ছিমছাম পরিপাটি একটি মসজিদ। প্রশান্ত পরিবেশ। গভীর মনোযোগ দিয়ে নামায পড়ছে এক যুবক। পরিচ্ছন্ন পোশাকে তার রুচির ছাপ। কি অসাধারন একাগ্রতা তার নামাযের প্রতিটি কাজে! যুবকটি যেন পার্থিব সকল বন্ধন ছিন্ন করে তার প্রভুর সামনে হাজির! এ যেন জীবন্ত নামায, প্রকৃষ্ট ইবাদাত।
পেছন থেকে দুই মুসল্লি এই যুবকের নামায উপভোগ করছিল। মুখ ফুটে একজন বলেই ফেললো: আহ! কি সুন্দর নামায! যুবক শুনল তার প্রশংসা; আড়ষ্ট না হয়ে সে দ্বিগুণ উত্সাহে নামায চালিয়ে গেলো; বুঝিবা একটু বাড়িয়েই দিলো রুকু- সিজদার দৈর্ঘ্য!
নামায একসময় শেষ হলো। সালাম ফিরিয়ে যুবক পেছনের মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বললেন: আমি কিন্তু রোজাও রেখেছি! সুবহানআল্লাহ! কার জন্য এই ইবাদাত? নিজের জন্য? লোক দেখানোর জন্য? নাকি আল্লাহর জন্য?
আপনারা যারা ইন্টারনেটে আমেরিকার বিভিন্ন স্কলারদের লেকচার শোনেন, আপনাদের এই গল্পটি শোনা থাকার কথা। বহুল প্রচলিত গল্প এটি। ইবাদাতের সিন্সিয়ারিটি নিয়ে দেয়া বক্তৃতায় প্রায়ই এই গল্পটি উল্লেখ করা হয়, সাবধান করে দেয়া হয়।
সুনান ইবনে মাযায় শাদ্দাদ ইবনে আউস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত বিখ্যাত এক হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “আমার উম্মাহর জন্য যে জিনিসটি আমি সবচেয়ে বেশি ভয় করি তা হলো লোক দেখানো কাজ এবং হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে রাখা বাসনা!” আর এই “গোপন শিরক” নিয়ে প্রথম যুগের উলামারা পাহাড়সম বিশ্লেষণ করেছেন। কারণ অন্য এক হাদীসে এই “গোপন শিরক”-কে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উম্মাহ-র জন্য সবচেয়ে ভয়ের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। হাদীসের ভাষ্য হলো: “আমার উম্মাহ-এ শিরক মাঝ রাতে পাথরের উপর হেঁটে চলা পিপড়ার থেকেও বেশি গোপন।” সহজেই বুঝা যায় যে এখানে স্পষ্ট প্রতীয়মান শিরক তথা মূর্তি পুজার কথা বলা হচ্ছে না। এখানে বলা হচ্ছে এমন কিছুর কথা যা খুবই সূক্ষ্ম। এখানে কিসের কথা ইঙ্গিত করা হচ্ছে তা হাদীসের প্রেক্ষাপট থেকে সহজেই বুঝা যায়; আর তা হলো আমাদের মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা প্রতীমা! কারণ মূর্তিপূজার নিরর্থকতা বোঝা খুব কোন কঠিন কাজ নয়। বরং আত্মপূজার নিরর্থকতা বুঝাটা বড় কঠিন এক কাজ। মনের ভিতরের প্রতীমা! অন্তরের অন্তঃস্থলে আমরা নিজেদের এক প্রতীমা স্থাপন করে তারই পূজা অর্চনায় সারাজীবন কাটিয়ে দেই, অনেকক্ষেত্রে আত্মাহুতিও দিয়ে বসি! আর এটিই হলো “গোপন শিরক”, যার থেকে আমাদের প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের সাবধান করে গেছেন।
