মানুষ হিসেবে আমাদের মধ্যে সঙ্গ লাভের প্রকৃতিগত একটি আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। একজন মানুষকে পাবার আকাঙ্ক্ষা যার সাথে নিজের জীবন ভাগাভাগি করে নেয়া যায়, এমন একজন যে জীবনে সুখ ও আনন্দ বয়ে আনবে এবং কষ্টের সময় সান্ত্বনার উৎস হবে- এটি একটি অপরিহার্য মানবিক অনুভূতি। ইসলাম এই প্রয়োজনকে স্বীকার করে এবং নিকাহ্ তথা বিবাহের মাধ্যমে এটিকে বৈধতা প্রদান করেছে। এই পবিত্র কাজ দুজনকে নৈতিক ও সম্মানিত প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র একত্রই করে না, বরং আল্লাহ্কেও এমন পর্যায়ে সন্তুষ্ট করে যে এটিকে আমাদের দ্বীনের অর্ধেক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হাদিস অনুসারে, একজন ধার্মিক স্বামী ও স্ত্রী যারা সার্থক বিবাহ সম্পাদন করেছে তাঁরা একত্রে জান্নাতে থাকবে। একজন ব্যক্তি তার মাতা, পিতা, ভাই, বোন, মেয়ে, ছেলে অথবা অন্য কারো সাথে জান্নাতে থাকবে না, কিন্তু থাকবে তার স্বামী বা স্ত্রীর সাথে।
প্রিয়জনের সাথে জান্নাতে চিরকাল থাকা- সবার কি এটি স্বপ্ন নয়? কিভাবে আমরা পরম সুখের এই স্তরে উপনীত হতে পারব, যেখানে আমরা স্বতন্ত্রভাবে বিবাহের সমীকরণে অর্ধেক মাত্র? যদি আমরা উভয়েই বিবাহের ভিতর ও বাহির এবং আমাদের প্রভূকে সন্তুষ্ট করার উপায়গুলি জানা ও বুঝার জন্য যথাযথ প্রচেষ্টা চালাই, তখনই আমাদের এই মিলনের সফলতার জন্য কিছুটা অবদান রাখতে পারব, ইনশাআল্লাহ্।
বিবাহ খুব ভীতিকর মনে হতে পারে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে বিবাহের হার হ্রাস পেয়ে ইতিহাসের তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে, কিন্তু বিবাহিত হবার এই রেকর্ড সৃষ্টিকারী কম সংখ্যা হওয়া সত্ত্বেও বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা আবার শীর্ষে পৌঁছেছে। এ যুগে বিবাহ এমন একটি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে যেটিকে খুব হালকা হিসেবে ধরা হয়, এত হালকাভাবে যে স্বামী বা স্ত্রীকে তালাক দেওয়া এখন সদ্য কেনা অপ্রয়োজনীয় পণ্য ফেরত দেওয়ার মত সহজ হয়ে গিয়েছে। মানুষ যেটি ভুলে গেছে বলে মনে হচ্ছে তা হল বিবাহ জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র অংশ এবং এভাবেই এটিকে গণ্য করা অপরিহার্য।
বিবাহকে কিভাবে সাফল্যমন্ডিত করা যায় এ বিষয়ে অনেক আলোচনা ও বই রয়েছে। এ ব্যাপারে একটি অন্যতম খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে আমাদের সচেতন থাকতে হবে সেই সব বিষয়ের প্রতি যেগুলি বিবাহকে অন্তর্ঘাত করতে পারে, যেন আমরা ক্ষতিকর পরিণতিকে এড়িয়ে চলতে পারি। একজন ব্যক্তি যে ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছে সে শুধুমাত্র এটা দেখে না যে কিভাবে ব্যবসা গড়ে তুলতে হবে ও মুনাফা অর্জন করতে হবে, সে সেই ব্যবসা সংক্রান্ত ঝুঁকি সম্পর্কেও জ্ঞান লাভ করে যেন সেগুলিকে প্রশমিত ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ব্যবসায়ীর এই জ্ঞান সম্ভাব্য সকল সমস্যাকে এড়িয়ে চলতে সাহায্য করে অথবা অন্তত সামনে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে এ ব্যাপারে কিছুটা সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে।
