলেন যা পরে উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু মওকুফ করে দিয়েছিলেন।
উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু'র খিলাফতে বিচারকের মাসিক সর্বোচ্চ বেতন ছিল ৫০০ দিরহাম আর সর্বনিম্ন ছিল ২০০ দিরহাম। বসরায় সালমান ইবনে রাবিয়া রাযি. মাসিক ৫০০ দিরহাম বেতন পেতেন অর্থাৎ প্রায় ৭০ হাজার টাকা।
জিজিয়া- জিজিয়ার পরিমাণ অনির্দিষ্ট ছিল। শহর, ব্যক্তি ভিন্নতায় জিজিয়া তে ভিন্নতা ছিল। যাইহোক গরিবদের জন্য জিজিয়া হল ১২ দিরহাম, মধ্যবিত্তদের জন্য ২৪ দিরহাম। সবচেয়ে ধনী সারীর অমুসলিমদের জন্য এটা ছিল প্রায় ৪৮ দিরহাম অর্থাৎ ৬৬৭২ টাকা মাত্র। রাজ্যের সবচেয়ে ধনী অমুসলিমরা বছরে মাত্র ৬,৬৭২ টাকা জিজিয়া বা কর হিসেবে মুসলিম শাসককে প্রদান করবে। হাস্যকর হল বর্তমানে প্রত্যেক রাষ্ট্রের নাগরিক এর চাইতে অনেক বেশি ট্যাক্স দিয়ে থাকে কিন্তু জ্ঞানপাপীরা এটা নিয়ে প্রশ্ন করে না, শুধু জিজিয়া জিজিয়া বলে তারা চিৎকার করতে পারে।
দিনার পরিচিতি
দিনার হল স্বর্ণমুদ্রা। সাধারণত ৪.২৫ গ্রাম স্বর্ণে হয় ১ দিনার। এটা নিয়ে তেমন মতভেদ নেই যদিও কিছু আলেমের মতে ৪.২৩৫ গ্রাম স্বর্ণ হল ১ দিনার।
১ দিনার = ৪.২৫ গ্রাম স্বর্ণ
১ গ্রাম স্বর্ণের বর্তমান বাজার মূল্য হল ৩,৬০৭.৩০ টাকা। অর্থাৎ
১ দিনার = ১৫,৩৩১ টাকা
যাকাতের নেসাব ২০ দিনার সমান ৩,০৬,৬২০ টাকা।
দিয়তের ১ হাজার দিনার হল ১,৫৩,৩১,০০০ টাকা।
হাদিস ও ইতিহাস থেকে দিনারের কিছু উদাহরণ
তাবুক যুদ্ধে উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু ৯৪০টি উট ও ৬০টি ঘোড়ার পাশাপাশি ১০ হাজার দিনার দান করেছিলেন। ১০ হাজার দিনার অর্থাৎ ১৫ কোটি ৩৩ লক্ষ ১০ হাজার টাকা।
উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু'র খিলাফত কালে, মিশরের গভর্নর আমর ইবনুল আস রাযি. কে মাসিক বেতন দেয়া হত ২০০ দিনার অর্থাৎ ৩০,৬৬,২০০ টাকা। সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া রাযি.কে বেতন হিসেবে প্রতি বছর দেয়া হত ১০ হাজার দিনার। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকা।
বদর যুদ্ধের পূর্বে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে যে ব্যবসায়ী কাফেলা শাম থেকে মক্কায় যাচ্ছিল তাতে বাণিজ্যিক সম্পদের পরিমান ছিল মোট ৫০ হাজার দিনার অর্থাৎ প্রায় ৮০ কোটি টাকা। বদর যুদ্ধে বন্দীদের মুক্তিপণ হিসেবে মাথা প্রতি ৪০০ দিরহাম ধার্য করা হয়েছিল। অর্থাৎ ৫৫,৬০০ টাকা।