এই গোপন শিরক-এর সম্পর্ক আমাদের লোকজনের অনুমোদন লাভের বাসনার সাথে; এর সম্পর্ক আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির অদূরদর্শিতার সাথে, যার কারণে আমরা সত্য-ন্যায় আর মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির বিপরীতে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। এর চুড়ান্ত পরিণাম আমাদের কিবলার বিভক্তি। কিবলা হলো আল্লাহ প্রদর্শিত পথ, যে পথে আমাদের চলার কথা। যে পথে আমাদের জন্য রয়েছে আনন্দ, সন্তুষ্টি, তৃপ্তি, আর স্বীকৃতি। সুস্থ হৃদয় প্রকৃষ্টভাবে কিবলামুখী জীবন যাপন করে। আর যখনই হৃদয় অসুস্থ হয়ে পড়ে, কিবলা পরিবর্তিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এই পরিবর্তনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এমনও দেখা যায় যে কিবলা ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে নিজের দিকেই ফিরে আসে! অবস্থার এমনই অবনতি হয় যে ইবাদাতের কাজেও আল্লাহর সাথে বান্দাহ অন্যকে জুড়ে দেয়! “এই বুঝি কেউ আমায় দেখলো!”, “দেরীতে মসজিদে ঢুকলে কেউ কিছু বলবেনাতো?”, “কোন কাপড়টা আজকে পরা উচিত?”, “আমি যেভাবে বসেছি তাতে আমার সম্বন্ধে সঠিক ধারণা লোকে পাচ্ছেতো?” এসব চিন্তা আমাদের অবচেতন মনের গভীরে ঢুকে পড়ে; আর ভাগ বসায় আমাদের কিবলামুখীতায়।
অন্য এক বিখ্যাত হাদীসে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত: “কারো ক্ষতির জন্য এইটুকুই যথেষ্ট যে মানুষ তার দিকে আঙ্গুল তুলে ইশারা করা আরম্ভ করে।” অন্যভাবে বলা যায়, মানুষ যখন অন্যের বাহ্যিক চলাফেরায় পার্থিব বা পরকালীন সাফল্যের আভাস পায়, তখনই তাকে নিয়ে বলাবলি শুরু করে, গুরুত্ব দেয়া আরম্ভ করে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভক্তি- শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে! আর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা অনুযায়ী কারো মন্দ পরিণামের জন্য এতটুকু মনোযোগ আকর্ষণই যথেষ্ট। কেন? কারণ মানুষের পক্ষে এই অতিরিক্ত মনোযোগকে গুরুত্ব না দেয়াটা খুবই শক্ত। একে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেয়ার মতো প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি- শৃঙ্খলা বা মনোযোগ, কোনটাই সহজ নয়। আর এখানে এর থেকেও জটিল প্রশ্ন জড়িত। উদাহরণস্বরূপ প্রশ্ন তোলা যায়, একজন মানুষের কতখানি আত্মমর্যাদা থাকতে পারে বা কতোখানি অনুমোদিত? আমাদেরতো নিজেদের একদম ওয়ার্থলেস ভাবার কথা নয়! আমরা জানি যে আল্লাহ-র আইনের একটা মূল উদ্দেশ্যই হলো মানুষকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মর্যাদা দান করা, যেমনটি আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি” (সূরা আল ইসরা: ৭০)
আমরা আদমের সেই সম্মানিত সন্তানসন্ততি। শারিয়াহ স্বীকৃত মানুষের একটা মৌলিক অধিকারই হলো মর্যাদা লাভের অধিকার। কিন্তু আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দাহ হিসাবে কোথায় আমাদের যুক্তিগ্রাহ্য মর্যাদার সীমানা শেষ, কোথায়ইবা বাগাড়ম্বর আর লোক দেখানোর শুরু?