তেমনিভাবে একটি স্বার্থক বিবাহ সম্পাদন করা সহজ নয় এবং এর জন্য স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের প্রচেষ্টারই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। উভয়ের সচেতন থাকতে হবে যে জীবন সবসময় পুষ্পশয্যা থাকে না এবং ভালো সময়ের মত খারাপ সময়ও অবধারিতভাবে আসবেই। এই যাত্রা শুরু করার আগে বিবাহ সংক্রান্ত কিছু ফিকহ্ (ইসলামী আইন) জানা ও বুঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধুমাত্র মসজিদে আসা, ইমামের সম্মুখে কিছু শব্দ শুনে শুনে বলা এবং পূর্বনির্ধারিত মহর পরিশোধ করার চেয়েও বেশি কিছু।
এ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করার সুযোগ আমাদের জন্য রয়েছে- সঙ্গী নির্বাচন থেকে শুরু করে বাগ্দান এবং স্বয়ং বিবাহের আনুষ্ঠানিকতাও। যখন বর ও কনে এই প্রক্রিয়ার আগাগোড়া এবং বিবাহের সময়েও আল্লাহর আইন কে অনুসরন করার কঠোর প্রচেষ্টা চালায়, তাঁরা এই মিলনের মধ্যে আরো বেশি রহমত লাভ করে।
সঠিক সঙ্গী অনুসন্ধানঃ
যখন আপনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে আপনি বিবাহের জন্য প্রস্তুত, প্রথম পদক্ষেপ হল সঠিক সঙ্গী খোঁজা, যেটি মাঝেমধ্যে একটি কষ্টকর অভিজ্ঞতা হতে পারে। একজন সঙ্গী নির্বাচনের সময় কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে- ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, সৌন্দর্য কিন্তু সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল কিভাবে এবং কতটুকু ইসলাম ও সুন্নত সে পালন করে। যদি আপনি বাস্তবিকই একটি সুখী বিবাহ কামনা করেন, এটি অবশ্যই এমন একজনের সাথে হতে হবে যে আপনার সাথে ভাল ব্যবহার করে কারণ সে আপনার অধিকারসমূহ সম্পর্কে অবগত আছে এবং অনুধাবন করে যে সে আল্লাহর কাছে এই ব্যাপারে হিসাব দিতে বাধ্য। এগুলি মাথায় রেখে এমন একজন মুসলিমকে বিবাহ করা যুক্তিযুক্ত হবে যে নিজেও তার সঙ্গীর মধ্যে একই গুণাবলী প্রত্যাশা করে। কাউকে প্রাথমিকভাবে তার সম্পদ, সৌন্দর্য অথবা পেশার উপর ভিত্তি করে বিবাহ করা মাঝে মাঝে দুর্দশাজনক হয়ে দাঁড়ায়, যদি সে ঈমান ও আমলের দিক থেকে আপনার সমপর্যায়ের না হয় এবং আপনি তাকে আপনার পর্যায়ের ধার্মিক হিসেবে প্রত্যাশা করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে অনেক মুসলিম পুরুষের মধ্যে অমুসলিম নারীদের (খ্রিস্টান ও ইহুদী) বিবাহ করতে চাওয়ার একটি প্রবণতা রয়েছে এই অজুহাতে যে তারা তাদেরকে ইসলামের মধ্যে নিয়ে আসবে। এক্ষেত্রে সমস্যা হল যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামী তার স্ত্রীকে ঈমানের দিকে পরিচালনা করার জন্য খুব কঠোরভাবে প্রচেষ্টা চালায় না এবং সে নিজেই এই ব্যাপারে খুব দুর্বল। তার নিজের ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি আত্ননিয়োগ করার মাত্রা মোটেও অনুপ্রাণিত করার মত নয়। ভিন্ন ধর্মের মানুষকে বিবাহ করা অনেক ক্ষেত্রে গভীর দুঃখ ও কষ্ট জন্ম দেয়, বিশেষ করে যখন এই সমীকরণে সন্তানের আবির্ভাব ঘটে। কিভাবে সন্তানদের গড়ে তোলা হবে এ বিষয়ে বিবাহের চুক্তিনামায় চুক্তি ও অঙ্গীকার করা যায়, কিন্তু তখন কি হবে যদি বিবাহই ভেঙ্গে যায়? এজন্য আন্তঃধর্মীয় বিবাহকে বিশেষভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
যাই হোক, বাকি জীবন সাথে কাটানোর জন্য শেষ পর্যন্ত যাকেই আপনি নির্বাচন করেন, জেনে রাখুন আপনারা পরস্পর একত্র হয়েছেন কারণ আল্লাহ্ এটি হওয়ার জন্য হুকুম করেছেন। যখন দুইজন ব্যক্তি- পুরুষ ও নারী বিবাহের জন্য একত্র হয়, তারা ভবিষ্যতের কথা জানে না এবং এটিও জানে না যে তারা পরস্পরের জন্য উপযুক্ত হবে কি না। কিন্তু মনে রাখবেন যে আল্লাহ্ পরস্পর বিপরীত ধরণের দুজন মানুষের মধ্যেও ভালবাসা ও বোঝাপড়া তৈরি করতে সক্ষম। এজন্য দু’আ করা এবং আল্লাহর সাহায্যের জন্য শুধুমাত্র তাঁর উপরই ভরসা করা অত্যাবশ্যকীয় কারণ আমাদের অন্তরসমূহ একমাত্র তাঁরই নিয়ন্ত্রণে।
পরিচয় পর্ব শেষে উভয় পক্ষ যখন বিবাহের ব্যাপারে সম্মত হয়, সাধারণত এক ধরনের বাগ্দান অনুষ্ঠিত হয় যেটির পরে পাত্র ও পাত্রী পরস্পরের ব্যাপারে জানার জন্য আকাঙ্ক্ষা করতে পারে। এখানে গুরুত্বের সাথে লক্ষণীয় যে, ইসলামী আইন অনুসারে বাগ্দানের পরেও বর ও কনে পরস্পরের জন্য অসম্পর্কিত ব্যক্তি এবং অবৈধ, এবং এ কারণে একত্রে নিভৃতে সময় কাটানো নিষিদ্ধ। এ কারণে জোরালোভাবে পরামর্শ দেওয়া হয় যে বাগ্দান প্রলম্বিত করাকে পরিহার করা এবং যখন উভয় পরিবার বিয়ের ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় তখন বিলম্ব না করে অন্তত অনাড়ম্বরভাবে নিকাহ্ করিয়ে দেওয়া। এই কথার মাধ্যমে আমি বুঝাচ্ছি যে দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে গোপনীয়ভাবে নিকাহ্ করানো। পিতামাতার এ ব্যাপারে নমনীয় হওয়া প্রয়োজন এবং নিকাহ্ ব্যতিরেকে লম্বা সময় বাগ্দান করিয়ে রাখার ব্যাপারে একগুঁয়ের মত পীড়াপীড়ি করা অনুচিত। এ পদক্ষেপগুলি নিলে পাত্র ও পাত্রী আল্লাহর রহমত ও তাদের বিবাহের মধ্যে কল্যাণকে ধ্বংস করবে না এবং অবৈধ সাহচর্য থেকে উদ্ভূত দুর্যোগ থেকে বাঁচতে সক্ষম হবে। নিকাহ্ করানো হলে তারা একত্রে বসবাস না করলেও পরস্পরের সাথে যোগাযোগ ও একে অপরকে চেনার কাজটি বৈধভাবে করতে পারবে। পরবর্তীতে বিস্তারিত বিবাহ অনুষ্ঠান ও অভ্যর্থনা হতে পারে যেখানে আরো আত্নীয় ও বন্ধুবান্ধবদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।
বিবাহের পুনরাবৃত্তি?
