প্রিয় নবী (ﷺ) বলেছেন, “নিশ্চয় কিয়ামতের দিন বান্দার যে কাজের হিসাব সর্বপ্রথম নেওয়া হবে তা হচ্ছে তার নামায। সুতরাং যদি তা সঠিক হয়, তাহলে সে পরিত্রাণ পাবে। আর যদি তা পণ্ড ও খারাপ হয়, তাহলে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।“ [আবু দাউদ, তিরমিযি, ইবনু মাজাহ]
দুঃখজনকভাবে, আমাদের অনেকের জীবনে এমন একটি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে যখন ফরয নামাযসমূহ আদায়ের ব্যাপারে আমরা ছিলাম উদাসীন। কারও হয়তো বিশ, তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ বা ষাটের কোঠায় এসে বোধোদয় হয়েছে যে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায নিয়মিত আদায় করা উচিত। কেউ হয়তো ছোটবেলায় নামাযে নিয়মিত ছিলাম কিন্তু একটি বয়সে এসে নামায ছেড়ে দিয়েছি; লম্বা একটা বিরতির পর এখন আবার নামাযে নিয়মিত হতে শুরু করেছি।
বয়সন্ধির সময় থেকে নিয়ে মৃত্যু অবধি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী প্রত্যেক নর ও নারীর উপর ফরয। আমরা যারা বছরের পর বছর ধরে আমাদের ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কর্তব্যটি পালনের ব্যাপারে রীতিমতো গাফেল ছিলাম কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে যেভাবেই হোক বোধোদয় হয়েছে তাদের করণীয় কী? সেই প্রসঙ্গ নিয়েই আজকের সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা।
১. ফরয নামায পরিত্যাগকারী ব্যক্তির বিধান:
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেছেন, “কোনো ব্যক্তি এবং শিরক ও কুফরের মাঝের পার্থক্যরেখা হলো নামায।” [মুসলিম]
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয – এই বিষয়টিকে কেউ যদি অস্বীকার করেন তাহলে আলিমদের সর্বসম্মত মত হলো সেই ব্যক্তি ইসলামের গন্ডি থেকে বেরিয়ে গেছেন, অর্থাৎ তিনি মুরতাদ হয়ে গেছেন।
পক্ষান্তরে, কেউ যদি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয – এই বিষয়টিকে স্বীকার করেন ঠিকই কিন্তু একইসাথে অলসতা, উদাসীনতা ইত্যাদি কারণে তা আদায় না করেন তাহলে তার বিধান কী হবে তা নিয়ে আলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। সালাফি ঘরানার আলিমদের মতে শিরক ও কুফরের মধ্যেকার পার্থক্যরেখা নামায ছেড়ে দেওয়ার কারণে সেই ব্যক্তি কুফরিতে লিপ্ত হয়েছেন এবং এর ফলে তার অতীতের যাবতীয় নেক আমল বরবাদ হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে, সুন্নি ইসলামের প্রধান চারটি মাযহাবের মূলধারার মত হলো অলসতা বা উদাসীনতার কারণে নামায ছেড়ে দেওয়ার কারণে তাকে কাফির বলে অভিহিত করা যাবে না, বরং তাকে ফাসিক বলা যেতে পারে।
২. অতীতের ছুটে যাওয়া ফরয নামাযসমূহের ব্যাপারে করণীয়:
উপরের অনুচ্ছেদ থেকে আমরা দেখলাম যে, ফরয নামায পরিত্যাগকারী ব্যক্তিকে কাফির বলা হবে নাকি তাকে ফাসিক বলে আখ্যায়িত করা হবে – মূলত এটি নিয়েই আলিমরা মতপার্থক্য করেছেন। কুফরিতে লিপ্ত ব্যক্তি ইসলামে আবারও ফেরত আসলে তার বিধান একরকম। ফাসিকিতে লিপ্ত ব্যক্তি সৎপথে ফিরলে তার বিধান আরেকরকম। উভয় মত অনুযায়ী এই বিষয়ে আমাদের করণীয় কী হওয়া উচিত তা নিচে বর্ণনা করা হলো।
মত ১ - ছুটে যাওয়া নামাযের কাযা আদায় করতে হবে
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নামাযের কথা ভুলে যায় কিংবা নামায না পড়ে ঘুমিয়ে থাকে তার কাফফারা হলো যখন নামাযের কথা স্মরণ হবে তখন তা আদায় করা।” [বুখারি]