খাওয়ারিজ ইসলামিক স্টেট ২০১৪ সালের শেষের দিকে দিনার ও দিরহাম মুদ্রা তৈরি করেছিল। ২১ কেরেট গোল্ড এর ৪.২৫ গ্রাম দিয়ে এক দিনার প্রস্তুত করেছিল তারা। এছাড়াও তারা রূপা ও তামা'র মুদ্রা চালু করেছিল।
১৪০০ বছর আগে মক্কায় ৮০ দিরহাম অর্থাৎ সাড়ে ১১ হাজার টাকা দিয়ে একটি মাঝারি সাইজের উট পাওয়া যেত। যেহেতু উটের যোগান কম তাই এখন আমরা ৮০ দিরহামে একটি উট পাবো না। কিন্তু তখন ১ দিনারে একটি মেষ এবং একটি ছাগল পাওয়া যেত, অর্থাৎ ১৫৩৩১ টাকায়। মেষ ও ছাগলের যোগান উটের মত কম নয় তাই এখনো আমরা ১ দিনারে একটি মেষ বা একটি ছাগল কিনতে পারব।
শাম থেকে ইয়ামানের বাণিজ্যিক পথ এর কেন্দ্র বিন্দু ছিল মদিনা। শুধু মাত্র মক্কাবাসী মদিনা কেন্দ্রিক ট্রেড রুট ব্যবহার করা বাৎসরিক ২ লক্ষ দিনারের ব্যবসা করত। অর্থাৎ প্রায় ৩০৭ কোটি টাকার ব্যবসা হত।
আলী ইবনু আবদুল্লাহ (রহঃ) … উরওয়া বারিকী (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, "নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বকরী ক্রয় করে দেয়ার জন্য তাঁকে একটি দিনার (স্বর্ণ মুদ্রা) দিলেন। তিনি ঐ দ্বীনার দিয়ে দুটি বকরী ক্রয় করলেন। তারপর এক দ্বীনার মূল্যে একটি বকরী বিক্রি করে দিলেন এবং নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে একটি বকরী ও একটি দ্বীনার নিয়ে হাযির হলেন। তা দেখে তিনি তার ব্যবসা বাণিজ্যে বরকত হওয়ার জন্য দু’আ করে দিলেন। এরপর তার অবস্থা এমন হল যে, ব্যবসার জন্য যদি মাটিও তিনি খরীদ করতেন তাতেও তিনি লাভবান হতেন।" (সহিহুল বুখারী)
আমর ইবনু আলী (রহঃ) … ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, "তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে ঐ ব্যাক্তি সম্পর্কে বর্ণনা করেনঃ যে ব্যাক্তি হায়য অবস্থায় স্ত্রী সঙ্গম করে, সে এক দিনার অথবা অর্ধ দিনার সা’দকা করবে।" (সূনান নাসাঈ) অর্থাৎ যে লোক হায়য অবস্থায় আল্লাহ্র নির্দেশ সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও সহবাস করে তার উপর ১ দিনার অর্থাৎ ১৫৩৩১ টাকা বা অর্ধ দিনার সদকা করা ওয়াজিব।
গানীমাত হিসাবে দিনার
উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু'র খিলাফত কালে, আফ্রিকায় যুদ্ধে মোট ৩ কোটি দিনার গানীমাত অর্জন হয়েছিল। অর্থাৎ প্রায় ৪৬ লক্ষ কোটি টাকা। পদাতিক ১৮০০০ সৈন্য পেয়েছিল ১০০০ দিনার করে আর অশ্বারোহী ২০০০ সৈন্য পেয়েছিল ৩০০০ দিনার করে। বাইতুল মালে এক-পঞ্চমাংশ ছিল অর্থাৎ ৬০ লক্ষ দিনার।