বিবাহের পুনরাবৃত্তি? হ্যাঁ! প্রচলিত ধারণার বিপরীতে নিকাহ্ একবারের বেশিও পড়ানো যায়। প্রকৃতপক্ষে কিছু কিছু আলেমদের যেমন ইমাম ইবনে আবিদিন শামী এর মতে, স্বামী-স্ত্রীর উচিৎ মাঝেমধ্যে তাদের বিবাহকে সতেজ করা। মানুষ মাঝে মাঝে না বুঝে অধার্মিক বা অশ্লীল কথা বলে ফেলে যেটি কুফরের বাক্য, যা তাদের ঈমানকে নষ্ট করে এবং বিবাহ ভেঙ্গে যাবার কারণ হয়। ঈমান পুনর্বহাল হয় কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করা বা পরবর্তী ওয়াক্তের নামাজ আদায় ইত্যাদির মাধ্যমে, কিন্তু বিবাহ আপনা আপনি পুনর্বহাল হয় না, এবং অবশ্যই আবার করতে হয়, অন্যথায় এই দম্পত্তি গুনাহের সাথে একত্রে বসবাস করতে থাকবে।
দেওবন্দের মরহুম মুফতি নিযামুদ্দিন আ’যামী কিছুদিন ধরে এক দম্পত্তির বৈবাহিক সমস্যার কারণে পরামর্শ দিচ্ছিলেন। একদিন তিনি সাক্ষী হিসেবে দুজনকে ডাকলেন ও এই দম্পত্তিকে আবার নিকাহ্ করিয়ে দিলেন। তাদের মধ্যেকার বিরোধগুলি দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল। তারা তাঁর কাছে পুনরায় এলো ও অবাক হয়ে জানতে চাইলো কিভাবে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে গেল। তিনি ব্যাখ্যা করলেন যে যখন তাদের সাথে যোগাযোগ চলছিল, তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে তারা তাদের কথাবার্তার প্রতি সতর্ক ছিল না এবং সম্ভবত দম্পত্তির কেউ একজন রাগান্বিত অবস্থায় ধর্মবিরোধী কথা উচ্চারণ করে এবং এভাবে বিবাহ ভেঙ্গে যায়। বিবাহের অনুপস্থিতিতে তারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের জীবন যাপন ব্যভিচারে পরিণত হয়েছিল। সুতরাং তাদেরকে পুনরায় নিকাহ্ করানোর কারণে বৈধ সম্পর্কের রহমত ফিরিয়ে আসে ও তাদের বহু সমস্যা দূরীভূত হয়ে যায়।
আপনার অভিধানে ‘বিবাহবিচ্ছেদ’ থাকা উচিৎ নয়ঃ
ছোট অথবা বড় মাপের বিরোধ অনেক বিবাহিতদের মধ্যেই ঘটে থাকে। অত্যাবশ্যকীয় হল কখনোই বিবাহবিচ্ছেদকে একটি বাছাইযোগ্য বস্তু হতে না দেওয়া বা আপনার শব্দভান্ডারের একটি শব্দও হতে দেওয়া।
অন্যান্য ধর্মের ব্যতিক্রম ইসলামে বিবাহবিচ্ছেদ বৈধ, কিন্তু এটি আমাদের রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে ধর্মের মধ্যে অন্যতম বৈধ অথচ নিকৃষ্ট কাজ হিসেবে। ইসলাম স্বীকার করে যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদই একমাত্র সমাধানের মাধ্যম, তাই এই পথকে খোলা রাখা হয়েছে, কিন্তু তা হতে হবে একেবারে শেষ অবলম্বন হিসেবে।
বিবাহবিচ্ছেদের ধারণাকে আজকাল খুব হালকাভাবে নেওয়া হয়। নিতান্ত তুচ্ছ কারণে অথবা স্বামী বা স্ত্রীকে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করার হুমকি হিসেবে বিবাহবিচ্ছেদ করা হয়। কল্পনা করুন এমন এক বিবাহের মধ্যে থাকার যেখানে আপনি অবিরাম আতঙ্ক এবং অত্যন্ত সতর্কতার মধ্যে আছেন কারণ আপনি জানেন না আপনি কি বলে ফেলেন বা করে ফেলেন যেটির কারণে আপনার সঙ্গী বলার হুমকি দেয় বা উচ্চারণ করে ‘ত’ শব্দটি?
মুসলিমদের জানা থাকা দরকার এই ব্যাপারটি কতটা নাজুক এবং বিবাহবিচ্ছেদ করা কতটা সহজ। এই বিষয়ে অজ্ঞানতা অত্যন্ত ব্যাপক। কোন স্ত্রী তর্ক-বিতর্কের মাঝেও যদি স্বামীর কাছে বিচ্ছেদ চায় এবং স্বামী বলে ‘আচ্ছা’ তাহলে বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয়ে যায়। একইভাবে, যদি স্বামী বলে ‘আমি তোমাকে তালাক দিলাম’ অথবা ‘তুমি তালাকপ্রাপ্ত’ তাহলেও হয়ে যায়! এ কারণেই তালাক শব্দটি আপনার শব্দভান্ডার থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে যেন দীর্ঘ চিন্তা ভাবনা ব্যতিরেকে অসাবধানতাবশত এটি প্রয়োগ না হয়ে যায়।