আর এখানেই এই দুইয়ের মাঝে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। যেমনটি কঠিন গভীর রাতের আঁধারে পাথরের গায়ে চলে ফেরা কালো পিপড়াটাকে সনাক্ত করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা এই পার্থক্য করতে ভুল করি, দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হই। এই রোগ ধরার বেশকিছু উপায় আছে, আর বুদ্ধিবৃত্তির সঠিক ব্যবহারকে এক্ষেত্রে স্কলাররা গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা যখন কোনকিছুতে পূর্ণ মনোযোগ না দেই, তখনই আমাদের নাফস আমাদের নিয়ে মজা করা শুরু করে। ধরুন কেউ এসে আপনাকে বললো, “তোমার নতুন গাড়িটা আমার হেভি পসন্দ হইসে!” আমরা যদি তখন সতর্ক থাকি, ফোকাসড থাকি, আমরা ভাববো: “তো, তাতে কি? বহুত মানুষেরই তো নতুন গাড়ি আছে, এ আর এমন কি? নতুন গাড়ি থাকার কারণে কি আমার সম্মান দুই ইঞ্চি বেড়ে গেছে?” সম্পূর্ণ ফোকাসড থাকলে এই উপসংহারে আসা খুবই সহজ। কিন্তু আমাদের মন কি আর সবসময় কমপ্লিটলি ফোকাসড থাকে? নাফসের পছন্দের একটি কাজ হলো আমাদের চিন্তাকে ঝাপসা করে দেয়া! আর তখন, অর্বাচীনের মতো, এই অযৌক্তিক প্রশংসার হাওয়ায় আমরা ভাসতে থাকি!
চলুন এবার আমরা দেখি আমাদের স্কলাররা এর থেকে মুক্তির কী প্রেসক্রিপশন আমাদের দেন! যখন মানুষ আপনাকে অকারণে সম্মান দেখানো শুরু করে এবং আপনার ভয় হয় যে আপনি তাতে আমোদিত হচ্ছেন, মনের ভেতরের প্রতিমা আপনার ফোকাসে পরিণত হচ্ছে, তখন প্রথম যে কাজটি আপনাকে করতে হবে তা হলো: চিন্তা! যে বিষয় নিয়ে আপনার প্রশংসা করা হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করুন। “আমার নতুন গাড়ীর জন্য আমাকে বাড়তি খাতির করাটা কি যুক্তিগ্রাহ্য?” অথবা প্রশংসা যদি দ্বীন সংক্রান্ত হয়, যা কিনা আরোও ধ্বংসাত্মক, “ভাই, আপনাকে দেখলাম সবার শেষে মাগরিবের সুন্নাত শেষ করলেন! মাশাআল্লাহ ভাইজান! আপনি নিশ্চয়ই অনেক জানেন! প্লীজ আমারে এই ফতোয়াটা একটু দেননা ভাই!” এরকম ধারণা মানুষজন হরদম পোষণ করে; কারণ আমরা যা দেখি তার ভিত্তিতেই ধারণা পোষণ করি। এসব ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, আমাদের ইগো এধরণের প্রশংসায় খুব আহ্লাদিত হয়, নিজেকে বড় ভাবা শুরু করে। আর এখানেই আমাদের বুদ্ধিমত্তার হস্তক্ষেপ জরুরী। আপনাকে এরকম মুহূর্তে নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে, নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে হবে, বিবেচনা করতে হবেঃ “আচ্ছা, সে নাহয় দেখলোই যে আমি সবার শেষে নামায শেষ করেছি, কিন্তু সে তো আর জানেনা আমি নামাযে আদৌ মনযোগী ছিলাম কিনা! আমার হয়তো এক্স গুণটি আছে, কিন্তু আমার তো ওয়াই, জেড, এ, বি, এমন আরও অনেক দোষও আছে, যেগুলো এই লোক কখনোই দেখবেনা!” নিজের সাথে এমন বোঝাপড়া আসলে খুবই সহজ, কারণ আমরা সবাই নিজের জীবনের এমনসব দিকের কথা জানি যা মোটেও দর্শনীয় নয়, যা সবার অগোচরে থাকুক তাই আমরা চাই। যখনই কোথাও অযথা প্রশংসা শোনা যাবে, যখনই লোকে আপনাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া শুরু করবে, তখনই, অনেকটা রিফ্লেক্স অ্যাকশনের মতো, নিজের দোষের কথা মনে করাটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।