জিজিয়া বাবদ আয়
চুক্তির ভিত্তিতে আজারবাইজান পদানত হয়েছিল তারা বার্ষিক ৮ লক্ষ দিরহাম জিজিয়া প্রদানের শর্তে চুক্তি করে। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা। জুরজান থেকে জিজিয়া বাবব আয় হত তিন লক্ষ দিনার অর্থাৎ ৪৬০ কোটি টাকা।
সবচেয়ে ধনী মুসলিম আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাযি
আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাবুক যুদ্ধে ৮ হাজার দিনার দান করেন। অর্থাৎ ১২ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা। তিনি তার একটি জমি ৪০ হাজার দিনারে অর্থাৎ প্রায় ৬১ কোটি টাকায় বিক্রয় করেন এবং পুরো অর্থ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেন। তিনি সাহাবীদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ছিলেন। এছাড়াও তিনি ৪০ হাজার দিরহাম অর্থাৎ ৫৬ লক্ষ টাকা, মুজাহিদদের জন্য ৫০০ ঘোড়া, ১৫০০ উট দান করেছিলেন। জীবিত বদরি সাহাবী ও আম্মাজানদের জন্য ৪০০ দিনার অর্থাৎ ৬২ লক্ষ করে হাদিয়া দিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ২০০ আউকিয়া বা অক্কা দান করেছিলেন। ১ অক্কা = ১২৮.৩ গ্রাম স্বর্ণ। সে হিসাবে তিনি প্রায় ১০ কোটি টাকা আল্লাহর রাস্তায় দান করেছিলেন। এসব হল ইতিহাসে পাওয়া সাহাবীদের বদান্যতার উদাহরণ আর তাদের গোপনে দান করা টাকার পরিমান কত ছিল তা আল্লাহই জানেন। আর আমরা ১০-২০-৫০ টাকা দান করে অহংকার অহমিকায় লিপ্ত হয়ে যাই। মনে ভাবি না জানি কত টাকা দান করে কত বড় দানবীর হয়ে গেছি।
আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহুর ইন্তেকালের সময় তার সম্পদের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে আজকের যুগেও মানুষ অবাক হয়। তিনি ইন্তেকালের সময় ৩১০,৩০,০০,০০০ (৩১০ কোটি ৩০ লক্ষ) দিনার রেখে যান। এটার বর্তমান মূল্য হল (৩১০,৩০,০০,০০০* ১৫৩৩১) = ৪৭,৫১,০০৩,৩০,০০,০০০ (অর্থাৎ ৪৭ লক্ষ ৫১ হাজার ৩ কোটি ৩০ লক্ষ) টাকা। ডলারের হিসাবে এটার মূল্য ৫০১ বিলিয়ান ডলার। ২০১৭ সালে বিল গেটসের মোট সম্পত্তি ছিল মাত্র ৮৬ বিলিয়ান ডলার।
এখন কিছু প্রশ্ন করি-
চিন্তা করুন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি ফাতেমা রাযিয়াল্লাহ আনহার মহর দিরহামে না নিয়ে আজকের কাগুজে মুদ্রায় নিতেন তাহলে কি হত?
চিন্তা করুন যাকাতের নেসাব টাকায় নির্ধারণ হলে কি সমস্যা হত?