বিবাহবিচ্ছেদ ইসলামের তিনটি জিনিসের মধ্যে একটি, যেটিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অথবা কৌতুক হিসেবেও যদি বলা হয় তাহলে এটি একটি আইনসম্মত বাক্য হিসেবে কার্যকর হয়ে যায়। একমাত্র ব্যতিক্রম হল যদি কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ থাকে (উন্মাদ) এবং নিজে কি বলে তা জানে না বা স্মরণ রাখতে পারে না।
একটি প্রত্যাহারযোগ্য বিবাহবিচ্ছেদ (তালাক রাজ’ই) এর পর অপেক্ষার একটি সময় থাকে (‘ইদ্দত’ বলা হয়, ৩টি ঋতুস্রাব চক্রের সময়কাল) যে সময়ের মধ্যে স্বামী ও স্ত্রী তাদের মধ্যেকার বিরোধ মিটমাট করে নিতে পারে এবং তাদের আসল বিবাহ অটুট থাকে। যদি স্বামী তার স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বেই ইদ্দত কাল শেষ হয়ে যায়, তখন এই জুটিকে বিবাহিত থাকতে হলে আবার নিকাহ্ করতে হবে। তবে ‘ইদ্দত কালীন সময়ে আসল নিকাহ্ বৈধ থাকে’- এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র দুই বার ঘটতে পারে। তৃতীয় তালাক দেবার পরে যদি কোন জুটি আবার একত্র হতে চায়, তাদেরকে অবশ্যই একটি প্রক্রিয়ায় যেতে হবে যার নাম ‘হালালা’।
‘হালালা’ প্রক্রিয়াঃ
‘হালালা’ হল ইদ্দতের সময় অতিবাহিত হওয়ার পর যখন স্ত্রী অন্য একজন পুরুষকে বিবাহ করে এবং তার সাথে বিবাহকে পূর্ণাঙ্গতা দান করে (অর্থাৎ শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করা)। বিবাহকে পূর্ণতা দান করার পরে যদি এই দ্বিতীয় স্বামী তাকে তালাক প্রদান করে, সে তার প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যেতে পারে এবং বিবাহ করতে পারে। যদি সেই দ্বিতীয় স্বামী এই জুটিকে সাহায্য করার জন্য দয়া হিসেবে স্ত্রীকে তালাক দেয়, এটি একটি সৎকর্ম হিসেবে গণ্য হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে বিচ্ছেদ হওয়া স্বামী-স্ত্রীর কাছে এ বিবাহের পূর্বেই তার এই উদ্দেশ্যের কথা প্রকাশ করে দেয়। তাই নতুন স্বামীর সাথে বিবাহকে পূর্ণাঙ্গ (অর্থাৎ শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন) করার সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ‘হালালা’ শর্তসাপেক্ষে হওয়া যাবে না, যার অর্থ হল তালাকপ্রাপ্ত নারী অন্য পুরুষকে এই শর্ত ঠিক করে বিবাহ করতে পারবে না যে সে বিবাহ করে পূর্ণতা লাভের পর তালাক দিয়ে দিবে যেন সে তার প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যেতে পারে। যদি এটি শর্তসাপেক্ষে করা হয় তবে এই কাজ হবে হারাম এবং রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিস অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট সবাই অভিশপ্ত হবে।
জটিল মনে হচ্ছে? সেটি সম্ভবত পরিকল্পিত। এর থেকে আর বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলা যায় না যে একটি দম্পত্তিকে লম্বা সময় কঠোরভাবে ভাবতে হবে যেন তারা এই দশায় না পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে যে কোন কারণে (মূর্খতা বা ক্রোধবশত) কিছু পুরুষ এক বারেই তিন তালাক দিয়ে ফেলে। তারা মনে করে শুধুমাত্র তিন বার দিলেই কাজ হবে এবং এর থেকে কম কার্যকর হবে না। কি হত যদি মেজাজ শান্ত হবার পর তারা মিটমাট করতে চাইতো? কল্পনা করে দেখুন ‘হালালা’ প্রক্রিয়ার মধ্যে যাবার কথা যেটি উপরে বর্ণনা করা হয়েছে এবং যে নারীকে আপনি ভালবাসেন তাকে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ফেলতে? আমি এখানে নির্দিষ্টভাবে পুরুষদের সম্বোধন করে বলছি কারণ সবগুলি তালাক একসাথে দেওয়ার ক্ষেত্রে তারাই দায়ী। তারা তাদেরকে প্রদত্ত ইচ্ছামত কাজ করার স্বাধীনতার অপব্যবহার করে। যদিও অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে বিচ্ছেদই একমাত্র উপায়, সে ক্ষেত্রেও একটি মাত্র তালাক যথেষ্টের চেয়েও বেশি। কেন একবারের বেশি দেওয়া হবে এবং পরে এই কাজের জন্য অনুতপ্ত হতে হবে?
