জীবনের উদ্দেশ্য কী আর সেই উদ্দেশ্যে নিজের জীবনকে কীভবে ধারণ করতে হবে, এটা বুঝে আমরা অনেকেই পুরোনো ভুল জীবনযাপন ধরনকে বদলে ফেলি। তখন বেশ কঠিন কিছু পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
আপনি যেদিন থেকে জীবনকে যখন *কেবলমাত্র* আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ধারণ করতে চাইবেন, যেদিন পুরোনো অর্থহীন কাজকর্ম আর পরিচিতমহলের, বন্ধুমহলের তুচ্ছ সব কথাবার্তা, গীবত, পরশ্রীকাতর আলাপ, হট জোক্স টাইপের আলাপ থেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে আনতে চাইবেন — তখনই আপনার বন্ধুশূণ্যতা হবে, নিজেকে হয়ত নিজভূমে পরবাসী মনে হবে, কখনো কখনো নিজেকে ভুল ভুল মনে হতেও পারে…
এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এই বিভ্রমের ঔষধ হলো, আরেকবার চোখটা বন্ধ করুন, স্মরণ করুন সেই প্রিয়তম জনকে, যার জন্য আপনার ত্যাগ স্বীকার। যিনি আপনাকে অনেক ভালোবাসেন, যিনি আপনাকে, আমাকে, আমাদেরকে অল্প ক’দিনের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, যার কাছে আমরা আবার ফিরে যাব। আমাদের এই জীবনের তিনি এমন সব পুরষ্কার সাজিয়ে রেখেছেন, যা কোন চোখ দেখেনি, কোন হৃদয় কল্পনা করতে পারবেনা — এতই সুন্দর আর মনোরম সেই আয়োজন।
এইটুকু পাপ, নিরর্থক কথাবাজি, নোংরা ফান-জোকস, অনর্থক হিংসা-বিদ্বেষ-কাম-ক্রোধকে এড়িয়ে চলার কারণ কি? সেই সুমহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, তাকে ভালোবেসেই তো, তাইনা? যিনি সবকিছুর মালিক, তিনি কি আপনার এই একাকীত্ব আর কষ্টের বিনিময় দিতে আদৌ দেরি করবেন?
আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন পরম ভালোবাসায় আর যত্নে, তিনি কি আপনার, আমার এই অনুভূতিগুলো হবে, তা জানতেন না? তার ঔষধের কথাও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন আমাদেরকে। চারপাশের জগতের অস্থিরতা, অন্যায়, খারাপ কাজ থেকে আপনার আমার হৃদয়ে শূণ্যতা জাগবে, অস্থিরতা জাগবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাইতো মনে রাখতে হবে,
“যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তিলাভ করে;জেনে রাখ,আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়” [সূরা আর-রাদ : ২৮]
যিকরের সঠিক অর্থ কি? এর পরিধিই বা কতটুকু? এটা কি শুধুমাত্র মুখে কিছু শব্দমালা, যেমন ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উচ্চারণ বা কুরআনের কিছু বাছাইকৃত আয়াত তিলাওয়াতের নামান্তর, নাকি এগুলো থেকেও বেশি কিছু এর সাথে যুক্ত? অবশ্যই এধরনের কিছু শব্দমালা মুখে উচ্চারণ বা কিছু আয়াত তিলাওয়াত গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত: এগুলো যিকরের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ রূপ, কারন সর্বোত্কৃষ্ট স্মরণ সেটাই যেটাতে হৃদয় এবং জিহবা দুইটাই যুক্ত থাকে। তবে যিকরের পরিধি আরো ব্যাপক।
ইমাম ইবনুল কায়্যিমের মতে জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত অর্থাৎ যখন কেউ কিছু চিন্তা করে, বলে অথবা কোনো কাজ করে, সবই যিকরের অন্তর্ভুক্ত যদি তা আল্লাহতা’লার পছন্দনীয় হয়। অতএব আমাদের কথাবার্তা যদি আল্লাহর কথা দিয়ে পূর্ণ হয় তবে তা যিকরের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের সব কাজ যদি আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয় তাহলে সেগুলোও যিকর হিসেবে বিবেচিত হবে। বস্তুত আল্লাহ পছন্দ করেন যে আমরা যেন দাড়িয়ে বসে এমনকি শুয়ে — সর্বাবস্থায় তাঁকে স্মরণ করি। আর এরই মাধ্যমে আমাদের অন্তর শান্তি পাবে। [১]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরো কত সুন্দর সুন্দর স্মরণিকা দিয়েছেন আমাদের জন্য, আমাদের প্রাণকে শান্ত করতে, মনকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিতে, আশ্বস্ত করতে…
“…বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে।… ” [সূরা আল বাকারা ১৮৬]
” তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। …” [সূরা গাফির – ৬০]
“হে মুমিন গন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিতই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন।” [সূরা আল বাকারা : ১৫৩]
“সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।” [সূরা আল বাকারা : ১৫২]
যেই আল্লাহকে ভালোবেসে আপনার এই ত্যাগ, এটা তো কিছুই না! যেই জান্নাত আপনাকে দেয়া হবে, সেইটা অনন্তকালের জন্য। সেখানে পাপাসক্ত বান্দারা যাবেনা, সেখানে যাবেন সুন্দর আত্মার মানুষেরা। সেখানে তারা থাকবেন আল্লাহর সন্তষ্টির ছায়াতলে, শান্তিই শান্তি সেখানে… সেখানকার যোগ্য হতে হলে তো সেই নিষ্কলুষ মনকে ধারণ করার চেষ্টা করতে হবে, তাইনা? যারা আল্লাহকে ভালোবেসে জীবনধারণ করেছেন, তাদেরকে অজস্র পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রহিমাহুল্লাহ) একটা সুন্দর কথা বলেছেনঃ
“ঈমানদারদের জীবন ক্রমাগত বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করানো হয় তাদের ঈমানকে বিশুদ্ধ এবং তাদের পাপকে মোচন করানোর জন্য। কারণ, ঈমানদারগণ তাদের জীবনের প্রতিটি কাজ করেন কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য; আর তাই জীবনে সহ্য করা এই দুঃখ-কষ্টগুলোর জন্য তাদের পুরষ্কার দেয়া আল্লাহর জন্য অপরিহার্য হয়ে যায়।”
[মাজমু’আল ফাতাওয়া : ভলিউম ১৮/ ২৯১-৩০৫]
আল্লাহ আমাদের ধৈর্য্যধারণ করার, তার কৃতজ্ঞ বান্দা হবার এবং তাকে সন্তুষ্ট করতে পারা বান্দা হবার তাওফিক দিন।