স্কলারদের আরেকটি পরামর্শ হলো এমন পরিস্থিতিতে খ্যাতির বিড়ম্বনার কথা খেয়াল রাখা। খ্যাতির একটি মস্ত নেগেটিভ দিকও রয়েছে, আর অচেনা থাকার মধ্যেই রয়েছে নিরাপত্তা! গোড়াতেই দেখবেন, বিখ্যাত মানুষ মাত্রেই লোকে তাকে ঈর্ষা করে; বিশেষ করে খ্যাতিটা যদি পার্থিব কারণে হয়, তাইলে তো কথাই নেই; ধার্মিক কারণে খ্যাতিমানরাও এই ঈর্ষা থেকে মুক্ত থাকেন না! গুজব, সন্দেহ, ঈর্ষা, নানান চাল, এসবকিছুরই শিকার হন বিখ্যাত ব্যক্তিরা! এই বিড়ম্বনা অনেক ক্ষেত্রেই খ্যাতির ঠুনকো আনন্দের থেকে বহুগুণ বেশী খারাপ।
কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের বক্তব্য হলো, সেলিব্রেটি কালচার তো ইহকাল বা পরকাল কোথাওই সুখের সন্ধান দেয়না। আমাদের সময়ের বিখ্যাত ব্যক্তিদের দেখুন, কতো হাজারো রকম সমস্যা তাদের! এযুগের সেলিব্রিটিদের দুই এক্সট্রীমের যেকোনো একটিতে পাওয়া যাবে: হয় তারা অ্যাকাডেমি এ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের মধ্যমণি, আইডল; সকল সমালোচনার উর্দ্ধে তাঁর অবস্থান। নতুবা হয়তো তাকে পাওয়া যাবে কোন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে, তেরো নাম্বারবারের মতো তিনি সেখানে ভর্তি হয়েছেন! নতুবা তাঁর পার্টনার তাকে ফেলে চলে গেছে! অনেকটা টাইগার উডস সিনড্রোম এর মতো ব্যাপারটা: তাঁরা যেন তাঁদের খারাপ কাজের জন্যই বিখ্যাত! কিন্তু এর মধ্যে সিরিয়াস মূল্যায়নটা কোথায়? সবই কেমন যেনো হাল্কা আর ঠুনকো। এ যেনো এক সার্কাস! দুঃখের কথা হলো বিশ্ব সংস্কৃতি যেনো ক্রমেই এই ঠুনকো সার্কাসেই পরিণত হচ্ছে!
তো এই সূক্ষ্ম শিরক থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় আছে কি? আমাদের স্কলাররা আবারও যে বিষয়টি আমাদের মনে করিয়ে দেবেন তা হলো: পুরো ব্যাপারটাই আসলে ক্ষণস্থায়ী, খুবই শর্ট টার্ম ডীল! আপনার নতুন গাড়ি অথবা আপনার লম্বা নামাযের প্রশংসায় আজ যে লোক পঞ্চমুখ, পঞ্চাশ বছর পর কোথায় থাকবে সে? মাটির নীচে! কোথায় থাকবেন আপনি? ওই ওখানেই! আপনার আগে এসে চলে যাওয়া আরো হাজারো মানুষের মতো আপনিও পরিণত হবেন স্মৃতিতে! খুব বেশী দিনের ব্যাপার নয়, তাই না? কুরআনের একটা মৌলিক শিক্ষাই হলো: “তোমরাতো পার্থিব জীবনকেই অগ্রাধিকার দাও। অথচ পরকালের জীবন উত্কৃষ্ট ও স্থায়ী।” (সূরা আল- আ’লা: ১৬- ১৭)