‘খুলা’’ প্রক্রিয়াঃ
ইসলাম নারীদের জন্যেও ‘খুলা’’ প্রক্রিয়ায় বিবাহবিচ্ছেদকে প্ররোচিত করার একটি পথ খোলা রেখেছে। এটি তখন হয় যখন স্ত্রী প্রত্যাহার করা যায় না এমন তালাকের বিনিময়ে তার বিবাহ উপহার (মহর) বা অন্য কোন পরিমাণ অর্থ স্বামীকে ফেরত দেয়।
বুখারীর একটি হাদিস অনুসারে, ইবনে আব্বাস (রদিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে বর্ণিত, সাবিত ইবনে কায়স এর স্ত্রী রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে এসে বলল যে তাঁর স্বামীর ধার্মিকতা বা চরিত্রের ব্যাপারে কোন অভিযোগ নেই, কিন্তু তিনি একজন মুসলিমা হয়ে তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়ার বিষয়টির মীমাংসা করতে পারছেন না; তিনি এই মহান ব্যক্তিকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারছিলেন না এবং এটি তাঁকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছিল যেহেতু তিনি ভাবছিলেন যে তিনি এই মূল্যায়ন করতে না পারার কারণে তাঁর ঈমানের সাথে আপস করছেন। ইসলামে স্বামী ও স্ত্রীর থেকে প্রত্যাশা করা হয় যে তারা তাদের সম্পর্ক থেকে লাভবান হবে এবং এই সম্পর্কের কারণে ভোগান্তি হবে না। আমাদের প্রিয় রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর এই উভয়সঙ্কট অবস্থা উপলব্ধি করলেন এবং পরামর্শ দিলেন যে তিনি যেন তাঁর স্বামীকে মহর ফেরত দিয়ে দেন এবং স্বামী যেন তাঁকে তালাক দেন। তিনি জোরাজুরি করলেন না যে তাঁরা যেন একত্রেই থাকে।
প্রায়শই ‘খুলা’’ প্রক্রিয়া পরস্পর সমঝোতার ভিত্তিতে সাজানো যায় না তাদের মধ্যেকার তিক্ততার কারণে, এবং কখনো কখনো যথার্থ স্বামী হিসেবে দায়িত্ব পূর্ণ না করেও স্ত্রীকে তালাক দিতে রাজি না হওয়ার ক্ষেত্রে স্বামীর জেদ ও একগুঁয়েমির কারণে। এরকম ক্ষেত্রে স্ত্রীকে উপদেশ দেওয়া হবে শরীয়াসম্মত আদালতের মাধ্যমে প্রতিকার করার চেষ্টা করা।
কাঁটাগুলিকে প্রদর্শন না করে বিবাহের ফুলেল একটি চিত্র উপস্থাপন করা যথার্থ হবে না। মাসের পর মাস আমি এ ব্যাপারে পরামর্শ পেয়েছি এবং অনেক সময় জনসাধারণের মধ্যে বিবাহ ও বিচ্ছেদের আইন কানুনের ব্যাপারে এই ব্যাপক অজ্ঞানতার সম্মুখে নিজেকে অসহায় বোধ করি। বৈবাহিক সম্পর্কের ভালোর পাশাপাশি খারাপ দিকগুলির জ্ঞান আমাদের এই বিষয়গুলিকে পরিষ্কারভাবে দেখতে সাহায্য করা উচিৎ। অনেক দম্পত্তি বুলিসর্বস্ব “অবশেষে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল” পরিণতি অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা যদিও চালায়, কিছু বিবাহ নিঃসন্দেহে লড়াই ও মতানৈক্য এর মধ্য দিয়েই যায়। এটি প্রত্যেক ব্যক্তির করণীয় তাদের বিবাহকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করার এবং তাদের সঙ্গীর কাছে সেরা সঙ্গী হওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালানো, এটি স্মরণ রেখে যে একদিন আমাদের সকলকেই আল্লাহর কাছে কৃতকর্মের জন্য জবাব দিতে হবে। এর সাথে আমাদের আস্থা একমাত্র আল্লাহর উপর রাখতে হবে, কারণ তিনিই একমাত্র জানেন সর্বোত্তম কোনটি।
মুফতি আবদুর রহমান ইবনে ইউসুফ
প্রতিলিপিঃ জাহিরা ওমর
সম্পাদনাঃ আহমেদ লিমবাদা
অনুবাদঃ মুহাম্মাদ জাহিদ হাসান