হাদিসটিতে “نسي” শব্দটিকে ভুলে যাওয়া অর্থে অনুবাদ করা হয়েছে। কোনো কাজকে অবহেলা করে ছেড়ে দেওয়া অর্থেও “نسي” শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। “نسي” শব্দটির দ্বিতীয় এই অর্থটিকে বিবেচনায় নিলে ভুলে যাওয়া ও ঘুমিয়ে পড়ার পাশাপাশি অলসতা বা উদাসীনতার কারণে ছুটে যাওয়া নামাযসমূহেরও কাযা আদায় করতে হবে।
হানাফি, মালিকি, শাফিঈ ও হাম্বলি মাযহাবের মূলধারার মত অনুযায়ী অতীতের ছুটে যাওয়া প্রতিটি ফরয নামাযের কাযা আদায় করতে হবে।
কাযা নামাযের সংখ্যা হিসাব করার পদ্ধতি:
বয়সন্ধির সময় থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায কোনো ব্যক্তির উপর ফরয হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে বয়সন্ধির লক্ষণ হলো ‘স্বপ্নদোষ’ হওয়া এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে এর লক্ষণ হলো ঋতুস্রাব শুরু হওয়া।
এখন, বয়সন্ধি শুরু হওয়ার সময় থেকে নিয়ে আজকে পর্যন্ত কোন ওয়াক্তের কত নামায কাযা হয়েছে তা হিসাব করতে হবে। হিসাবটি শতভাগ সঠিক না হলেও সঠিকের যতটুকু কাছাকাছি যাওয়া যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। এরপর হিসাব রেখে একে একে ছুটে যাওয়া এই নামাযসমূহের কাযা আদায় করে যেতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, ১২ বছর বয়সে কারও বয়সন্ধি শুরু হয়েছে। কিন্তু, নামাযের ব্যাপারে তিনি ছিলেন বেখেয়াল। ২২ বছর বয়স থেকে তিনি নামাযে নিয়মিত হতে শুরু করেন। এখন, মাঝখানের এই দশ বছরে তার যতগুলো নামায কাযা হয়েছে তা হিসাব করে একে একে আদায় করে যেতে হবে।
জুমু’আর নামায ছুটে গিয়ে থাকলে তার স্থলে যুহরের কাযা আদায় করতে হবে।
মেয়েদের জন্য ঋতুস্রাব ও সন্তান প্রসব পরবর্তী স্রাবের সময়ে নামায ফরয নয়, ফলে কাযা নামাযের হিসাবের সময় ওই দিনগুলো বাদ দিতে হবে।
কাযা নামায আদায় করার পদ্ধতি:
অতীতের ছুটে যাওয়া এই নামাযসমূহের কাযা আদায়ের ক্ষেত্রে ক্রম রক্ষা করা জরুরী নয়।
একটি পদ্ধতি হতে পারে এরকম – ফজরের নিয়মিত নামাযের পাশাপাশি অতীতের ছুটে যাওয়া একটি ফজরের কাযা। যুহরের নিয়মিত নামাযের পাশাপাশি অতীতের ছুটে যাওয়া একটি যুহরের কাযা। আসরের নিয়মিত নামাযের পাশাপাশি অতীতের ছুটে যাওয়া একটি আসরের কাযা। মাগরিবের নিয়মিত নামাযের পাশাপাশি অতীতের ছুটে যাওয়া একটি মাগরিবের কাযা। এশার নিয়মিত নামাযের পাশাপাশি অতীতের ছুটে যাওয়া একটি এশার কাযা।
আবার, এভাবে না করে যার জন্য যেভাবে সুবিধা হয় সেভাবেও কাযা এই নামাযসমূহ আদায় করা যেতে পারে।
সুন্নত নামায নাকি কাযা নামায?
শাফিঈ মাযহাবের মূলধারার মত হলো, কারও অতীতের ফরয নামাযের কাযা আদায় করা বাকী থেকে থাকলে তা আদায় করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি অন্য কোনো সুন্নত বা নফল নামায আদায় করবেন না। এমনকি সুন্নতে মুআক্কাদা বা তারাবীহ নামাযও নয়।
অন্যদিকে, হানাফি মাযহাব অনুযায়ী সুন্নতে মুআক্কাদা নামায ত্যাগ করাকে অভ্যাসে পরিণত করলে তা গুনাহের কারণ হতে পারে। অতীতে কৃত পাপাচারের কারণে বর্তমানে গুনাহে লিপ্ত হওয়া শোভনীয় নয়। ফলে, হানাফি মত অনুযায়ী নিয়মিত ফরয নামাযের পাশাপাশি সুন্নতে মুআক্কাদা নামাযসমূহও আদায় করে যেতে হবে। সেইসাথে, নিয়ম করে অতীতের ছুটে যাওয়া ফরয নামাযসমূহের কাযাও আদায় করতে হবে।
এই উভয় মতের মাঝামাঝি অবস্থান পাওয়া যায় মালিকি মাযহাবে। মালিকি মত অনুযায়ী, কাযা আদায়কারী ব্যক্তি কেবলমাত্র হাদিসে বর্ণিত সুন্নত ও নফল নামাযসমূহ চাইলে আদায় করতে পারেন। এর বাইরে, অতীতের কাযা নামাযসমূহ আদায় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিজে থেকে বাড়তি কোনো নফল নামায তিনি আদায় করবেন না।
সব নামাযের কাযা আদায় করার আগেই মারা গেলে?