এক্ষেত্রে আবারও বুদ্ধিবৃত্তির ভূমিকাই মুখ্য। বুদ্ধিমান মানুষের স্ট্যাটাস আল্লাহর কাছে অনেক বেশি, কারণ বুদ্ধিমত্তা আল্লাহ প্রদত্ত সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ। এই বুদ্ধিমত্তার প্রতি সুবিচার আমরা তখনই করব যখন একে আমরা আত্মবিশ্লেষণের কাজে ব্যবহার করব। আর এই আত্মবিশ্লেষণের কাজটা কিন্তু বেশ মজার! কারণ আমাদের ইগো আসলে বোকার মতো কাজ করে বেড়ায়! এর কাজকর্ম বড়ই হাস্যকর, ক্লাউনের মতো! সে আমাদের বোকা বানাতে চায়, কিন্তু এই কাজে সে আসলে খুবই অপটু! “শয়তানের চক্রান্ত নিতান্তই দুর্বল”; কারণ তার হাতিয়ারতো কেবল ছায়া, আর বিভ্রম! সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী হলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা। আর তার কৌশলই সর্বোত্তম।
“গোপন শিরক” থেকে মুক্তির আর কি কোনো উপায় আছে? স্কলারদের আরেকটি পরামর্শ হলো: আপনার যাকিছু ভালো (হোক তা কোন বস্তু, বা কোন ভাল কাজ), তা নিজের মধ্যে রাখুন; আড়াল করে রাখুন সবার থেকে। মাগরিবের পরে যদি ৬ রাকা’ত সুন্নত পড়তেই হয়, মসজিদে না পড়ে বাসায় গিয়ে পড়ুন। এতে করে নামাযে আপনার মনোযোগও বেশী থাকার সম্ভাবনা বাড়বে, আবার অবাঞ্ছিত খ্যাতি ও এর থেকে উদ্ভূত হিংসা- বিদ্বেষ, ঈর্ষা থেকেও আপনি মুক্ত থাকবেন। Just keep it quiet! পাখির রাজ্যে চড়ুই যেমন নিতান্তই নগণ্য, প্রায় অদৃশ্য, তেমনটি থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজেকে এমনই গুটিয়ে রাখুন, যেন আপনি দৃষ্টির আড়ালের কেউ! তাইলেই দেখবেন কেউ আপনাকে বাড়তি খাতির করছেনা, আলগা সম্মান দেখাচ্ছেনা। এটি এমনই এক অনুগ্রহ যা আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাহদের দান করে থাকেন। হাদীসের অনেক বিখ্যাত স্কলার এই অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন! খালিদ ইবনে মা’দান-এর কথাই ধরা যাক; বিখ্যাত এই হাদীস বিশারদ যখনই দেখতেন তাঁর পাঠচক্রে ছাত্রের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তিনি ক্লাস থেকে উঠে চলে যেতেন! মসজিদের সবচেয়ে বড় ক্লাসের শিক্ষক হওয়ার খ্যাতি তাঁর পছন্দের ছিলনা! আত্মপূজার ধ্বংসাত্মক পথ পরিহার করার জন্যে তিনি হাদীস শিক্ষাদানের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকাকেও উত্তম মনে করতেন!
মলিন পোষাক আর এলোমেলো চুলের লোক, যার দিকে কেউ দ্বিতীয়বার তাকায় না, একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লাই জানেন তাঁর কাছে এই লোকের কী মর্যাদা! আমাদের ধর্মের বাস্তবতা এটাই। আল্লাহতো আপনার চেহারা বা ধন-দৌলত দিয়ে আপনার বিচার করেন না! তাঁর বিচারের বিষয়বস্তু হলো আপনার অন্তর আর আপনার কাজ। নিরহংকার আর নম্র জীবনযাপন করা শক্ত কাজ, খুবই কঠিন; কিন্তু এমন জীবনেই রয়েছে প্রশান্তি, ট্রানকুইলিটি! আমাদের আল্টিমেট চাওয়া হলো একটা স্ট্রেস ফ্রী লাইফ! কিন্তু নাম ডাক আর খ্যাতি জীবনে অনেক স্ট্রেস নিয়ে আসে, যা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের চুড়ান্ত প্রার্থনা হলো আল্লাহর যিকির, স্মরণ; কারণ আল্লাহর যিকিরের মধ্যেই আত্মা প্রকৃত শান্তি খুঁজে পায়। ইউটিউবে মিলিয়ন হিট, ফেইসবুকে বিলিয়ন ফ্রেন্ড আর বন্ধুদের আলোচনার মধ্যমনি – কোনটিই প্রশান্তি দেয় না। এগুলোর মাঝে শান্তি খুঁজে বেড়ানো আর মরিচীকায় পানির খোঁজ, দুটো আসলে একইরকম নির্বোধের কাজ!