ধরুন ফাতাওয়ার গ্রন্থে মহরে ফাতেমি ৫০০ দিরহাম না লিখে সোজা টাকার পরিমাণ লিখে দেয়া হল। এখন আপনি কিতাব খুলে পেলেন মহরে ফাতেমি হল ২৬,২৫০ টাকা (আপনাদের প্রশ্নের জওয়াব ২/১৩৭; ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া ২/৯৬- উভয় বই প্রায় ১৫ বছর আগে লেখা হয়েছে )। আর সর্বনিম্ন মহর পেলেন ৫২৫ টাকা। আপনি আজকেও এই ২৬,২৫০ টাকাকে মহরে ফাতেমি মনে করবেন। অথচ টাকার মূল্য সময়ের সাথে সাথে কমে, আর দিনার দিরহামের মূল্য কমে না। এতে কোনো ক্ষয় নেই। আপনি ৫০০ দিরহামের মূল্য হিসাব কষে বের করতে পারবেন। যা আজকের ৬৮ হাজার টাকা।
২০০১ সালে আপনি আলেমের কাছে শুনেছেন যাকাতের নেসাব হল ১০,৫০০ টাকা। তারপর আর আপনি নতুন করে জানার চেষ্টা করেন নি, কিংবা সরকার জনগনের সুবিধার্থে আলেমদের পরামর্শে ১০,৫০০ টাকাকে নেসাবের পরিমাণ হিসেবে ফিক্স করে দিল। তাহলে ১৮ বছর পর আজকেও যাদের কাছে ১০,৫০০ টাকা থাকত তাদের উপর যাকাত দেয়া ফরজ হত। আর ৫০ বছর পরে দেখা যাবে ১০,৫০০ টাকা দিয়ে বাজারে কিছুই কেনা যাবে না, ফকিরের দান পাত্রেও এত রকম থাকবে। তখন উক্ত ফকির উপরও যাকাত ফরজ হয়ে যাবে।
এমনি ভাবে ফিতরার মূল্য চাল, খেজুর বা পন্য দ্রব্যের দামে নির্ধারণ না হয়ে যদি টাকায় নির্ধারিত হত তাহলে এক সময় ফিতরার টাকা দিয়ে কয়েক চকলেট কেন যেত শুধু, চাল ডাল কেনা যেত না।
এটাই হল কাগুজে মুদ্রার অসারতা। দিনার দিরহামের মূল্য সব সময় সমান থাকে। এতে মুদ্রাস্ফীতি নেই। ৫ হাজার বছর ধরে দিনার দিরহাম চলছে। এখনো ইনফ্লেশন রেট 'জিরো'।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ১ দিরহাম দিয়ে একটি মুরগি কেনা যেত। আজো এক দিরহাম দিয়ে অর্থাৎ ১৩৯ টাকা দিয়ে মুরগি কেনা যায়। এমন কি ১০ বছর পরে আপনি ১৩৯ টাকা দিয়ে মুরগি পাবেন না কিন্তু ১ দিরহাম সমান মুল্যে অবশ্যই পারবেন। আরেকটু সহজ করি, ২০০৬ সালে ১ দিরহামের মুল্য ছিল ৭০ টাকা। তখন বাজারে মুরগির দাম ছিল ৬০ টাকা। তাহলে ২০০৬ সালেও এক দিরহাম দিয়ে একটি মুরগি কেনা যেত। এখনো এক দিরহাম দিয়ে মুরগি কেনা যায় তবে ৭০ টাকায় কেনা যাবে না। কারণ টাকার মুল্যমান কমে গেছে। এখন কিনতে হলে ১৪০ টাকা লাগবে। আর বর্তমান এক দিরহামের মুল্য ১৪০ টাকা।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ১ দিনার দিয়ে একটি ছাগল কেনা যেত। আজো এক দিনার দিয়ে অর্থাৎ ১৫,৩৩১ টাকা দিয়ে একটি ছাগল কেনা যায়। এমনকি ১০ বছর পরে আপনি ১৫,৩৩১ টাকা দিয়ে ছাগল কিনতে পারবেন না কিন্তু ১০০ কেন ১ হাজার বছর পরেও আপনি এক দিনার দিয়ে একটি ছাগল কিনতে পারবেন। এটাই হল হালাল মুদ্রা ব্যবস্থা ও হারাম মুদ্রা ব্যবস্থার পার্থক্য।
একটি সংশয়ের অপনোদন
আমাদের অনেকের মধ্যে একটি সংশয় রয়েছে। তা হল- রাসুল (সা) এর যুগে তো দীনার আর দিরহাম বানানো হয় নি তাহলে সুন্নাহ মুদ্রা আসল কিভাবে? ধরুন কাউকে প্রশ্ন করা হল ভাই গাড়িতে চলাচলের সুন্নাত কোনটা তখন উত্তরে বলা হল রাসুল (সা) এর সময়ে গাড়িই ছিল না তাহলে সুন্নাত আসবে কিভাবে? আসলে সুন্নাহ বস্তুর সাথে সব সময় সম্পৃক্ত থাকে না। অনেক সময় সম্পৃক্ত থাকে- বিষয়, কাজ, সময় ও বৈশিষ্টের সাথে।