নিয়ম করে অতীতের ছুটে যাওয়া প্রতিটি ফরয নামাযের কাযা আদায় করে যেতে থাকা সেই সময়কার কৃত পাপের তাওবারই একটি অংশ। এরই মধ্যে মৃত্যু চলে আসলে কোনো সমস্যা নেই। বান্দা যে চেষ্টা করেছে আল্লাহ তার মূল্যায়ন অবশ্যই করবেন।
ব্যতিক্রম:
কোনো অমুসলিম ব্যক্তি যদি ইসলাম গ্রহণ করেন তাহলে তিনি সেইদিন থেকে ফরয নামায আদায় করতে শুরু করবেন। অতীতের কোনো নামাযের কাযা তাকে আদায় করতে হবে না।
একইভাবে, মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী কোনো ব্যক্তি যদি জীবনের এক পর্যায়ে এসে নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী হয়ে যান কিংবা তিনি অন্য কোনো ধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং এরপর আবারও ইসলামে ফিরে আসেন তাহলে যে সময়টুকু তিনি নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী বা অমুসলিম ছিলেন সেই সময়কার ছুটে যাওয়া নামাযের কাযা তাকে আদায় করতে হবে না।
মত ২ - ছুটে যাওয়া নামাযের কাযা আদায় করতে হবে না
আল্লাহ বলেন (মর্মার্থ): “… যে ব্যক্তি ঈমান আনে, সৎকর্ম করে, অতপর সরল পথে প্রতিষ্ঠিত থাকে আমি তার পক্ষে পরম ক্ষমাশীল।” [কুরআন ২০:৮২]
সালাফি ঘরানার আলিমদের মতে ইচ্ছাকৃতভাবে ফরয নামায ত্যাগ করা কুফরি। ফলে, তাদের মত অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যখন অতীতের কৃতকর্মের জন্য আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হয়ে আবারও নিয়মিত নামায আদায় করতে শুরু করলেন তখন তিনি যেন একটা সময় ইসলামহীন অবস্থায় থাকার পর নতুন করে আবারও ইসলামে প্রবেশ করলেন। কোনো অমুসলিম ব্যক্তি ইসলামে প্রবেশ করার পর যেমন তাকে অতীতের কোনো নামাযের কাযা আদায় করতে হয় না, ঠিক একইভাবে ফরয নামায ত্যাগ করার কারণে কুফরিতে লিপ্ত কোনো ব্যক্তিকেও নতুন করে নামাযী হওয়ার পর অতীতের ত্যাগকৃত নামাযসমূহের কাযা আদায় করতে হবে না।
সালাফি মত অনুযায়ী, অতীতে যা হওয়ার হয়েছে। তাওবাকারীর তাওবা আল্লাহ কবুল করেন। এখন থেকে নিষ্ঠার সাথে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায নিয়মিত আদায় করে যেতে হবে। সেইসাথে, প্রচুর পরিমাণে সুন্নত ও নফল নামাযও আদায় করতে হবে। প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “…যদি তার ফরয (ইবাদাতের) মধ্যে কিছু কম পড়ে যায়, তাহলে প্রভু বলবেন, ‘দেখ তো! আমার বান্দার কিছু নফল (ইবাদাত) আছে কি না, যা দিয়ে ফরযের ঘাটতি পূরণ করে দেওয়া হবে?’ অতঃপর তার অবশিষ্ট সমস্ত আমলের হিসাব ওইভাবে গৃহীত হবে।” [আবু দাউদ, তিরমিযি, ইবনু মাজাহ] আশা করা যায়, নফল এই নামাযসমূহের কল্যাণে বান্দার ফরয নামাযের ঘাটতিকে আল্লাহ পূরণ করে দেবেন।
৩. শেষ কথা …
অতীতে ইচ্ছাকৃতভাবে নামায পরিত্যাগ করার কারণে কিছু প্রায়শ্চিত্ত তো আমাদেরকে করতেই হবে। সুন্নি ইসলামের প্রধান চারটি মাযহাবকে মানদন্ড হিসেবে ধরলে অতীতের ছুটে যাওয়া প্রতিটি ফরয নামাযের কাযা আদায় করার মাধ্যমে। আর সালাফি ভাবাপন্ন হয়ে থাকলে প্রচুর পরিমাণে নফল নামায আদায় করার মাধ্যমে।
অতীতে ফরয নামায ত্যাগ করে আমরা অনেক বড় গুনাহ করে ফেলেছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে অনেকদিন পরে হলেও অবশেষে আমাদের বোধোদয় হয়েছে। তাঁর ক্ষমা অনেক প্রশস্ত। আন্তরিকভাবে তাঁর দিকে ফিরে আসলে বান্দার গুনাহসমূহকে তিনি মাফ করে দেন। তাঁর রহমত থেকে নিরাশ হতে তিনিই তো আমাদের নিষেধ করেছেন।