অতএব, আমরা দেখলাম যে ধর্মই আমাদের ইহকালীন কল্যাণ আর পরকালীন মুক্তির পথ দেখিয়ে দেয়। দুনিয়ার শান্তি, আর আখেরাতের সফলতা আসলে দিনশেষে একই জিনিস! ব্যালান্সড জীবনযাপন করে এই পৃথিবীতে শান্তি লাভের উপায় হচ্ছে মানুষের আলগা মনোযোগ আর খাতির যত্ন, আলগা সম্মান, তোষামোদ- এগুলোর প্রতি নির্বিকার থাকা। কয়েকবছরের মধ্যে যে মানুষগুলা মারাই যাবে, তাদের মতামতের কি এমন মূল্য! আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মূল্যায়নগুলোতো সঠিকও থাকে না! প্রকৃত সুখী জীবনের মূলমন্ত্র হলো আত্মার প্রশান্তি অর্জন; আর একথা স্মরণ রাখা দরকার যে কিবলা বা ডিরেকশন আসলে একটাই: “বলুন (হে নবী): আমার নামায, আমার কুরবাণী, আমার জীবন, আমার মরণ, সবই বিশ্বপ্রভূ আল্লাহর জন্যে। তাঁর কোনো অংশীদার নেই…” (সূরা আল আন’আম: ১৬২- ১৬৩)।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা একমাত্র বিচারক। আর আমদের চূড়ান্ত বিচার একমাত্র তিনিই করবেন। সেই ট্রাইব্যুনালে তিনি ছাড়া অন্য কেউ থাকবে না, জুরীবোর্ড থাকবে না কোনো! তিনি একক, অপ্রতিরোধ্য। একমাত্র তাঁরই কাছে জবাবদিহি করার জন্যে আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। এই বিশ্বাসে এতোখানি দৃঢ়তা অর্জন করতে হবে যাতে করে আমরা মান সম্মান, খ্যাতি, প্রতিপত্তির মতো অনর্থক ব্যাপার-স্যাপার দ্বারা প্রতারিত না হই। এগুলোর প্রকৃত মূল্য দিতে আমরা যেন ভুল না করি। এগুলো যেন আমাদের পরীক্ষায় ফেলে না দেয়, ইনশাআল্লাহ। আমাদের ইবাদাত যেন হয় আমাদের সামগ্রিক জীবনের প্রতিচ্ছবি: কেবলমাত্র বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ডের প্রভূ আল্লাহর জন্য। আমাদের আল্লাহর কাছে দুআ করতে হবে যেন তিনি আমাদেরকে সুনাম, খ্যাতি, যশ এবং এরকম অন্যান্য আবর্জনা, যা আমাদের অন্তরের শান্তি নষ্ট করে, তার দ্বারা পরীক্ষা না করেন। আমরা যেন অকপট শান্তির একটা জীবনের পর এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করি যে অবস্থায় আল্লাহ আমাদের উপর সন্তুষ্ট থাকেন, ইনশাআল্লাহ।
বিঃ দ্রঃ লেখাটি প্রফেসর আব্দুল হাকিম মুরাদ (Timothy John Winter) –এর একটি লেকচার দ্বারা অনুপ্রাণিত।
অক্টোবর 26, 2014