রাসুল (সা) এর সময় ৬টি বস্তু মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হত। এবং তাই এ ছটি বস্তুর অসম বন্টনকে তিনি সুদ বলেছেন। আবু সাইদ খুদরি (রা) থেকে বর্ণিত,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-‘সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। যে বেশি দিবে অথবা বেশি নিবে সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। দাতা-গ্রহীতা এক্ষেত্রে সমান অপরাধী। (মুসলিম : ১৫৮৪)
এই ৬ টি বস্তুর কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যে বৈশিষ্ট্য গুলো অন্য বস্তুতে পাওয়া গেলে সেটাও সুন্নাহ মুদ্রা হতে পারে, আর পাওয়া না গেলে তা সুন্নাহ মুদ্রা হবে না এমনকি অবস্থাভেদে তা বাতিল বলে সাব্যস্ত হবে। দিনার ও দিরহাম সহ সাময়িক স্থায়িত্ব আছে এমন ভোগ্য পন্য মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমরা একে সুন্নাহ মুদ্রা বলতে পারি। আর কাগুজে মুদ্রাই ওই বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় না, অন্যদিকে তা প্রতারণা তাই কাগুজে মুদ্রা স্পষ্টই হারাম। আরো জানতে এই পোস্ট পড়তে পারেন। সুন্নাহ মুদ্রার বৈশিষ্ট্য ও বর্তমানে প্রচলিত কাগুজে নোট - https://www.facebook.com/E.Kaisar.Ahmed/posts/1308577312496271
আবু বকর ইবন আবি মরিয়ম হতে বর্ণিত যে তিনি আল্লাহর নবী (সাঃ)- কে বলতে শুনেছেন, মানবজাতির উপর এমন সময় অবশ্যই আসছে যখন দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ও দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) ছাড়া ব্যবহার করার মত বা উপকারী আর কিছুই থাকবে না।- (মুসনাদ, আহমদ)
সহায়ক ওয়েবসাইট-
- http://www.livepriceofgold.com/bangladesh-gold-price.html
- http://www.islamicmint.com/dinar-dirham.html
- http://www.e-nisab.com/misc
- http://musliminc.com/abdur-rahman-ibn-awf-the-richest-muslim-who-bought-his-way-to-jannah-4012
সহায়ক গ্রন্থ-
- আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া
- A Brief History of Money in Islam and Estimating the Value of Dirham and Dinar - M. Zarra Nazhad
- স্বর্ণ দিনার ও রৌপ্য দিরহাম- শাইখ ইমরান হোসেন
- আমিরুল মুমিনিন উসমান ইবনু আফফান রাযি- ড. যুবায়ের মুহাম্মাদ
- উমার ইবনুল খাত্তাব রাযি- ড. সাল্লাবী
- আসহাবে রাসূলের জীবনকথা- ড. মুহাম্মাদ আবদুল মাবুদ
- ফাতাওয়া গ্রন্থ- ফাতাওয়ায়ে রাহমানি, নির্বাচিত ফাতাওয়ায়ে মাদানিয়া, আপনার প্রশ্নের জওয়াব, ফাতাওয়ায়ে উসমানী
কাগুজে মুদ্রার প্রতারণা, ও বর্তমান দুনিয়ার অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে আরো জানতে পড়তে পারেন-
- কাগুজে মুদ্রা, স্বর্ণের পাহাড়, ডলারের ফাঁদ, সুদের ছিটা--- https://goo.gl/OsYEJB
- কাওমে শুআইব (আঃ) এবং বর্তমান ফ্যাসাদময় বিশ্ব ও মুদ্রাস্ফীতি ---- https://bit.ly/2KoPgI7
- সুন্নাহ মুদ্রার বৈশিষ্ট্য ও বর্তমানে প্রচলিত কাগুজে নোট ---- https://bit.ly/2je7rDJ
- ডলারের পতনঃ চীন ও রাশিয়া’র স্বর্ণ মজুদকরন ----- https://bit.ly/2r985XE